ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইকবাল খন্দকার

মুরগি রহস্য

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৪ জুন ২০১৬

মুরগি রহস্য

স্কুল থেকে ফিরেই শিপন উঁচু গলায় বলতে থাকে- তাড়াতাড়ি ভাত দাও মা। দেরি করলে কিন্তু নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাবে। শিপনের কথা শুনে ঘর থেকে দৌড়ে বের হন মা- সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবা। তোর ছোট মামার ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। শিপন প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে- বল কী মা? কী হয়েছে লিখনের? মা বলেন- কী হয়েছে কেউ জানে না। সকাল থেকেই সে নিখোঁজ। তুই এক কাজ কর বাবা। এখনই তোর মামাবাড়ি যা। কিন্তু একা যাবি কিভাবে? শিপন বলে- তুমি কোন টেনশন কর না। আমার বন্ধু পিয়ালকে সঙ্গে নিয়ে যাব। ওর সাইকেল আছে। ডাব্লিং করে দুজন চলে যাব। মা বলেন- তাহলে আমি তাড়াতাড়ি করে ভাত দিচ্ছি। তুই খেয়ে রওনা হয়ে যা। পিয়াল যেতে রাজি হবে তো? শিপন বলে- ওকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি। তুমি ভাত বাড়। মা ভাত বাড়েন। শিপন কলতলা থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে গাপুস-গুপুস করে খেতে থাকে। বিকেল পাঁচটার দিকে পিয়ালের সাইকেলে চড়ে মামাবাড়ির দিকে রওনা হয় শিপন। পিয়াল চালায় আর শিপন পা ঝুলিয়ে বসে থাকে ক্যারিয়ারে। তারা যখন গন্তব্যে পৌঁছে তখন সন্ধ্যা হয় হয়। শিপনকে দেখেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন মামি। দুই বন্ধু মিলে সান্ত¡না দেয় তাকে। মামির কান্না থামে, কিন্তু তিনি স্বাভাবিক হতে পারেন না। তার চোখে পানি টলমল করে। পানি টলমল করে মামার চোখেও। হঠাৎ শিপনরা হৈচৈয়ের শব্দ শুনতে পায়। তারা মামা-মামির দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকাতেই মামা বলেন- আবার মনে হয় কারও হাঁস-মুরগি ধইরা নিয়ে গেল। শিয়ালডা খুব জ¦ালাইতাছে। গত এক মাসে এই পাড়া থেইকাই কমপক্ষে বিশটা মোরগ নিছে। হুনছি ওইপাড়া থেইকাও নাকি দশ পনেরটা নিছে। এভাবে নিতে থাকলে পুরা এলাকায় আর হাঁস-মুরগি থাকব না। মামি বলেন- শিয়ালের কিচ্ছা বাদ দেন। আমার বাবারে আগে খুঁইজা বাইর করেন। পরদিন সকালে ছোট মামাদের থাকার ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল পিয়াল আর শিপন। এ সময় তারা দেখতে পায় একটা শিয়াল মুরগি ধরে জঙ্গলের দিকে ছুটে যাচ্ছে। শিপনরা হৈচৈ না করে শিয়ালটাকে অনুসরণ করে। শিয়ালটা দৌড়াতে দৌড়াতে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে যায়। শিপনও ঢুকতে চায় জঙ্গলে। পিয়াল তাকে বাধা দেয় জঙ্গলে ঢোকার দরকার নেই। শিয়াল কিন্তু কামড়ায়। এখানে চুপ করে দাঁড়া। কোন রকমে যদি গর্তটা চিনতে পারি, তাহলেই হয়। শিপন বলে- আমরা এসেছি মামার ছেলেকে খুঁজে বের করার জন্য। এখন শিয়াল নিয়ে গবেষণা করলে চলবে? পিয়াল শিপনের কথার জবাব না দিয়ে একটা আধভাঙা একটা দেয়ালের আড়ালে দাঁড়ায়। দেয়ালটা জঙ্গলের কিনার ঘেঁষে দাঁড়ানো। আগে হয়ত এটা কারও বসতভিটা ছিল। এখন পরিত্যক্ত। পিয়াল দেয়ালটার আড়ালে দাঁড়িয়ে তীক্ষè চোখে তাকিয়ে থাকে জঙ্গলের দিকে। আট দশ মিনিটের মাথায় সে দেখতে পায় গাবগাছের গোড়ার একটা গর্ত থেকে শিয়ালটা মাথা বের করেছে। পিয়াল ফিসফিসিয়ে বলে- তুই যা, সবাইকে লাঠিসোটা নিয়ে আসতে বল। আমি নজর রাখছি। শিপন বলে - লিখনের চিন্তায় এমনিতেই পাড়ার সবার মন