ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

অবরুদ্ধ সময়ের ব্যাকরণ

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ৩ জুন ২০১৬

অবরুদ্ধ সময়ের ব্যাকরণ

শিল্পী মুক্তমনের মানুষ। সৃজনশীল চিন্তা-চেতনা নিয়ে তারা সৃষ্টিশীল কাজ করে যান সমাজের জন্য। শিল্পীদের এসব ভাবনা মানবতার কল্যাণে সব সময় সহায়ক ভূমিকা রাখে। ছবি বা ভাস্কর্য মানুষের মানবতার অগ্রযাত্রায় নিরলস সাহায্য-সহযোগিতা করে। মানুষের হৃদয়ে সৃজনশীল চেতনবোধ জাগিয়ে তোলে। মানুষের ব্যক্তিত্ব ও তার স্বপ্ন গভীরতায় আর দায়বদ্ধতায় ফুটে ওঠে। আর এ স্বপ্ন যদি ব্যক্তি সত্তাকে ছাড়িয়ে সবার স্বপ্ন হয়ে ওঠে তবেই তিনি শিল্পী। জীবন থেকে পালানোর জন্য শিল্প নয়। জীবনের জন্য শিল্প মহৎ স্বপ্ন স্পষ্টতার মধ্য দিয়েই মহান শিল্প হয়ে ওঠে। সত্যিকারের বোধের জন্ম দেয়। শিল্প যদি দর্শকদের স্বপ্ন দেখাতে না পারে, বোধ দায়বদ্ধতা তৈরি করতে না পারে তবে সার্বিক কল্যাণ হবে কি করে? শিল্প মনের গহীনে এক অভূতপূর্ব অজানা সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে। শিল্পবোধই শৈল্পিক চেতনার সৃষ্টি করে। সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। শিল্পবোধ ছাড়া নিজের মুক্তি নেই, মুক্তি নেই মানুষের। মানুষ বিচিত্র, মানুষের জীবনপ্রবণতা আরও বিচিত্র। প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মানবজাতি আজ বিজ্ঞানকে হাতের মুঠোয় নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই মানুষের দ্বারাই প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে মানবতাবাদ। এই যে মানবসত্তার অতিলৌকিক অতিজাগতিক এবং অতিআধিপত্যবাদী চিন্তার ভিন্নতা, এসব চিন্তার মধ্য দিয়েই প্রতিনিয়ত মানব মনে তৈরি হতে থাকে দ্বন্দ্ব আর পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করার কিছু যূথবদ্ধ মানসিকতা। সৃষ্টিশীল মানবসত্তা এসব দ্বন্দে¦র মধ্য দিয়ে চিন্তারূপের একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ কাঠামো তৈরি করতে চায়। এই যে একটি কাঠামো নির্মাণের আকুতি বা আকাক্সক্ষা, এই আকাক্সক্ষাই সৃষ্টিপ্রাণ মানুষকে মানুষের জন্য ভাবার এবং কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। শিল্পী অসীম হালদার সাগরের মানুষ, সমাজ, প্রকৃতি ও দেশ সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধিৎসা আর অপরিমেয় ভালবাসা রয়েছে। শিল্পী বিশ্বাস করেন মানুষ আর প্রকৃতির চেয়ে বড় কিছু নেই। তাই তো ঘুরেফিরে তার কাজে মানুষ ও প্রকৃতি এসেছে বার বার। সিরামিক করা ভাস্কর্যগুলোর মাধ্যমে নিজের সময়ের কথাটি বলার চেষ্টা করেছেন সাগর। একে শিল্পীর সময়ের বিবরণ বলা যেতে পারে। বিষয় ভাবনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে মাধ্যম ও উপকরণ প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন তিনি। এই সময়ের শিল্পের ধারা ও প্রবণতাগুলোর ব্যাপারেও বেশ আগ্রহী সাগর। তাই তো শিল্পের মাধ্যমে তিনি জীবন ও সময়কে প্রকাশ করতে চান। যে জীবন বর্তমান ও যে সময় প্রবহমান। ফলে তার সিরিজ ভাস্কর্যগুলো একই সঙ্গে রীতিনিষ্ঠ ও রীতি বিরোধী হয়ে উঠতে চায়। ‘এক্সিসটেন্স ইন দ্য ন্যাচার’ সিরিজ ভাস্কর্যগুলোতে মানুষের প্রতিকৃতির সঙ্গে প্রকৃতির এক নিবিড় বন্ধন স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিকৃতির সঙ্গে গাছের শেকড়গুলো সংযুক্ত। প্রতিকৃতির গলা থেকে শেকড়গুলো উপর দিকে আর প্রতিকৃতি নিচের দিকে ওল্টানো। আবার কোনটায় গলা থেকে নিচের দিকে