ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চলে গেলেন ‘দ্য গ্রেটেস্ট’

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ৫ জুন ২০১৬

চলে গেলেন ‘দ্য গ্রেটেস্ট’

শোকস্তব্ধ বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন শাকিল আহমেদ মিরাজ ॥ বক্সিং রিংয়ে তিনি কমই হার মেনেছেন। লড়াইয়ের পর লড়াই, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দুরন্ত মুষ্টাঘাতে রাঘব বোয়াল প্রতিপক্ষকে কাবু করে ছিনিয়ে এনেছেন একের পর এক জয়। হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি। সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে সেই তাকে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হলো। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমালেন সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ হেভিওয়েট বক্সার, বিংশ শতাব্দীর ‘আইকন’ মোহাম্মদ আলি। শনিবার ভোরে জন্মভূমি যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন বক্সিং ইতিহাসের এই মহানায়ক। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি (৩২ বছর) সময় পারকিনসন রোগে ভুগছিলেন তিনি। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে সপ্তাহের শুরুর দিকে তাকে আরিজোনার ফিনিক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই কদিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। শুক্রবার সকাল থেকেই অবস্থার অবনতি হতে থাকে, শনিবার ভোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে। পেশাদার হেভিওয়েট বক্সিংয়ে অনন্য সব কীর্তি আলিকে সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকায় পরিণত করে। তিনবারের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন আলি জিতেছিলেন ১৯৬০ অলিম্পিকের সোনা। পারিবারিক মুখপাত্র নিশ্চিত করেছে, পারকিনসন রোগে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার কারণেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮১ সালে পেশাদার বক্সিং থেকে অবসর নেয়ার দু’বছর পর থেকেই এই রোগে ভুগছিলেন তিনি। গত বছর শুরুর দিকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। তার পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, জন্মস্থান কেনটাকির লুইসভিলে শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে। মোহাম্মদ আলির আগের নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে। এই নামেই তিনি বক্সার হয়ে ওঠেন। ১৯৬০Ñএ রোম অলিম্পিকে এই নামেই সোনা জিতেছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর ১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনকে হারিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো বক্সিংয়ের বিশ্বসেরার মুকুট পরেন। তিনিই প্রথম বক্সার যিনি তিন-তিনবার বিশ্বসেরার খেতাব জয় করেন। সাফল্যের পরিসংখ্যান আলিকে যেন অতিমানবীয় হিসেবে তুলে ধরে। নিজের ৬১টি পেশাদার লড়াইয়ের ৫৬টিতেই জিতেছেন বিরল প্রজাতির এই বক্সার। যেখানে ৩৭ বারই প্রতিপক্ষকে সরাসরি নকআউট করেনÑ এমন রেকর্ড ইতিহাসে আর কারোরই নেই। আলি কেবল বক্সিং রিংয়েই জনপ্রিয় ছিলেন না, পাশাপাশি সেবামূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছেন। ১৯৭৪ সালে মধ্য আফ্রিকার জায়ারের কিনশাসাতে জর্জ ফোরম্যানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক লড়াই ‘র‌্যাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ নামে পরিচিত। এছাড়া আলি তৎকালীন পরাক্রমশালী লিস্টন ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জো ফ্রেজিয়ারকে নকআউট করে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন। ফ্রেজিয়ার মারা গেছেন ২০১১ সালে, এবার আলিকে হারিয়ে ফোরম্যান টুইটারে লিখেছেন, ‘আলী, ফ্রেজিয়ার ও আমি একই সত্তা। এর মধ্যে শুধু আমিই রয়ে গেলাম...।’ টুইট করেছেন আধুনিক সময়ের জনপ্রিয় বক্সার মাইক টাইসনও,‘ঈশ্বর আজ তার চ্যাম্পিয়নকে নিতে এলেন। চিরবিদায় গ্রেট ওয়ান।’ ওয়ার্ল্ড বক্সিং এ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতি, ‘বক্সিং কিংবদন্তি আলি, যিনি সমাজের সঙ্গেও লড়েছেন। সম্মানিত একজন ব্যক্তি। দুর্দান্ত এ্যাথলেট, নিজের শেষ বিন্দুটুকুও ঢেলে দিতেন। তিনি ছিলেন একজন রোল মডেল, অনেক তরুণের আদর্শ। সবসময় আদর্শের পক্ষে লড়েছেন। পুরো বিশ্ব আজ শোকাতুর। শান্তিতে থাকুন মোহাম্মদ আলী।’ আরেক সাবেক চ্যাম্পিয়ন ইভান্ডার হোলিফিল্ড বলেন, ‘আমি খুশি যে মোহাম্মদ আলিকে দেখেছি। যখন ছোট ছিলাম, আট বছর বয়স ছিল, সবাই বলত, আমি আলির মতো হব।’ আরেক চ্যাম্পিয়ন ফিলিপাইনের ম্যানি প্যাকিয়াও’র টুইট, ‘আমরা একজন কিংবদন্তিকে হারালাম। তার মনুষ্যত্ববোধ ও মানবতা ছিল অপরিসীম। সৃষ্টিকর্তা তাকে আশীর্বাদ করুন।’ আমেরিকান রেসলার ও চলচ্চিত্র অভিনেতা জন সিনার মন্তব্য, ‘পুরো পৃথিবীতে দ্য গ্রেটেস্টের প্রভাব ছিল অতুলনীয়। শান্তিতে থাকুন মোহাম্মদ আলি।’ অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী আমেরিকার নারী ফুটবলার এ্যালেক্স মগানের টুইট, ‘আলিই ছিলেন প্রথম এ্যাথলেট, যাকে দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। সত্যিকারের একজন চ্যাম্পিয়ন, একজন কিংবদন্তি।’ অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা এ্যাথলেট ফ্রিম্যান আলিকে সম্মান জানিয়েছেন এভাবে, ‘কেবল ক্রীড়াঙ্গন নয়, গোটা বিশ্বেই আলি নামটি অসাধারণ কিছুর প্রতীক হয়ে আছে। তার নাম ও গল্পগাঁথা চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। শান্তিতে থাকুন।’ সাবেক ইংলিশ গ্রেট ফুটবলার গ্যারি লিনেকার বলেন, ‘সে সব সময়ের, সব ক্রীড়ার সেরা এক এ্যাথলেট, যিনি খেলাটার সীমা ছাড়িয়ে গেছেন।’ এছাড়া পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতীয় প্রমীলা বক্সার ম্যারিকম স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেন, ‘আলি প্রায় সব বক্সারেরই অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন। আমরাও। তাকে দেখেই বক্সিংয়ে আসা, বক্সিং ক্যারিয়ারে তার লড়াই আর পরিশ্রমই আমার প্রেরণা। খুব কষ্ট পাই, তিনি আর নেই। আমি তাকে সবসময় স্মরণ করব, হৃদয়ে ধারণ করব।’ আলি সরব ছিলেন নিপীড়িত মানুষের অধিকারের দাবিতেও। প্রথমবার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার মাত্র ৩ বছর পর তাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল আমেরিকা সরকার। কিন্তু আলি সেটি প্রত্যাখ্যান করে উদ্ধত কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি যুদ্ধের বিপক্ষে। মাঠ ও মাঠের বাইরে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালীদের একজন। স্পোর্টস ইলাস্ট্রেট তাকে ‘শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদের’ খেতাবে ভূষিত করে। বিবিসির চোখেও শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব তিনিই। ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিদূত হিসেবে তাকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। এছাড়া ২০০৫-এ আমেরিকার সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান অনার ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ পুরস্কারে ভূষিত হন। বিশ্বের তাবত ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে তিনি সর্বকালের সেরা, তিনিই সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ নামটা সে কারণেই। মৃত্যু তাকে অন্য এক ভূবনে নিয়ে গেছে। কিন্তু তার কীর্তি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
×