ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধীদের জন্য তুরস্কের মায়াকান্নার নেপথ্যে

গো. আযম ও নিজামীর সঙ্গে এরদোগানের গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৫ জুন ২০১৬

গো. আযম ও নিজামীর সঙ্গে এরদোগানের গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল

শংকর কুমার দে ॥ যে কারণে তুরস্ক যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করছে তার নেপথ্য কাহিনী জানা গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার পরও তার জন্য মায়াকান্না করার কারণ হচ্ছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়্যেপ এরদোগানের সঙ্গে ছিল ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক গভীর সম্পর্ক। এছাড়াও জামায়াতের অর্থের যোগানদাতা ধনকুবের মীর কাশেম আলীকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো থেকে বাঁচানোই হচ্ছে তুরস্কের মরিয়া হয়ে ওঠার কারণ। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে তুরস্কের এত মরিয়া হয়ে ওঠার বিষয়ে কী কী কারণ রয়েছে তার অনুসন্ধান করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে মরিয়া হয়ে পক্ষ নিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। বিগত বিএনপি জোট সরকারের মন্ত্রী থাকাকালে দু’দফায় তুরস্ক সফর করেন মতিউর রহমান নিজামী। জামায়াতে ইসলামীর প্রায় সব কেন্দ্রীয় নেতাই গত এক দশকে তুরস্ক সফর করেছেন। এরদোগানও যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন জামায়াত নেতাদের দীর্ঘ সাক্ষাত দেন। এখন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উচ্চশিক্ষার গন্তব্যে পরিণত হয়েছে তুরস্ক। জামায়াত পরিচালিত বিভিন্ন দাতব্য কার্যক্রমের প্রধান পৃষ্ঠপোষকতার নামে জঙ্গী সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন করত তুরস্ক। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতেও জামায়াতের প্রধান সমর্থক তুরস্ক। যুদ্ধাপরাধের বিচার পর্যবেক্ষণে দুই দফায় প্রতিনিধি দল পাঠায় দেশটি। জামায়াতের সুরে তুরস্ক একাধিকবার বলেছে, বিচার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়নি। মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রতিবাদে বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয় তুরস্ক। সর্বশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ও মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিও উষ্মা প্রকাশ করেছে তুরস্ক। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর আজীবন কারাদ- হওয়ার পর কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে ছিল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়্যেপ এরদোগানের ব্যক্তিগত ও গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ক। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়্যেপ এরদোগান তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্নে জামায়াতে ইসলামীর চেয়েও কট্টর ইসলামপন্থী দলের সদস্য ছিলেন। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর কুখ্যাত স্বৈরশাসক নাৎসী বাহিনীর প্রধান হিটলারের শাসন ব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন তিনি। গণহত্যার বিচারের প্রশ্নেও বরাবর একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) এবং বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী একই মতাদর্শে বিশ্বাসী। এ কারণেই এককালের ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক জামায়াতের ঘনিষ্ঠ মিত্রতে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, তুরস্ক ও তুরস্কের এ প্রেসিডেন্ট এরদোগান বর্তমান বিশ্বের সবেচেয়ে দুর্ধর্ষ আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের সরবরাহ করা তেলের বড় ক্রেতা দেশ ও আইএসের সহযোগিতাকারী। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার পর্যবেক্ষকের ছদ্মাবরণে টুরিস্ট ভিসায় তুরস্কের ১৪ সদস্যবিশিষ্ট আইনজীবীর একটি প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় পাঠায় তুরস্ক। তারা তখন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত এসেছিলেন। তারা নিজেদের পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী বললেও আসলে তারা তুরস্কের আইনজীবী। ১৪ জনের মধ্যে একজন ছিলেন বেলজিয়ামের। রেজিস্ট্রার অফিস থেকে বলা হয়েছে, তারা সরাসরি ট্রাইব্যুনালে এসে পাস চান। যেহেতু এটি পাবলিক ট্রায়াল সে কারণেই তাদের শর্তসাপেক্ষে পাস দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনালে কঠোর নিরাপত্তা থাকলেও কিভাবে প্রধান গেট দিয়ে তারা প্রবেশ করেছেন এ বিষয়ে খোদ ট্রাইব্যুনাল অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। রাষ্ট্রের একজন আইন কর্মকর্তা তখন বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর অংশ হিসেবেই তুরস্কের মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা ট্রাইব্যুনালে এসেছেন। ব্রাদারহুডের সদস্যদের ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শন সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করা হয়। তুরস্কের ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল ট্রাইব্যুনালে আসার পর আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বেশ উৎফুল দেখাচ্ছিল। প্রসিকিউশন থেকে তখন বলা হয়, আসামিপক্ষ যেভাবে অর্থ ব্যয় করছে তার আরেকটি উদাহরণ তুরস্কের এ প্রতিনিধি দল, যারা পর্যবেক্ষক নামে এসেছে। আসলে আসামিপক্ষকে আইনী সহায়তাদানই তাদের প্রধান কাজ। বিশাল অঙ্কের অর্থ ছড়াচ্ছে যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী ও জামায়াত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে জামায়াত দেশে-বিদেশে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে। তারা বিদেশে থেকেও নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে। ২০১১ সালের ১৫ নবেম্বর চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ এমন একটি বিষয় ট্রাইব্যুনালের নজরে এনেছিলেন। যারা বিদেশে জামায়াতের আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দেন তার অংশ হিসেবে ওই তিন বিদেশী আইনজীবী স্টিভেন কে, টোবি ক্যাডম্যান ও জন ক্যামেগ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের অপসারণ চেয়ে তার কাছেই ই-মেইল করেন। এ বিষয়টি চীফ প্রসিকিউটর গোলম আরিফ টিপু ট্রাইব্যুনালের নজরে আনেন। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ছড়াতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্রভাবিত করতে অর্গানাইজেশন ফর পিস এ্যান্ড জাস্টিস ইনকর্পোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট ফার্ম কেসেডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটস ইনকর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে। এর আগে জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী ও তার ভাই মীর মাসুম আলী ২০১১ সালে তিন লাখ ১০ হাজার ডলারের বিনিময়ে প্রাথমিকভাবে তিন মাসের জন্য কেসেডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসকে নিয়োগ করেছিলেন। জামায়াতের অর্থের যোগানদাতা, ধনকুবের শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীকে ফাঁসির দড়ির হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই তৎপরতা চালাচ্ছে পাকিস্তান ও তুরস্ক। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের অর্থের যোগানদাতা জামায়াত নেতা ধনকুবের মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ-াদেশ থেকে যে কোনভাবে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে তৎপরতার চালাচ্ছে জামায়েতের ঘনিষ্ঠ তুরস্ক ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তাকে সহায়তা করছে পাকিস্তান। পাকিস্তান তো সহায়তা করবেই। কারণ যুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীরা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছে। সঙ্গত কারণেই পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধের বিচার ও রায় কার্যকরের প্রশ্নে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে, এতে আর বিস্ময়ের কী? মীর কাশেম আলীকে রক্ষা করার জন্য দেশ-বিদেশে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাকের ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘ইসলামী আন্দোলন : দেশে দেশে আরব বসন্ত’ শিরোনামে একটি লেখায়ও যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তুরস্ক যে বিরোধী ভূমিকা পালন করছে সে কথা উঠে আসে। জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় এ নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক তো লন্ডনে বসে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বিশেষ করে মীর কাশেম আলীকে যে কোনভাবে রক্ষা ও বিচারের রায় কার্যকর বিলম্বিত করার জন্য মরিয়া হয়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন। যুদ্ধাপরাধীর শীর্ষ পাঁচজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। এখন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে একমাত্র জামায়াতের অর্থের যোগানদাতা ধনকুবের মীর কাশেম আলীর ফাঁসির দ-াদেশ কবে কার্যকর করা হবে তার অপেক্ষার পালা। মীর কাশেম আলীকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো বিলম্বিত করার কৌশল নেয়া হচ্ছে।
×