ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

সৈয়দ শামসুল হক ও তাঁর ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’

প্রকাশিত: ০৭:২১, ৩ জুন ২০১৬

সৈয়দ শামসুল হক ও তাঁর ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’

কোন কোন জীবন আছে, জীবনের চাইতে বেশি; যে জীবন কথা কয় কোন নদীর মতো, চিরায়ত নারীর মতো, কথা কয় সময়ের সাক্ষী হয়ে খরস্র্রোতা শব্দের মতো। জ্ঞানে, প্রজ্ঞায়, চিন্তা ও সাধনায় এমন প্রাণই ধারণ করে থাকে মহাজীবন, ধারণ করে থাকে এক একটি যুগ ও বটবৃক্ষের ঐতিহ্যকে। আমাদের দেশে যাঁদের নাম কণ্ঠে উচ্চারিত হলে সমগ্র বাংলাদেশ বেজে ওঠে, যাঁদের শব্দগাঁথুনিতে মজবুত হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সেতু; সৈয়দ শামসুল হক সেইসব বিরলপ্রাণের একজন। তাঁর দৃষ্টির গভীরতায়, সৃষ্টির উদ্দামতায়, শব্দের মোহনরূপে মুগ্ধ হননি এমন পাঠক বোধকরি আমাদের দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সৈয়দ হক তাঁর লেখা ও চর্চা এবং নিজেকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যেখানে কেবলই অনিন্দ্র সুন্দর আর ভালবাসার সন্ধান মেলে। এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই যে, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক তাঁর লিখনশৈলীর মাধ্যমে পাঠকদের মনের অনেকটা স্থান জুড়ে আছেন। তাই তাঁর সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তি, জীবনযাপন ও উদযাপন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ, পাঠক ও বোদ্ধাদের আগ্রহের কোন কমতি না থাকাই স্বাভাবিক। বোধকরি, সেই আগ্রহী, তৃষ্ণার্ত শ্রেণীর জন্য সৈয়দ হকের ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’ আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি মরুভূমির উদ্যানের মতো প্রত্যাশিত ও বহুল কাক্সিক্ষত প্রাপ্তি হয়েছে। সৈয়দ হক এ বইটিতে তাঁর সাহিত্যজীবনের বিপুল একটি অংশ তুলে ধরেছেন চমকপ্রদ গদ্যের প্রয়োগে। আত্মজীবনী হলেও উৎকৃষ্ট গদ্যের গুণে পাঠকরা এই গ্রন্থপাঠে জীবনীর চেয়েও বেশি কিছুর স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন। সব্যসাচী তাঁর এই গ্রন্থে যে গদ্যের প্রয়োগ করেছেন তা পাঠককে মাত্রই ঘোরগ্রস্ত করবে; পথচলার ও কথাবলার আনন্দকে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেবে। পূর্বেই বলেছি, সৈয়দ হক মহাজীবনের ধারক। স্বপ্ন বুনে বুনে তিনি স্বপ্নকে বাস্তব করেছেন, শব্দের পথে পথ হেঁটে হেঁটে তিনি আজ সফল পথিক। তিনি তাঁর সাহিত্য জীবনে, অথবা সাহিত্য চর্চায় যাঁদের পাশে পেয়েছেন, যাঁদের সান্নিধ্য পেয়েছেনÑ তা এক কথায় বিস্ময়কর। মূলত, বাংলা সাহিত্য ও শিল্পচর্চার গুরুত্বপূর্ণ খুব কম লোকই সে সময় বাকি ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে সৈয়দ হকে ঘনিষ্ঠতা, অন্তরঙ্গতা ছিল না। কায়কোবাদ, ফররুখ আহমেদ, জসীমউদ্দীন, সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, মুনীর চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, শওকত