ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাঈদীর সাজার রিভিউ শুনানি পাঁচ মাসেও শুরু হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৪ জুন ২০১৬

সাঈদীর সাজার রিভিউ শুনানি পাঁচ মাসেও শুরু হয়নি

আরাফাত মুন্না ॥ দেইল্লা রাজাকার খ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া আমৃত্যু কারাদ-ের রায় রিভিউ চেয়ে রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের দায়ের করা আবেদনের শুনানি শুরু হয়নি পাঁচ মাসেও। যদিও সুপ্রীমকোর্টের এক রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত রিভিউ আবেদন দ্রুত শুনানি করে নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা রয়েছে। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদ- দিয়েছিল। গত ১২ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালের সাজা বহাল রাখার আর্জি জানিয়ে রিভিউ আবেদন দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে বেকসুর খালাস চেয়ে সাঈদী আবেদন দাখিল করেন ১৭ জানুয়ারি। এই দুই রিভিউ আবেদনের শুনানি শুরু করতে রাষ্ট্রপক্ষ বা আসামি পক্ষ কেউ এখনও আবেদনই করেনি। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনের রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি শেষে দ- কার্যকর হয়েছে। সেগুলোর কোনটিতেই শুনানির জন্য এতদিন অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। সদ্য মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ আবেদনের ছয় দিনের মাথায় তা শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। গত ২৯ মার্চ রিভিউ আবেদন দাখিল করেন নিজামী। এর পরদিন ৩০ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদনটির ওপর শুনানির দিন ধার্য করার আবেদন করে। আপীল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর আপীল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য কার্যতালিকাভুক্তির আদেশ দেন। আদেশ অনুযায়ী ৩ এপ্রিল নিজামীর রিভিউ আবেদন কার্যতালিকাভুক্ত হয়। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ সংক্রান্ত আবেদনের শুনানি হয়েছে একদিনের মধ্যে। আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের রিভিউ শুনানি হয় এক মাসের মধ্যে। আর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের শুনানি হয়েছে আবেদন করার এক মাসের মাথায়। কাদের মোল্লা ছাড়া বাকি চারটি রিভিউয়ের শুনানির জন্য তারিখ চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করেছিল। তবে সাঈদীর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ এ ধরনের আবেদন এখনও করেনি। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের রায়ে সুপ্রীমকোর্টই বলেছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে দ্রুত। এ রায় প্রকাশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, আপীল বিভাগ রাষ্ট্র্রপক্ষ ও আসামি পক্ষ উভয়কেই চূড়ান্ত রায় রিভিউ চাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। তবে ১৫ দিনের মধ্যে ওই আবেদন দায়ের করতে হবে। এছাড়া আবেদনটি দ্রুততার সঙ্গে শুনানি করে নিষ্পত্তির কথাও রায়ে বলেছেন। সাঈদীর রিভিউ আবেদনের বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রিভিউ শুনানির দিন নির্ধারণ করা আদালতের এখতিয়ার। আবেদন না করলেও পর্যায়ক্রমে এমনিতেই শুনানিতে আসবে সাঈদীর রিভিউ আবেদন। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর আপীলের সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। সংক্ষিপ্ত রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে মৃত্যুদ-ের পরিবর্তে তাকে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ওই রায় দেন। অন্য চার বিচারক হলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে আংশিকভাবে মঞ্জুর করা হয় সরকার ও আসামিপক্ষের করা দুই আপীল। বিচারিক আদালতে প্রমাণিত মোট আট অভিযোগের তিনটিতে আপীলে খালাস পান সাঈদী। আর বাকি পাঁচটির মধ্যে তিনটিতে আমৃত্যু কারাদ- ও দুটিতে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে দ- দেন আপীল বিভাগ। পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের মধ্যে বিচারপতির এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সাঈদীকে মৃত্যুদ- এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্্হাব মিয়া সাঈদীকে খালাস দিয়েছেন। আপীলের রায়ে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করা এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতার মতো অপরাধে দেইল্লা রাজাকার খ্যাত সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়। এই তিন অপরাধের মধ্যে ১০ নম্বর অভিযোগে বিসাবালীকে হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদ- দিয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল ৮ নম্বর অভিযোগে হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে সাঈদীকে ফাঁসির রায় দিলেও আপীল বিভাগ অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং অন্য অংশের জন্য খালাস দেন। এছাড়া ৭ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সহযোগিতার জন্য ১০ বছর কারাদ-ের আদেশ দেয়া হয়। ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও অন্য দুই অপরাধে মৃত্যুদ- দেয়ায় এ দুই ঘটনায় কোন সাজার উল্লেখ করেনি। ৬, ৭, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগেও একই রায় এসেছিল ট্রাইব্যুনালে। এই ছয় অপরাধে শাস্তি স্পষ্ট করতে আপীল বিভাগে আবেদন করেছিল ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। আপীলের রায়ে ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন সাঈদী। আর ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৯, ১২, ১৩, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছিল। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে করা এক মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে। মামলাটি করেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী। ওই বছরের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাঈদীকে আটক দেখানো হয়। তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ১১ জুলাই ২০টি ঘটনায় আদালতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ১৪ জুলাই অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০ অভিযোগে সাঈদীর বিচার শুরু হয় ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর। প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৮ জন। এছাড়া তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া ১৫ জনের জবানবন্দীকে তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। সাঈদীর পক্ষে ১৭ জনের সাক্ষ্য শেষে যুক্তিতর্ক শুরু হয় ২০১২ সালের ৫ নবেম্বর। পরে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদ-ের রায় দেন ট্রাইব্যুনাল।
×