ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোহাম্মদ আলীর হাতেই বক্সিং পেয়েছে নান্দনিক রূপ

বিদায় আলী দ্য গ্রেট ॥ রিংয়ের রাজার জীবনাবসান

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৫ জুন ২০১৬

বিদায় আলী দ্য গ্রেট ॥ রিংয়ের রাজার জীবনাবসান

মজিবর রহমান ॥ মৃত্যু নামক অমোঘ নিয়তির কাছে নক আউট হয়ে গেলেন কিংবদন্তী বক্সার মোহাম্মদ আলী। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। বৃহস্পতিবার প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনার একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। শুক্রবার তাঁর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়। কিন্তু রাতের দিকে অবস্থার অবনতি ঘটলে আর ফেরানো সম্ভব হয়নি। চলে যান না ফেরার দেশে। পরিবার পরিজনদের উপস্থিতিতে হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন, বিশ্বনন্দিত বক্সার মোহাম্মদ আলী। বক্সিং রিংয়ের মধ্যে রাজকীয় হাঁটাচলা, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কায়দা দেখে সকলে বলতেন, ‘প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায় আর মৌমাছির মতো হুল ফুটায়’। তিনি নিজেও বলতেন, আই এম দ্য গ্রেটেস্ট, কিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড। সেই সিংহাসন খালি করে চলে গেলেন বক্সিং রিংয়ের রাজা মোহাম্মদ আলী। মৃত্যুর আগে প্রায় তিন দশক ধরে তিনি পার্কিনসন ডিজিজ- এ ভুগছিলেন। প্রাণঘাতী এই রোগের সঙ্গে চলছিল তার হার না মানা লড়াই। অসুস্থ অবস্থায় অতীতে অনেকবারই মৃত্যুকে মুষ্ঠিযুদ্ধে কাবু করে ফিরে এসেছিলেন জীবনের আঙিনায়। কিন্তু এবার আর পারলেন না অদম্য সাহসী কিংবদন্তী বক্সার মোহাম্মদ আলী। শুক্রবার কেনটাকিতে তাঁর দাফন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। জন্মসূত্রে তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে। পরবর্তীতে ধর্মান্তরিত হয়ে নাম রাখেন মোহাম্মদ আলী। মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো হেভিওয়েট বক্সিংয়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বক্সিংয়ের এই রাজাকে। ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আলীকে আমেরিকার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলা হয়েছিল মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু আলী সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া দূরের কথা। প্রবল বিরোধিতা করেন তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভিয়েতনাম নীতির। প্রকাশ্যে বলেন, আমার বিবেক আমাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দেয়ার অনুমতি দিচ্ছে না। কেন মারতে যাব ওই গরিব দেশটির লোকদের। যারা আমাকে কোনদিন কৃষ্ণাঙ্গ বলে ঘৃণা করেনি, হৃদয় থেকে দূরে ঠেলে দেয়নি। ওরা আমার ভাই। আমি কোন চাপের মুখে তাদের মারতে যুদ্ধে যেতে রাজি নই। এই সরকারী বিরোধিতার ফল হয় মারাত্মক। কেড়ে নেয়া হয় বক্সিং রিংয়ের অর্জিত সব পুরস্কার। পাশাপাশি জেলের অন্ধ কুঠুরিতে কাটাতে হয় তাকে জীবনের পাঁচটি মূল্যবান বছর। ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীমকোর্টের নির্দেশে ফিরে পান হারানো সম্মান। ফিরে পান বক্সিংয়ের লাইসেন্স। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন নীতির বিরোধিতা তাকে আরও জনপ্রিয় করে তুলে গোটা বিশ্বে। জেল থেকে বেরিয়ে সে বছরই মেডিসন স্কোয়ারে জো ফ্রেজিয়ারের কাছে প্রথমবার হারেন আলী। ১৯৭৪ সালে এই জো ফ্রেজিয়ারকে পরাজিত করে ছিনিয়ে নেন হারানো মুকুট ‘কিং আলী’। সেই ম্যাচটিকে বলা হয় শতাব্দীর সেরা লড়াই। টানা পনেরো রাউন্ড ধরে চলে দু’পক্ষের মুষ্ঠিযুদ্ধ। ২০০৫ সালে লাভ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ‘প্রসিডেন্সিয়াল মেডেল’। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম জানায়, দিন কয়েক যাবত শরীর ভাল যাচ্ছিল না মোহাম্মদ আলীর। তার জন্মস্থান, আমেরিকার কেন্টাকি প্রদেশের লুইভিল শহরে। তার পরিবার সূত্রের খবর, পার্কিনসনে আক্রান্ত আলী প্রবল শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুর সময় তার শয্যার পাশেই ছিলেন পরিবারের সদস্যরা। খেলোয়াড়ী জীবনে নাকে, মুখে, কপালে এমনকি মাথায় প্রতিপক্ষের প্রচ- ঘুষি-মার খেতে হয়েছে লড়তে গিয়ে। এসব আঘাতজনিত কারণে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন পার্কিনসন রোগে। গ্রেট আলীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বিশ্বের ক্রীড়ামহলে। ১৯৪২ সালে জন্ম নেয়া আলী মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই বক্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সনি লিস্টনকে হারিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর ১৯৭৪ সালে তৎকালীন বিশ্বসেরা জর্জ ফোরম্যান ও পরবর্তীতে জো বাগনারকে হারিয়ে এবং ১৯৭৮ সালে কেন নর্টনকে নকউট করে বিশ্বসেরার খেতার জেতেন আলী। মূলত এরপরই তার নামের পাশে স্মরণকালের সেরা বক্সারের তকমা সেঁটে যায়। বক্সিং স্টেজে তার আক্রমণাত্মক আচরণের জন্যও জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে এবং পরবর্তীতে আলীর সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি কেউ। শুধু বিশ্বসেরা বক্সার হিসেবে নয়। সমাজকর্মী হিসেবেও নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছিলেন সর্বকালের সেরা এই বক্সার। প্রথম হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে তিনি সুন্নী মতাদর্শে দীক্ষিত হন। ১৯৭১ সালেও মোহাম্মদ আলী মার্কিন নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কথা বলেছিলেন বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার পক্ষে। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সফর করেন বক্সিং রিংয়ের রাজা। তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে আলীকে দেয়া গণসংবর্ধনায় ঢল নেমেছিল হাজারো মানুষের। সে সময় আলীর সফরসঙ্গী ছিলেন তার স্ত্রী ভ্যারোনিকা। বাংলাদেশ সফরের পর তার নামানুসারে বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সংলগ্ন স্থাপন করা হয় মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম। সম্মান হিসেবে তৎকালীন সরকার নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলীকে। প্রদান করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পাসপোর্ট। বিশ্বাসীকে হাত তুলে দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশের পাসপোর্ট। উল্লেখ্য যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান হিসেবে কন্যা লায়লা আলী বেছে নিয়েছিলেন বক্সিং ক্যারিয়ার। বিশ্ব নারী হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়ে সুনাম কুড়ান গোটা বিশ্বে। যার পুরস্কার হিসেবে লায়লা আলী লাভ করেন আমেরিকার বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদ পুরস্কার। আজ মোহাম্মদ আলী নেই। কিন্তু তার বক্সিং ক্যারিয়ার, ব্যক্তিত্ব, আদর্শ অমর হয়ে থাকবে চিরদিন। ইতিহাসে লেখা ‘মোহাম্মদ আলী দ্য গ্রেট’- মুছে যাবে না কোনদিন। অনেকে বলে থাকেন বক্সিং একটি নিষ্ঠুর খেলা। কিন্তু এই নির্মম ক্রীড়াকে শিল্পে রূপ দিয়েছিলেন সদ্যপ্রয়াত মোহাম্মদ আলী। জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন ক্রীড়াবিশ্বে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ বাসস জানায়, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ শনিবার বক্সিংয়ের কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোক বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুতে বিশ্ব ক্রীড়াজগতের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আলীর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বকালের সেরা বক্সার মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। ওবামাকে প্রধানমন্ত্রীর শোকবার্তা ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে এক শোক বার্তা পাঠিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, প্রধানমন্ত্রী শোক বার্তায় বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব বক্সিংয়ের কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলী আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করায় আমি গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি। যিনি বাংলাদেশেরও একজন সম্মান সূচক নাগরিক ছিলেন। বিবৃতিতে জানানো হয়, সৌদি আরব সফরকালীন জেদ্দায় অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী সেখান থেকে এই শোক বার্তাটি পাঠান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনার (ওবামা) কাছে এবং আপনার মাধ্যমে মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবার এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছেও গভীর শোক জানাচ্ছি। মোহাম্মদ আলীকে সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভা ও বক্সিং দক্ষতা এবং সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বরের মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতির মর্যাদাকে সমুন্নত করার জন্য দীর্ঘদিন থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে অত্যন্ত সুপরিচিত ও শ্রদ্ধার পাত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতিও গভীর সমবেদনা জানান। ওবামাসহ মার্কিন নেতৃবৃন্দের শোক॥ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিংবদন্তির মুষ্টিযোদ্ধা প্রয়াত সাবেক বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, আজ আমরা অবনত মস্তকে এমন এক ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি যিনি আমেরিকার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আগামী দিনেও আমরা আবার তার সাহসিকতা ও স্পষ্টবাদিতা এবং তার সম্প্রদায় ও দেশের প্রতি ত্যাগের কথা স্মরণ করে মাথা উঁচু করব। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন মোহাম্মদ আলীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছেন, হিলারি ও আমি মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুতে মর্মাহত। আমরা তাকে বক্সিং রিংয়ে সাহসী এবং তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক হিসেবে পেয়েছি। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন প্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন, মোহাম্মদ আলী ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ, তিনি শুধু একজন অসাধারণ এ্যাথলেটই ছিলেন না, বিপুল সাহসী ও মানবতাবাদীও ছিলেন। রিপাবলিকান মনোয়ন প্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, মোহাম্মদ আলী ছিলেন সত্যিকারের সাহসী চ্যাম্পিয়ন ও চমৎকার মানুষ। সবাই তার অভাব বোধ করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শনিবার এক টুইটার বার্তায় মোহাম্মদ আলীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, তিনি ছিলেন একজন অনুকরণীয় ক্রীড়াবিদ ও অনুপ্রেরণার উৎস।
×