খারাপ। এখন... শিপনকে কথা শেষ করতে দেয় না পিয়াল। বলে- আমি যেটা বললাম, সেটা কর। শিপন এবার পিয়ালের কথামতো কাজ করে। মুহূর্তেই পাড়ার লোকজন এসে ঘিরে ফেলে গর্তটা। কিন্তু গর্ত খোঁড়ার জন্য কোদাল চালাতে গিয়ে সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। কারণ গর্তের ভেতর থেকে শুধু শিয়ালই না, শিপনের বড় ভাইয়ের বয়সী তিনটা ছেলেও বের হয়ে আসে। ছেলেগুলোকে এই পাড়ার কেউই এর আগে দেখেনি। ছেলে তিনটা গর্ত থেকে বের হয়েই পাড়ার যিনি মুরব্বি, তার পায়ে আঁছড়ে পড়ে বলতে থাকে- আমাদের মাফ করে দেন। আমরা আমাদের পোষা কুকুরটাকে রংচং মাখিয়ে শিয়াল সাজিয়ে মোরগ ধরিয়ে আনতাম আর মজা করে খেতাম। শুধু এই কাজের জন্যই অনেক বুদ্ধি করে দুই মাস আগে এই গর্তটা বানিয়েছিলাম। আমরা মাফ চাই দাদা। মুরব্বি মাফ করবেন কী, তার বিস্ময়ই কাটে না। বিস্ময় কাটে না উপস্থিত কারই। তারা বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে ছেলেগুলোর দিকে। ছেলেগুলো আরও শক্ত করে পা চেপে ধরলে সম্বিৎ ফেরে মুরব্বির। তিনি বলেন- কিসের মাফ! আগে ধোলাই তারপরে অন্য চিন্তা। এ্যাই, তোরা এইগুলারে ধইরা গাছের লগে বাইন্ধা ফালা। শিপনের মামা বাঁধার জন্য এগিয়ে গেলে ছেলেদের একজন বলে ওঠে- খবরদার! আমাদের গায়ে হাত দেবেন না। তাহলে কিন্তু আপনার ছেলেকে জীবিত পাবেন না। সে কিন্তু আমাদের হাতে জিম্মি। ছেলেটার কথায় সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ে। মুরব্বি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকেন ছেলেগুলোর দিকে। এবার বিদঘুটে চেহারার ছেলেটা বলে ওঠেÑ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন মুরব্বি? চোখ ছোট করে তাকান। মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শোনেন। ধরা যেহেতু পড়েই গেছি, আসল ঘটনা বলে দিই। আমরা আসলে ছেলেধরা। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন কায়দা করে ছেলে ধরি। আপনাদের এলাকায় এসে আগে মুরগি ধরতে শুরু করেছিলাম দুটো কারণে। কারণ দুটো কী জানেন? ছেলেটা প্রশ্ন করে সবার মুখের দিকে তাকালেও কেউ কোন উত্তর দেয় না। সবাই যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ছেলেটা নিজের মতোই বলতে থাকেÑ পোষা কুকুরকে শিয়াল সাজিয়ে মোরগ ধরে আনার নম্বর ওয়ান কারণ, খাওয়া। আস্তনার ভেতর আমরা খাবটা কী? কারণ নম্বর টু এলাকার মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে রাখা। যাতে কেউ বুঝতে না পারে এলাকায় ছেলেধরা ঢুকেছে। মানুষ শিয়ালের মোরগধরা নিয়ে চিন্তা করবে না ছেলেধরা নিয়ে চিন্তা করবে? মুরব্বি এবার রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠেনÑ লিখনকে তোরা কই রাখছস? ছেলেটা বলেÑ আপনাদের ছেলেটার ভাগ্য ভাল, গত রাতেই পাচার করে দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও পাচার করতে পারিনি। একটা সমস্যা ছিল। এখনও সে আমাদের আস্তানা মানে গর্তের ভেতরেই আছে। বেঁধে ফেলে রেখেছি। তার পাশে দুজন অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে ছেলেটার ভাগ্য কিন্তু এখন খারাপ হয়ে যেতে পারে, যদি আমাদের যেতে না দেন। আমাদের, আমাদের মতো চলে যেতে দিনÑ আপনারা, আপনাদের ছেলেকে গর্ত থেকে বের করে নেন। এবার সারিবদ্ধ মানুষের পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠেÑ তোদের অবশ্যই যেতে দেব। তবে বাড়িতে না, থানায়। ছেলেগুলো দেখতে পায় পুলিশ তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।
×