ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাষাবাদে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন

সাশ্রয় হবে ৬০ ভাগ পানি, উৎপাদন খরচ কমবে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৪ জুন ২০১৬

সাশ্রয় হবে ৬০ ভাগ পানি, উৎপাদন খরচ কমবে

মোফাজ্জল হোসেন ॥ অল্প সেচে বোরো ধান চাষের নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ মশিউর রহমানের নেতৃত্বে একদল গবেষক। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় এক দশক ধরে গবেষণা করে তারা ওই সফলতা পান। তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মাধ্যমে ৫০-৬০ ভাগ পানি কম লাগায় কম খরচে বোরো ধান চাষ করা সম্ভব হবে। এতে সেচে ব্যয় হওয়া প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বিদ্যুত ও ডিজেল সাশ্রয় হবে। জানা গেছে, বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের প্রধান মৌসুম- আউশ, আমন ও বোরো। তিন মৌসুমে ধান চাষ করা হলেও দেশের মোট উৎপাদনের ৬০ ভাগ ধান বোরো মৌসুম থেকে। ফলন তুলনামূলকভাবে বেশি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকায় কৃষকরা বোরো মৌসুমেই বেশি করে ধান চাষ করেন। তবে বোরো মৌসুমে বৃষ্টিপাত একেবারে না থাকায় কৃষকদের সম্পূর্ণ সেচের উপর নির্ভর করতে হয়। সাধারণত ভূ-গর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করে সেচ দেয়া হয়। এতে উৎপাদন খরচের একটি বিরাট অংশ চলে যায় শুধুমাত্র জমিতে সেচ দিতে। এছাড়াও ভূগর্ভ হতে ক্রমাগত পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, মাটিতে লবণাক্ততা, আয়রন, আর্সেনিক দূষণসহ বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও গভীর নলকূপ বসিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। হুমকির মুখে পড়ছে বোরো চাষ। নতুন উদ্ভাবিত শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ করলে একদিকে যেমন জ্বালানি সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে পরিবেশগত এ সমস্যাগুলো এড়ানো সম্ভব হবে। প্রযুক্তি সমন্ধে অধ্যাপক ড. মোঃ মশিউর বলেন, বীজতলায় চারা উৎপাদন করে কাদা করে বোরো চাষ করলে ১ কেজি ধান উৎপাদনে মাটির প্রকারভেদে ৩-৫ হাজার লিটার পানি লাগে। আর তাই পানি সেচ কমিয়ে অল্প খরচে বোরো ধান চাষ প্রযুক্তি নিয়ে অনেকদিন ধরেই চেষ্টা হচ্ছে। পানির ব্যবহার কমাতে সরকারীভাবে এডব্লিউডি (ম্যাজিক পাইপ) পদ্ধতিটি ব্যবহারের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হলেও এতে পানির সাশ্রয় হয় মাত্র ২০-২৫ ভাগ। সেখানে শুকনা পদ্ধতিতে ফলন ঠিক রেখে কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ পানি সাশ্রয় করে বোরো ধান চাষ করা যায়। এতে বোরো মৌসুমে সারা দেশে সেচে ব্যয় হওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ নিয়ে ২০০৭ সালে গবেষণা শুরু করেন ড. মোঃ মশিউর। প্রথমে দেশী-বিদেশী ১১৭টি ধানের জাত নিয়ে কাজ শুরু করে দীর্ঘ চার বছর পর ২০১১ সালে মাত্র ২টি জাতের ধান চাষে প্রাথমিকভাবে সফলতা লাভ করেন। কিন্তু এ পদ্ধতিতে সমস্যা হয়ে দেখা দেয় আগাছা। ধানের জমি অধিকাংশ সময় শুকনা থাকায় বিভিন্ন ধরনের আগাছার জন্মাতে দেখা যায়, যা ফসলের উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। তখন থেকে তিনি কিভাবে আগাছা কমানো যায় তা নিয়ে কাজ শুরু করেন। পুরোপুরি সফল হতে লেগে যায় আরও ৫ বছর। পরিবেশের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াই দেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরনের আগাছানাশক ও সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আগাছা নির্মূল করতে সক্ষম হন। তার এ পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি না করে সামান্য অঙ্কুরিত বীজ (জো অবস্থায়) ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সরাসরি জমিতে সারিবদ্ধভাবে বপন করতে হয়। এতে বীজতলা তৈরি এবং জমি কাদা করার বিপুল পরিমাণ পানি সাশ্রয় হয়। জমিতে বীজ অঙ্কুরিত হওয়া থেকে ধান সংগ্রহ করা পর্যন্ত মাত্র ৪-৮ বার সেচ দিলেই চলে। অধিকাংশ সময় জমি শুকনো অবস্থায় থাকে। ধান গাছে ফুল আসার আগে পর্যন্ত মাঝে মাঝে হাল্কা সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দেয়া হয়। শুধুমাত্র ধানগাছে ফুল আসার সময় ৩-৪ সপ্তাহ জমিতে ২-৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পানি রাখলেই চলে। আর অন্যদিকে প্রচলিত পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষে ১৮-৩০টা পর্যন্ত সেচ দিতে হয়। জুন মাসের মাঝামাঝিতে ধান কাটা শুরু হয়। এদিকে বোরো ধান একটু দেরিতে লাগানো হয় ফলে আমন ধান কাটার পরে ওই জমিতে সরিষা, আলু, ফুলকপিসহ বিভিন্ন জাতের রবিশস্য চাষ করে কৃষকরা বাড়তি টাকা আয় করতে পারেন। সহযোগী গবেষক জয়েনউদ্দিন বলেন, এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি জেলা দিনাজপুর, রংপুর, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকদের মাঠে এই পদ্ধতি যুগোপযোগী, টেকসই এবং ৫০-৬০ ভাগ পর্যন্ত পানি সাশ্রয়ী বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরা কম খরচে ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ৫৮ চাষ করে লাভবান হয়েছেন। উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সুবিধার কথা জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মোঃ মশিউর দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, এই পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে কাদা পদ্ধতির তুলনায় ১৫ দিন সময় কম লাগে, ফলন বেশি হয় এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ অনেক কম। পোকামাকড় ও রোগ বালাইয়ের আক্রমণ তলনামূলকভাবে অনেক কম। তবে ১০ শতাংশ ইউরিয়া সার বেশি লাগলেও অন্যান্য সার সমান পরিমাণে প্রয়োগ করলেই হয়। তিনি মনে করেন, উৎপাদন খরচ কমিয়ে বোরো ধান উৎপাদনকে পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও কৃষকের জন্য লাভজনক করতে হলে আগামীর কৃষিতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার ও সম্প্রসারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
×