ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

জি-৭ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৫ জুন ২০১৬

জি-৭ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ভূমিকা

বর্তমানে পৃথিবীর ৭টি উন্নত দেশের জোট গ্রুপ অব সেভেন যা জি-৭ হিসেবে পরিচিত। এই ৭টি দেশ হলোÑ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, কানাডা, ইতালি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশসমষ্টি ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সম্মিলিতভাবে এই জোটভুক্ত দেশ পৃথিবীর মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বা জিডিপির প্রায় ৪২ শতাংশের দাবিদার। ২০০৯ সালে পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত এই জোটের বর্ধিত অবয়ব জোট-২০ এর শীর্ষ সভায় অবশ্য ঘোষণা করা হয় তখন থেকে জি-২০ দল পৃথিবীর ধনী দেশসমূহের মুখ্য অর্থনৈতিক কাউন্সিল হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। সেই পটভূমিকায় সংখ্যার হিসাবে জোট-৭ ছোট হলেও বিত্ত ও গুরুত্বের বলে জি-৭-ই বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব খাটিয়ে আসছে। বিশ্ব নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের ভূমিকা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জোট-৭ এর ভূমিকার তুলনায় ম্লান হয়ে গেছে বলা চলে। ১৯৮১ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশসমষ্টি জি-৭-এর সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করে এসেছে। ২০১৩ পর্যন্ত রাশিয়াসহ জি-৭ এর পরিচিতি ছিল জি-৮ হিসেবে। ২০১৪ থেকে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার পর জি-৮ এর সদস্য হিসেবে অন্যান্য সদস্য রাশিয়াকে কার্যত বহিষ্কার করে জি-৮কে জি-৭ এ রূপান্তরিত করে। ইতোমধ্যে জি-৭ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে ক্রিমিয়ার বাইরে অন্য দেশে আগ্রাসন না চালালে ২০১৭ থেকে রাশিয়াকে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। স্বীকার করা হয়Ñ শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়ায় রাশিয়াকে বাদ দিয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। জি-৭ বা জি-৮ জোটের সূত্রপাত হয় ১৯৭৫ সালে যখন ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে তাদের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক নীতি ও কার্যক্রম সমন্বিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরে ১৯৭৬ সালে কানাডার অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে এই জোট জি-৭ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৯৭ সালে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে এ জোট জি-৮ হিসেবে পরিচিত হয়। প্রথম থেকে জি-৮ এর সদস্য দেশ ধনী ও উন্নত দেশ হিসেবে পৃথিবীতে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাদের নিজস্ব বাণিজ্য, বিদেশী সহায়তা, জলবায়ু এবং রাজনৈতিক-মানবিক অধিকারবিষয়ক নীতি ও কার্যক্রম পরিচালনা করার নীতি গ্রহণ করে। প্রতিবছর এই প্রেক্ষাপট এবং লক্ষ্যে তারা এসব দেশের শীর্ষ সম্মেলন করে আসছে। চলতি বছরের ২৬ থেকে ২৭ মে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় জাপানে। জাপানের কাশিকো দ্বীপে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন ছিল জি-৭ এর ৪২তম সম্মেলন। এতে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ, জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মের্কেল, ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেট্টিও রেনজি, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রোডো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল টাস্ক। এই জোটের সম্মেলনে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রোডো প্রথমবারের মতো যোগ দিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই সম্মেলনে শেষবারের মতো যোগ দিয়েছেন। পরবর্তী জি-৭ এর শীর্ষ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী নতুন প্রেসিডেন্ট যোগ দেবেন। ওই ৭ নেতার বাইরে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো, লাউসের প্রধানমন্ত্রী থংলোন সিসোলিথ, পাপুয়া নিউগিনির প্রধানমন্ত্রী পিটার ওনিল, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রি পালা সিরিসেনা, চাদের প্রেসিডেন্ট ইন্দ্রিস দেবি এবং ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী নোয়েন জুয়ান ফুককে। আশা করা হয়েছিলÑ আমন্ত্রিত অতিথিরা জি-৭ এর নেতাদের সঙ্গে তাদের মূল আলোচনার পাশাপাশি উন্নয়নশীল বিশ্বের আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজন সম্পর্কে অবগত হবেন এবং সেই আলোকে উন্নত পৃথিবীর আগামী ১ বছরের নীতি ও কার্যক্রম তাদের অনুকূলে সংবেদনশীল করতে সোচ্চার ও সচেষ্ট থাকবেন। ২০১২ থেকে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স জি-৭-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ব্রাজিল, চীন, ভারত, মেক্সিকো ও দক্ষিণ আফ্রিকার নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। তখন থেকে এসব দেশ জি-৭ এর সম্মিলনীতে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করে এসেছে। এবার তাদের জায়গায় বাংলাদেশসহ ওই ৭টি দেশ এই সম্মিলনীতে অংশগ্রহণ করতে আমন্ত্রিত হয়েছে। আমন্ত্রিত এসব দেশের বাইরে এই সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) অংশগ্রহণ করে। জি-৭ এর নেতাদের ইচ্ছা অনুযায়ী এই জোটের কর্ম সম্পাদনের জন্য কোন প্রশাসনিক সংগঠন সৃষ্টি হয়নি। এই জোটের কোন স্থায়ী সচিবালয় বা অফিস নেই, এর সভাপতির পদে প্রতিবছরই পরিবর্তন ঘটে। যে দেশ সভাপতিত্ব গ্রহণ করে সে দেশ আনুষ্ঠানিক সম্মেলনের আগে সদস্য দেশসমূহের পররাষ্ট্র, অর্থ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সভা শেষে সম্মেলনের নেতাদের সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণের পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। প্রথা অনুযায়ী স্বাগতিক দেশ বা জোটের সভাপতি অন্যান্য জোট সদস্যের মতামত নিয়ে সম্মেলনের আলোচ্য সূচী নির্ধারণ করেন। এবারকার জি-৭ সম্মেলনে উন্নত দেশের নেতৃবৃন্দ বিশ্বব্যাপী অর্থ ব্যবস্থার প্রসারণে ধীরগতি এবং তেলের মূল্য হ্রাসের অভিঘাত সম্পর্কে, মুক্ত বাণিজ্যের প্রসার বিষয়ে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্তরাজ্যের থাকা বা না থাকা বিষয়ে আলোচনা করেন। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের আশঙ্কিত প্রত্যাহারকে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উন্নয়নের প্রতিকূল পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করে ঐ রূপ প্রত্যাহারের প্রতিকূলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাবধান করেছেন। আশা করা যায় এই জি-৭ সম্মেলনে উচ্চারিত এমন সাবধান বাণী যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার অনুকূলে সন্দীপিত করবে। এই প্রসঙ্গে তারা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তঃপ্রশান্ত মহাসাগরীয় মুক্ত বাণিজ্য জোট (টিপিপি) স্থাপনের প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেন। জানা গেছে, নীতিগতভাবে সকল সদস্য দেশ এই এলাকায় মুক্ত বাণিজ্য প্রসারণের অনুকূলে মত প্রকাশ করেছে। এই ক্ষেত্রে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান সক্রিয় ও সমন্বিত মুদ্রানীতি অনুসরণের প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। বৈদেশিক নীতির আওতায় তারা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনের সমস্যা, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কার্যক্রম, দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর বহুজাতিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করেন। পৃথিবীব্যাপী সন্ত্রাসের প্রতিকূলে কার্যক্রম জোরদার করার জন্য, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাদি মেটানোর লক্ষ্যে এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কার্যক্রম প্রতিহত বা সীমিতকরণের উদ্দেশ্যে তারা ঐকমত্যে পৌঁছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সমস্যাকে বিশ্বব্যাপী সমবেতভাবে মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়। তারা অভিবাসীদের স্বাগতিক দেশসমূহকে সহায়তা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেন। সকল নেতা পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর প্রতিকূল পরিবর্তন মোকাবেলা করার জন্য গত এপ্রিলে প্যারিসে উপনীত চুক্তি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে এবং সকলের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একমত হন। এই সম্মেলনে বিশেষভাবে আলোচিত হয় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত টেকসই উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যনিচয় সম্পর্কে। জাতিসংঘ কর্তৃক টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিল। নেতৃবৃন্দ টেকসই উন্নয়নের সকল লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য তাদের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেবেন বলে একমত হন। এই প্রসঙ্গে তারা টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সৃষ্টি এবং তার অর্থায়নের ওপর জোর দেন। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সেবা প্রসঙ্গে জোট নেতৃবৃন্দ সম্ভাব্য মহামারী নিরোধ এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা বিস্তৃতকরণের লক্ষ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দেন। একই সঙ্গে তারা নারীর ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষা ও বিজ্ঞানের বিস্তৃত প্রসারণের ওপর গুরুত্ব দেন। জোট নেতৃবৃন্দ পৃথিবীব্যাপী দুর্নীতি দমন কার্যক্রমকে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর অনুকূল পদক্ষেপ বলে বিবৃত করেন। সম্মেলনকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টে প্রথম আণবিক বোমার বিস্ফোরণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হিরোশিমা নগর পরিদর্শন করেন। এই পরিদর্শনের মাধ্যমে তিনি ব্যাপক যুদ্ধ ও সহিংসতা যে শান্তি স্থাপনে সহায়ক নয় তা স্মরণ করে হিরোশিমায় আণবিক বোমার প্রথম আঘাতে প্রাণ হারানো ৭০ হাজার মানুষের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শান্তিকামী পৃথিবীবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। হিরোশিমায় ওই বোমাবর্ষণের আঘাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরে তিনি শান্তির অনুকূলে গত ৭০ বছর ধরে পৃথিবীব্যাপী সকল মানুষের চেতনাবোধকে স্মরণ করিয়ে দেন। ওবামার এই বক্তব্যকে এই প্রেক্ষিতে যখন আমার এক মার্কিন বন্ধুর কাছে প্রশংসনীয় মনোভাব হিসেবে উল্লেখ করেছিলাম তখন তিনি তাদের তরফ থেকে ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান কর্তৃক অতর্কিতে পার্ল হারবার আক্রমণের অযৌক্তিকতা ও নৃশংসতার কথা টেনে আনেন। এবারের সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ সম্মান, গুরুত্ব ও স্বীকৃতি লাভ করেন। শেখ হাসিনা জি-৭ এর নেতৃবৃন্দের সামনে বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নত দেশ থেকে অধিকতর সহায়তা উন্নয়নশীল দেশের অনুকূলে সঞ্চালন, উন্নত দেশসমূহের বাজার অনুন্নতের জন্য অধিকতর মাত্রায় উন্মুক্তকরণ এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রতিহতকরণে উন্নত দেশসমূহকে বিশ্বব্যাপী অধিকতর কার্যক্ষম পদক্ষেপ নেয়া ও উন্নয়নশীল দেশে বিশ্ব উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে অধিকতর বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান। (চলবে)
×