শেকড় যুক্ত। ক্রিস্টালাইন গ্লেজ পদ্ধতিতে ভাস্কর্যগুলো তৈরি। প্রকৃতির সন্তান বলে মনে হয় ভাস্কর্যগুলোকে। আত্মার বন্ধনে তারা আবদ্ধ। নীলাভ বর্ণের ভাস্কর্যগুলোকে চটে যাওয়া বলে মনে হলেও আসলে তা নয়। এটি ভাস্কর্যগুলোর স্বভাব বৈশিষ্ট্য। তার ভাস্কর্যগুলো আদিম ও কাল নির্দিষ্ট নয়, এমন চেতনা ধারণ করে এবং সমকালীন পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহার করে নতুন অভিব্যক্তির জন্ম দেয়। কুশলী ঋণাত্মক ও নান্দনিক অসামঞ্জস্য এবং চকিত ভঙ্গুর বিমূর্ত বীক্ষণের মধ্যেও তার ভাস্কর্যে অন্তর্নিহিত শক্তির সক্রিয়তায় ভরপুর। মানবতা আর গভীর মগ্নতায় অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তার ভাস্কর্যগুলো গড়া। আধ্যাত্মিকতার আঁচে বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনা হিসেবে ভাস্কর্যগুলোকে আমরা বিবেচনা করতে পারি। ‘ফ্রিডম অব লাইফ’ সিরিজ ভাস্কর্যে বিভিন্ন ধরনের পটারির সঙ্গে প্রজাপতি, পাখি ইত্যাদি যুক্ত অবস্থায় দেখা যায়। পটারিগুলোতে নান্দনিকতার সহিত বিভিন্ন ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা দর্শকচিত্তে প্রশান্তি এনে দেয়। পটারিগুলোর একেবারে মুখের ওপরে পাখি ও প্রজাপতির অবস্থান। প্রজাপতি ডানামেলে আর পাখি চুপচাপ বসে আছে। স্থির হলেও গতিশীলতা অনুভূত হয়। কোন পটারির গলায় আবার সাপের মতো বস্তু আছে। আবার মানুষের প্রতিকৃতির সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে পাখি। মাথা নিচের দিকে উপুড় হয়ে মোটা থেকে ক্রমান্বয়ে চিকন হয়ে সিলিন্ডারের মতো উঠে গিয়ে শীর্ষে পাখির প্রতিকৃতি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কোনটি সামান্য বাঁকানো আবার কোনটি স্প্রিংয়ের ন্যায় বাঁকানো। কোনটি সবুজ, বেগুনি, আবার কোনটি লাল, নীল, হলুদ বর্ণ ছোটায় এক্সপেরিমেন্টাল গ্লেজ মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সাগরের কাজের মধ্যে আছে বাস্তবতা। শিল্পকর্মের মধ্যে বাস্তবতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। তবে বিষয়বস্তুকে দেখার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ, উপস্থাপনা ও আঙ্গিক ভিন্ন। শিল্পকর্মে নান্দনিক অনুভবের স্বাতন্ত্র্য কাজগুলোকে পৃথক ও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, ইন্দ্রিয়ের স্বরূপ সন্ধানে, আত্মা ও সত্তার সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। অধিকাংশ শিল্পকর্ম মানুষের অবয়ব। সঙ্গে উঠে এসেছে বীজ থেকে গজানো অঙ্কুরের প্রতিরূপ। সিরামিকের গাছের সঙ্গে মানুষ যুক্ত করে তাতে পাখি বসিয়ে প্রতীকী ভাস্কর্য তৈরি করেছেন সাগর। ‘ইন টু দ্য ন্যাচার’ সিরিজের ভাস্কর্যগুলো প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের শান্তিময় বন্ধনের বয়ান দিয়ে যায়। মায়ের মাথার ওপর সন্তানের মাথা তার মাথার ওপর একটি পাখি বসা। শক্তিশালী কম্পোজিশন ভাস্কর্যটিকে ভিন্নরূপ দান করেছে। আরেকটি ভাস্কর্যে দেখা যায় প্রতিকৃতি নিচ দিকে উল্টানো। থুঁতনির ঠিক নিচে প্যাঁচানো শেকড় জাতীয় কিছু একটা। উপর দিকে সিলিন্ডারের মতো অংশে গাছের শেকড়ের বিভিন্ন অংশ। তার ওপর একটি পাখি বসে আছে। এ যেন মানুষ ও প্রকৃতির জীবন বন্দনা। রাকু গ্লেজ মাধ্যমে তৈরি বলে জমি ফাটার মতো বা পা ফেটে গেলে যেমন দেখায় তেমন মনে হয়। এই সিরিজের আরেকটি ভাস্কর্য যেন মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর কথা মনে করিয়ে দেয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে মাতৃগর্ভে