ওসমান, আনিসুজ্জামান, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, শহীদ কাদরী, ফজলে লোহানী, রশীদ করিম, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সিকদার আমিনুল হক, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, বেলাল চৌধুরী প্রমুখ বরেণ্যদের সান্নিধ্য ও ঘনিষ্ঠতা যে সৈয়দ হকের সাহিত্য চর্চাকে উস্কে দিয়েছে, আলোড়িত করেছে, ধাবিত করেছে গোপন, গহীন সুন্দরের দিকেÑ এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। মূলত সৈয়দ হকের আবির্ভাব ও বিকাশের দিনগুলো কেবল তাঁর জন্যই নয়, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্যও এ এক অসাধারণ সময় ছিল। সেই পঞ্চাশের দশকের শিল্প-সাহিত্যকর্মীরাই এ দেশের শিল্পাঙ্গনকে যেভাবে টইটুম্বর করে উপহার দিয়েছে স্বর্ণালীসময়, পরবর্তী দশকের শিল্পী, সাহিত্যিকগণ সেভাবে আর দিতে পারেননি। সৈয়দ হক ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’র মুখবন্ধে এ রকম কথাই আমাদের জানানÑ ‘আমি ও আমাদের ছবিগুলো দেখে আমার মনে হয় এমন একটি দশক এই বাংলাদেশে আর কখনও আসেনি, আসবেও না। এই অর্থে আসবে না যে, সাহিত্য সঙ্গীত চিত্রকলা আর রাজনীতিতে একসঙ্গে এতগুলো প্রতিভাবানের অভ্যুত্থানও আর ঘটবে না, আবার এত অনেক প্রতিভাবানের বিনষ্টিও আমরা আগে- পরে আর কোন দশকেই দেখব না।’ ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’র প্রথমত সৈয়দ হকের জীবনী হিসেবে বিশেষভাবে আলোকিত, দ্বিতীয়ত এ গ্রন্থে সব্যসাচীর বয়ানশিল্পও বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। লেখক কীভাবে গদ্যের কাব্যিক কারুকাজে তাঁর জীবনকে তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থে, তার একটু নমুনা দেয়া যাকÑ‘ছেদনের শব্দ পাই অবিরাম, জীবনের মাঠে ক্রিয়াশীল মহাকাল, কলম হাতে আমার সময়ের প্রায় সবাই এখন চলে গেছেন ঘাসের তলায়। ছেদন করে নিয়ে গেছে কালের কাস্তে, শুনতে পাই ছেদনের ধ্বনি অবিরাম, মধ্যরাতে, নিষ্করুণ সেই শব্দের গলা টিপে কবিতার ধ্বনি করে উঠি, নাটকের মঞ্চ আলোয় ঝলসে দিই করোটির ভেতরে, গল্পের মানুষগুলোকে সঞ্চার ও মুখরতা দেই।’ এমন দীর্ঘ দীর্ঘ লাইনে, নানা উপমায়, নানা ভঙ্গিতে সৈয়দ হক এঁকেছেন তাঁর ফেলে আসা জীবনকে, এঁকেছেন গনগনে সময়ের ইতিহাস। ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’য় কেবল ধবল-জ্যোছনা জীবনের কথাই বর্ণিত হয়নি, বিধৃত হয়েছে কষ্ট, সংগ্রাম, আড্ডা, গল্প, রাগ ও অভিমান। সৈয়দ হকের এই আত্মজীবনীর মধ্য দিয়ে অনেক অজানা কথাই উঠে এসেছে, যা পাঠক সমাজের কাছে স্বাভাবিকভাবেই অচেনা, অজানা। সৈয়দ শামসুল হকের লেখক জীবনের এ বয়ান পাঠকদের কাছে তাঁর লেখালেখি জীবনের বিচিত্রতাকে, সাধনাকে, নিরন্তর কষ্টসাধ্য চর্চাকে উন্মোচিত করবে। তাই প্রতিটি পাঠকেরই উচিত অন্তত একবার হলেও ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’ বইটি পাঠ করা, আর এ পঠন বাংলাদেশের শিল্পচর্চা ও বহুবিচিত্র শিল্পীজীবন সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার জন্যই প্রয়োজন।
×