ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিবন্ধিত কয়েক লাখ কর্মী হতাশায় ভুগছেন

শ্রমবাজারে চরম দুর্দিন, কোন দেশেই নিয়োগ নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৫ জুন ২০১৬

শ্রমবাজারে চরম দুর্দিন, কোন দেশেই নিয়োগ নেই

ফিরোজ মান্না ॥ শ্রমবাজারে চরম দুর্দিন যাচ্ছে। কোন দেশেই কর্মী নিয়োগ হচ্ছে না। বড় বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই। নতুন বাজারও সৃষ্টি করতে পারেনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। অথচ কয়েক লাখ কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার আশায় নিবন্ধন করে বসে আছেন। তাদের বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়া এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সামনে হাজার হাজার কর্মী ভিড় করছেন, কবে তারা বিদেশে চাকরি নিয়ে যেতে পারবেন এমন কথা জানতে। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাদের আশ্বাস দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় শ্রমশক্তি রফতানি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এসব বাজারে কেবল আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্তি নেই। অথচ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, বেশ কয়েকটি দেশে জনশক্তি রফতানির বাজার ভাল যাচ্ছে। গত বছর এসব বাজারে ৫ লাখের বেশি কর্মী চাকরি নিয়ে গেছেন। এ বছর কত সংখ্যক কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছেন এমন তথ্য মন্ত্রী সচিব কেউ বলতে চাননি। তবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, কার্যত জনশক্তির সব বাজারই এখন বন্ধ। মন্ত্রণালয়ের গঠন করা কমিটি প্রতিমাসেই কোন না কোন শ্রমবাজারে যাচ্ছেন। কিন্ত কোথাও কোন সুখবর মিলছে না। বর্তমানে শ্রমবাজারের অবস্থা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে খারাপ যাচ্ছে। এ কারণে মন্ত্রী সচিব এ বিষয়ে কোন কথাই বলতে চান না। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বন্ধ শ্রমবাজার খুলতে দফায় দফায় প্রতিনিধিদল বিভিন্ন দেশ সফর করছেন। আবার বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশেও প্রতিনিধিদল এসে জনশক্তি নেয়ার আগ্রহের কথা বলছেন। এর বাইরে শ্রমবাজারে তেমন কোন উন্নতি নেই। যদিও শ্রমবাজারের উন্নয়নে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। দক্ষ জনশক্তি রফতানির বিষয়ে জোর দিয়েছে। দক্ষ জনশক্তির বাইরে নির্মাণ, কৃষি ও গৃহকর্মী পাঠানোর জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর কারিকুলামে পরিবর্তন করা হয়েছে। যে দেশে কর্মী যাবেন সেই দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি শেখানোও হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী গত বছরের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রমবাজারগুলোতে পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ছয়শ’ ৬৭ জন বাংলাদেশী চাকরি নিয়ে গেছেন। এই হিসাব ২০১৩ সালের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি। তবে ২০১৪ সালে বিদেশ চাকরি নিয়ে যাওয়ার সংখ্যা ছিল চার লাখ ২৫ হাজার ছয়শ’ ৮৪ জন কর্মী। ২০১৫ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত ১৪ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন (এক হাজার চারশ’ চার কোটি) মার্কিন ডলার রেমিটেন্স বাংলাদেশে এসেছে। জানা গেছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের লোকজনের সমন্বয়হীনতা থাকার কারণে জনশক্তি রফতানির বাজার সৃষ্টি হচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ৬ থেকে ৭ বছর ধরে বৈধপথে কর্মী নিয়োগ হচ্ছে না। মালয়েশিয়াতেও ৬ বছর ধরে বৈধভাবে কোন কর্মী যেতে পারছেন না। পরিস্থিতি এমন যে, কোন শ্রমবাজারেই বর্তমানে কর্মী নিয়োগ উল্লেখ করার মতো নয়। মালয়েশিয়া ৫ লাখ কর্মী নিয়োগের ঘোষণা দিয়েই পরের দিন আবার কর্মী নিয়োগ বন্ধ ঘোষণা করেছে। সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, দুবাই, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশেই বর্তমানে কর্মী নিয়োগ হচ্ছে না। অন্যান্য শ্রমবাজারে নিজ নিজ উদ্যোগে কর্মীরা গেলেও তা সংখ্যায় অনেক কম। যদিও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় ১৬২টি দেশের শ্রমবাজারে কর্মী নিয়োগ হচ্ছে। এই ১৬২ দেশের মধ্যে এমন এমন দেশ রয়েছে যে, গত কযেক বছরে একজন কর্মীও চাকরি নিয়ে যেতে পারেননি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি জানুয়ারিতে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, নতুন বছরে জনশক্তির বাজার বাড়াতে নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। কর্মীদের বিদেশী ভাষায় পারদর্শিতা, প্রশিক্ষণের মানোন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক এ্যাক্রেডিটেশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে এ্যাফিলিয়েশন করা, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার আলোকে বিদ্যমান কোর্স কারিকুলামকে নিয়মিত আপগ্রেড করা, বেসরকারী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত প্রশিক্ষণের মান গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রাখার জন্য নিয়মিতভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা নিয়েছে মন্ত্রণালয়। কর্মীরা দক্ষতা অর্জন করলে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ থেকেই কর্মী নেবে। তখন আর আমাদের জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে কোন বেগ পেতে হবে না। অন্যদিকে সৌদি আরব বর্তমানে পুরুষ কর্মীদের নিয়োগ করছে না। তবে সৌদি কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসে ১০ হাজার নারী কর্মী নিয়োগের জন্য গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে একটি চুক্তি করে। সেই চুক্তি অনুযায়ী তারা গত এক বছরে তিন হাজার নারী কর্মী নিয়েছে। বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা হলেও তাতে কোন সুফল নেই। গত দুই বছর প্রধানমন্ত্রী নিজে কয়েকটি দেশ সফরে গিয়ে বন্ধ শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন। কূটনৈতিক তৎপরতা ও প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় কয়েকটি দেশ জনশক্তি নেয়ার আগ্রহ দেখালেও তা কার্যকর হয়নি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটিতে ১০ লাখের মতো বাংলাদেশী কর্মরত রয়েছেন। ২০১১ সালে দেশটিতে ২ লাখ ৮২ হাজার ৭৩৯ জন বাংলাদেশী কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১২ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশটিতে কর্মী গেছেন ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন। কিন্তু ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যায় দেশটির শ্রমবাজার। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার ছিল মালয়েশিয়া। দেশটিতে ৬ লাখের বেশি বাংলাদেশী কর্মী কর্মরত রয়েছেন। ২০০৯ সাল থেকে বড় এ শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে যায়। চার বছর পর ২০১২ সালের নবেম্বরে উভয় দেশের সরকারের সঙ্গে জিটুজি (সরকারীভাবে) পদ্ধতিতে কর্মী প্রেরণে সমঝোতা হয়। ২০১৩ সালের মার্চ মাস থেকে এ পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ায় মাত্র সাড়ে ৩ হাজার কর্মী নিয়োগ হযেছে। জিটুজিতে ১০ হাজারের বেশি কর্মী নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল। ২০০৭ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতের শ্রমবাজার। দেশটিতে দুই লাখেরও বেশি বাংলাদেশী কর্মরত রয়েছেন। এখন পর্যন্ত বাজারটি উন্মুক্ত হয়নি। একই অবস্থা বাহরাইন, লেবানন, ওমান ও জর্ডানেও।
×