একটি শিশু যেমন অবস্থায় থাকে এই ভাস্কর্যটি তেমন। মাথা বড়, গলা থেকে দেহ বেঁকে ঠিক মাথা বরাবর এসেছে। দেহটি বৃক্ষের ডাল, শাখা-প্রশাখার সঙ্গে যুক্ত। ডালের একটি অংশ প্রসারিত হয়ে শিশুটির নাক ও কপালের কাছে এসে ঠেকেছে। তার ওপর একটি পাখি বসে আছে। মাথা বরাবর বড় ডালে তিনটি পাখি বসে আছে। যেন তারা শিশুটির খেলার সঙ্গী। ভাস্কর্যটি এক্সপেরিমেন্টাল গ্লেজে তৈরি। সমকালীন শিল্পকলার প্রচলিত প্রথাগত কাঠামো ভেঙ্গে নিজেকে প্রসারিত করতে চান সাগর। তাই তো এই সময়ের শিল্পের ধারা ও প্রবণতাসমূহের ব্যাপারে কৌতূহলী। তার শিল্পীমন। ভাস্কর্যে ব্যবহার করেছেন ক্রিস্টাল গ্লেজ, ক্র্যাক গ্লেজ ও এক্সপেরিমেন্টাল গ্লেজ। এরই ধারাবাহিকতায় সাধারণ ব্যবহারিক মৃৎশিল্পের নির্মাণ না করে তৈরি করেছেন আধুনিক মৃৎ বিমূর্ত ভাস্কর্য। ক্র্যাক বা রাকু জাপানের একটি ঐতিহ্যবাহী সিরামিক গ্লেজ পদ্ধতি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পীরা। তৈজসের পাশাপাশি শিল্পকর্মে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। রাকু পদ্ধতির বিশেষত্ব হচ্ছে এর ক্র্যাক বা ভাঙ্গা ধরনের গড়ন। শীতের দিনে পা ফেটে গেলে যেমনটা দেখায় অনেকটা সে রকম খাঁজকাটা ধরনের হয় এ পদ্ধতিতে তৈরি করা ভাস্কর্যগুলো। ‘মাদার এ্যান্ড চাইল্ড’ সিরিজের প্রতিকৃতি ভাস্কর্যগুলো মায়ের ও সন্তানের চিরচেনা সেই বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেখানে নেই কোন স্বার্থ। মায়ের প্রতিকৃতির ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে সন্তানের নিষ্পাপ প্রতিকৃতি, কপালের এক পাশে। কোনটি আবার সমান্তরালে মায়ের প্রতিকৃতির সঙ্গে সন্তানের প্রতিকৃতি গলা বরাবর সংযুক্ত। ভাস্কর্যগুলো এক্সপেরিমেন্টাল গ্লেজ ও রাকু পদ্ধতিতে করা। একজন শিল্পী হিসেবে সাগর সব সময়ই তার অনুশীলনে জীবন ও সময়কে প্রকাশ করতে চান। এ জন্যই তিনি বেছে নিয়েছেন রাকু পদ্ধতির মতো নতুন এই গ্লেজ মাধ্যমটি। পাশাপাশি শিল্পকর্মের বিষয়-ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উপকরণ ব্যবহারকেও দিয়েছেন সমান গুরুত্ব। রাকু পদ্ধতিতে করা ‘ক্যাথারসিস’ সিরিজের একটি ভাস্কর্যে দেখা যায় দুটি মাথা। গলা ঢেউয়ের মতো উপর দিক বেঁকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। ভূমি বরাবর মাথা, উর্ধমুখী দৃষ্টি। যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক শান্তিময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নির্মাণের প্রয়াস। সাগর বিভিন্ন ফর্মের সঙ্গে প্রকৃতির মেলবন্ধনের বিভিন্ন ভাস্কর্যও তৈরি করেছেন। তার ভাস্কর্যগুলো বিভিন্নভাবে ভারসাম্যের বোধ, আধ্যাত্মিকতা ও মুক্ত চেতনার ধারণাকে উস্কে দেয়। অন্তর্দৃষ্টি ও প্রগাঢ় আবেগের বিস্ময়কর উদাহরণ তার এই ভাস্কর্যগুলো। সাগরের সৃষ্ট প্রকৃতি ও মস্তকগুলো মানব অবস্থার চূড়ান্ত অনুসন্ধানের ফলশ্রুতি। সংজ্ঞা থেকে নয়, কোন এক বিন্যাসে উপনীত হওয়ার ধারাবাহিকতার মধ্যে ভাস্কর্যগুলো তার জীবনশক্তি সংগ্রহ করেছে। প্রকৃতি ও মস্তকগুলো জীবন ও সহনশীলতার প্রতিশ্রুতি। পরীক্ষামূলক মানদ-ের গভীর খাঁজ ও চিহ্ন বহন করে এই ভাস্কর্যগুলো। তার ভাস্কর্যের ফাটাফাটা চিহ্নগুলো গহীন শান্তির বাতাবরণে আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। একই সঙ্গে ভাস্কর্যের নিশ্চলতা চিরস্থায়ী বন্ধন ও নীরবতার অর্ঘ্য। গ্যালারি টোয়েন্টি ওয়ানে চলছে শিল্পী অসীম হালদার সাগরের ৩য় একক সিরামিক্স ভাস্কর্য প্রদর্শনী ‘মুভিংরুটস’। প্রদর্শনী চলবে ১০ জুন পর্যন্ত।
×