ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

একটি কোম্পানিকে সুবিধা দিতে দরপত্র সংশোধন

পলাশ সার কারখানা নির্মাণের শুরুতেই দুর্নীতির অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৫ জুন ২০১৬

পলাশ সার কারখানা নির্মাণের শুরুতেই দুর্নীতির অভিযোগ

রশিদ মামুন ॥ দরপত্র সংশোধন করে একক কোম্পানিকে সুবিধা দেয়ার প্রক্রিয়ায় ঘোড়াশালের পলাশ সার কারখানা নির্মাণ কাজের শুরুতেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আট হাজার কোটি টাকার কাজে একক কোম্পানিকে সুবিধা দিতে দুই মাস পর দরপত্রে সংশোধন এনে নতুন শর্ত জুড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার বদলে মাত্র একটি কোম্পানি থাকলে ইচ্ছামাফিক দামে কাজ দেয়া সম্ভব হয়। এতে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হলেও নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে। উন্মুক্ত দরপত্রে একক কোম্পানিকে সুবিধা দেয়ার চেষ্টা সরাসরি সরকারের ক্রয়নীতির (পিপিআর) সাংঘর্ষিক। এতে রাষ্ট্রের বিপুল আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিসিআইসি সূত্র বলছে, সংস্থা গত ১৪ জানুয়ারি দুই হাজার ৮০০ মেট্রিক টন ক্ষমতার একটি ইউরিয়া সার কারখানা নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল গত ১৬ মার্চ। অভিযোগ রয়েছে, জাপানী কোম্পানি মিতসুবিশিকে বিশেষ সুযোগ দেয়ার জন্য দরপত্র জমার তারিখ ১৫ দিন পিছিয়ে নতুন করে ৩১ মার্চ নির্ধারণ করা হয়। এ সময় দরপত্রে শর্তেরও পরিবর্তন আনা হয়। দুুটি দরপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায় দ্বিতীয় দফার সংশোধিত প্রস্তাবে ৪ নম্বরে একটি নতুন শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। শর্তে বলা হয়েছেÑ নিঃসরিত ফ্লু গ্যাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড ধরার জন্য আলাদা করে একটি যন্ত্র বসাতে বলা হয়েছে। নতুন এ যন্ত্রটি বসাতে অন্তত ৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। এছাড়া এ যন্ত্রটি রক্ষণাবেক্ষণে এবং পরিচালনায় পৃথক জনবল এবং জ্বালানির প্রয়োজন হবে, যা উৎপাদন খরচকে বাড়িয়ে তুলবে। এ শর্তকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, খামাখা এতে প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় হবে। আমাদের ওপর কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোন চাপ নেই। ইউরিয়ার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কার্বন ধরার জন্য আধুনিক সকল কারখানার ভেতরেই যন্ত্রাংশ বসানো থাকে। নতুন করে কার্বন ধরে তা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করাও সম্ভব নয়। এ ধরনের কারখানা নির্মাণ করতে পারে এমন ১১টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট জাপানের মিতসুবিশিকে কাজটি পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির মধ্যে মতবিরোধ দেখা গেছে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কেউ কেউ এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের অতিরিক্ত ব্যয়ের বিরোধিতা করেছেন। তবে বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ মূল্যায়ন কমিটির মতামতকে উপেক্ষা করছে। বুয়েটের একজন সাবেক শিক্ষক তিনি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য হিসেবে এর বিরোধিতা করে আসছেন। তিনি মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে এ ধরনের প্রক্রিয়া বন্ধের জোর দাবি জানান বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিশেষ একটি কোম্পানিকে সুবিধা দিতে শর্ত বদল করা হয়েছে। যে ১১টি কোম্পানি দরপত্র জমা দিয়েছে তাদের মধ্যে ১০ প্রতিষ্ঠান যে যন্ত্রপাতি বসাবে তার সঙ্গে ফ্লু গ্যাস থেকে নিঃসরিত কার্বন ধরার প্রযুক্তি রয়েছে। এ প্রযুক্তিকে বিল্ট ইন প্রযুক্তি বলা হয়। ফলে তাদের আলাদা করে কোন যন্ত্র বসাতে হবে না। উৎপাদন প্রক্রিয়ার পর সামান্য পরিমাণ কার্বন বাতাসে নিঃসরিত হবে, তা পরিবেশের কোন ক্ষতি করবে না। ইউরিয়া সার কারখানা নির্মাণের এটিই হলো আধুনিক প্রযুক্তি। এর বাইরে একটি কার্বন ধরার যন্ত্র বসাতে গেলে বাড়তি ৪০ কোটি টাকা ব্যয় হবে; তেমনি এ যন্ত্রটি দেখভালের জন্য বাড়তি লোকবলেরও প্রয়োজন হবে। বিসিআইসির এ দরপত্রের মূল্যায়ন কমিটির অনেকেই ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে যন্ত্র কেনার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তারা দরপত্রের শর্ত পরিবর্তনেরও বিরোধিতা করেন। তবে তা আমলে নেয়া হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। প্রস্তাবিত পলাশ ইউরিয়া সার কারখানায় প্রতিদিন দুই হাজার ৮০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। অর্থপ্রাপ্তির নিশ্চয়তার পর চুক্তিকৃত কোম্পানি ৩৩ মাসের মধ্যে এ কারখানা নির্মাণ করার শর্তে সরকারের সঙ্গে চুক্তি হবে। মিতসুবিশি ছাড়া বাকি ১০টি প্রতিষ্ঠানই এ কারখানা থেকে দুই হাজার ৯০০ থেকে তিন হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও চাপিয়ে দেয়া শর্তের কারণে তারা কারিগরি মূল্যায়নে টিকতে পারবে না। এতে তারা অযোগ্য বিবেচিত হলে এককভাবে একটি কোম্পানির কাছ থেকে আর্থিক প্রস্তাব নিয়ে কাজ দেয়া সহজ হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৌশলে যেহেতু একটি কোম্পানিকে কাজ দেয়া হবেÑ তাহলে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বানের দরকার ছিল কী? বিসিআইসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল জনকণ্ঠকে বলেন, এই প্রথম আমরা এককভাবে এ ধরনের কোন সার কারখানার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছি। শুরুতে অজ্ঞতাবশত কাজটি করা হয়নি স্বীকার করে বলেন, আমরা আসলে পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত। এ কারণে ফ্লু গ্যাস থেকে কার্বণ ধরার পৃথক যন্ত্র বসাতে চাই। এতে ব্যয় বাড়বে কি নাÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়লে বাড়বে তাতে সমস্যা কী। একক কোন কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য দরপত্রের শর্তে পরিবর্তন করা হয়েছেÑ এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, দেখেন আমি একক কোন কোম্পানিকে কাজ দিতে চাইলে দরপত্র ছাড়াই তো সেটা করা সম্ভব ছিল। এখন অনেক কাজই জি টু জি (দুই দেশের সরকার পর্যায়ে চুক্তি) ভিত্তিতে দেয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এ ধরনের বড় কাজের ক্ষেত্রে সরকারের ক্রয়নীতি অনুসরণ না করে কাজ দেয়া হয়েছে এ ধরনের একটি প্রকল্পর নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এটা এভাবে বলতে চাই না।
×