ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক-মহাসড়কে চলছে অবৈধ বিলাসবহুল গাড়ি

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৪ জুন ২০১৬

সড়ক-মহাসড়কে চলছে অবৈধ বিলাসবহুল গাড়ি

ওয়াজেদ হীরা ॥ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এদেশে আনা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দামী গাড়ির খোঁজে মাঠে নেমেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। আর শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানের সাফল্য হিসেবে আটক হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল দামী গাড়িও। রাজধানীসহ দেশের সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলছে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা অবৈধ বিলাসবহুল গাড়ি। নিবন্ধন ছাড়াই বা ভুয়া নিবন্ধন দেখিয়ে সেগুলো দিব্যি চলাচল করছে। ‘কারনেট’ সুবিধার নামে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এদেশে আনা বিএমডাব্লিউ, ল্যান্ডরোভার, মার্সিডিজ, জাগুয়ার ফেরারিসহ এসব দামী গাড়ির খোঁজেই মূলত অভিযান চালাচ্ছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি গাড়ি জব্দ করার পর হঠাৎই উধাও হয়ে গেছে আরও প্রায় দুই শতাধিক দামী গাড়ি। যে গাড়িগুলোর অধিকাংশই কারনেট সুবিধার নামে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এদেশে প্রবেশ করেছে। তবে অভিযান থেমে নেই শুল্ক গোয়েন্দাদের। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর হতে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি দামী গাড়ি আটক করা হয়েছে। আর গত বছরের সংখ্যা মিলিয়ে ১৬টি বিলাসবহুল দামী গাড়ি আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা যার ১৪টিই চলতি বছরের মার্চ এপ্রিল ও মে মাসে আটক করা হয়েছে। এগুলোর আনুমানিক বাজার মূল্য ৭০ কোটি টাকা। অধিকাংশ গাড়ি রাজধানীর বাসা, অফিস বা হোটেলে অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়। সিলেট থেকেও আটক করা হয়েছে কোটি টাকার গাড়ি। জানা গেছে, পর্যটক সেজে বা বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অনেক সময়ই বিভিন্ন কোটায় অনেকেই শুল্কমুক্ত গাড়ি দেশে আনছেন। দেশে গাড়ি আনার পর সুযোগ বুঝে হাত বদল হয়ে যাচ্ছে অন্য হাতে। ‘কারনেট’ সুবিধার নামে বিদেশ থেকে বিলাসী গাড়ির বেশিরভাগ দেশে নিয়ে আসছে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সিলেটবাসী। পর্যটকদের গাড়ি নিয়ে যেকোন দেশে ঢোকার ক্ষেত্রে ‘দ্য কাস্টম কনভেনশন অন দ্য টেম্পোরারি ইমপোর্টেশন অব প্রাইভেট ভেহিকলস (১৯৫৪) এ্যান্ড কমার্শিয়াল রোড ভেহিকলস (১৯৫৬)’ নামে আন্তর্জাতিক আইন আছে। যা বিভিন্ন দেশে ‘কারনেট দ্য প্যাসেজ’ নামে এই আইনটি পরিচিত। কোন পর্যটক ইচ্ছা করলে গাড়ি নিয়ে শুল্ক ছাড়াই কোন দেশে যেতে পারেন। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় গাড়িটিও সঙ্গে নিতে হবে। আর সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে গাড়ি আর পর্যটক দুই একসঙ্গে প্রবেশ করলেও ফিরে যাওয়ার সময় গাড়ির হদিস মেলে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের এক তদন্তে বের হয়ে এসেছে তিন বছরে ১৯১টি গাড়ি এনে ১৩৪৪ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা। দুই হাজার থেকে চার হাজার সিসির বিভিন্ন মডেলের এসব প্রতিটি গাড়ির চলতি বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা।। এসব গাড়ি আমদানিতে আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্কসহ মোট শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয় ৮৪০ শতাংশ হারে। যার কারণে গাড়ি আমদানিতে খরচ বৃদ্ধি পায় বলে নেয়া হয় কারনেট সুবিধা। বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর ইতোমধ্যেই একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে এনবিআরের চেয়ারম্যান মোঃ নজিবুর রহমানের কাছে। যে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২০১০, ২০১১ এবং ২০১২-এই তিন বছরে কারনেট সুবিধায় আনা বিভিন্ন ব্রান্ডের ৩১৫টি গাড়ি দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয় রাজস্ব বোর্ড। যার ১৪৮টি গাড়ি ফেরত যায়নি। সেই সঙ্গে প্রকল্প এবং কূটনীতিকদের জন্য ব্যবহারের নামে আরও ৪৩টি বিলাসবহুল গাড়ি শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা হলেও যার কোনটারই এখন হদিস মিলছে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিলাসবহুল এই ১৯১টি গাড়ি দেশেই ব্যবহার হচ্ছে। আর সরকারের রাজস্ব ক্ষতি প্রায় ১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। বিলাসবহুল গাড়ির বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের নজরদারিতে অনেকগুলো গাড়ি আছে। বেশ কিছু গাড়ি আটক করেছি। এ কারণে অনেকেই সতর্ক হয়ে গাড়িগুলো অনত্র লুকিয়ে রেখেছে। তবে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা খুবই তৎপর রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আনা গাড়ি পাওয়া মাত্রই আটক করা হবে এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ জানা গেছে, এ ধরনের গাড়ি ব্যবহার করে ধরা পড়লে অনেক সময়ে সরকারের প্রাপ্য শুল্ক নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। আবার কখনও তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেই সঙ্গে পণ্য-মূল্যের ১০ গুণ পর্যন্ত জরিমানা করার আইন রয়েছে। এ ছাড়া অপরাধীর বিরুদ্ধে অর্থপাচার আইনে এবং ফৌজদারি আইনেও বিচার করা হবে। এর শাস্তি ১২ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা উভয় হতে পারে। এদিকে, বাংলাদেশ রিকন্ডিশন ভেহিকলস ইম্পোর্টার্স এ্যান্ড ডিলার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জনকণ্ঠকে জানান, দেশে বিলাসবহুল গাড়ি এখনও অনেক। যদি শুল্ক গোয়েন্দারা নজরদারি বৃদ্ধি না করে তাহলে আমাদের ব্যবসা ক্রমেই নিম্নমুখী হবে। বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের আরও জোরালো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, চলতি মাসের ২৪ মে শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করে আমদানি করা প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের একটি বিএমডব্লিউ এক্স-৫ কার জব্দ করেছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকার মাল্টিব্র্যান্ড ওয়ার্কশপ থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় বিলাসবহুল এ কারটি জব্দ করা হয়। ওয়ার্কশপের কর্মচারীরা জানিয়েছেন, তাজুল নামের একজন চালক প্রায় একমাস আগে মেরামতের জন্য এ ওয়ার্কশপে কারটি রেখে চলে যান। এরপর থেকে চালক বা মালিকপক্ষের কেউ এটি নিতে আসেননি। গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর: ঢাকা-মেট্রো শ- ০০-০৫০১ (গ্যারেজে লাগানো নম্বরপ্লেট)। গাড়িটির ইঞ্জিন ক্যাপাসিটি ৩০০০ সিসি। এ হিসেবে গাড়িটির মোট আমদানি শুল্ক ৬০১ শতাংশ। এছাড়াও গত ৪ মে সাড়ে ৮ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা বিশ্বখ্যাত রেসিং কার ‘অডিআর-৮’ জব্দ করা হয়। বনানীর জি ব্লকের ভার্সাটাইল অটোমোবাইলের গ্যারেজ থেকে শুল্ক গোয়েন্দারা গাড়িটি জব্দ করেন। ২০১৩ সালে মংলা বন্দর দিয়ে ‘অডিটিটি’ ২৫০০ সিসি হিসেবে গাড়িটি ছাড় করা হয়। যদিও গাড়িটি ‘অডিআর ৮’ ৫২০০ সিসি মডেলের। ৩০ এপ্রিল বারিধারার এ্যাপোলো হাসপাতালের পার্কিং থেকে একটি রেঞ্জ রোভার গাড়ি জব্দ করা হয়। গাড়িটি কারনেট সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়েছে। যার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। ২৪ এপ্রিলও গুলশান হতে আটক করা হয় একটি গাড়ি। পোরশে ব্রান্ডের ওই গাড়ির বাজার মূল্য তিন কোটি টাকা। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা এবং জালিয়াতির মাধ্যমে কাস্টম দলিল তৈরি করে গাড়িটি বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন করানো হয়। গত ১৯ এপ্রিল রাতে আম্বরখানায় একজন লন্ডনপ্রবাসী ভয়ে চার কোটি টাকা মূল্যের লেক্সাস গাড়ি ফেলে রেখে যান।
×