ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদ রাহী

উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষা

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ৩ জুন ২০১৬

উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষা

‘কি লিখি সুতীব্র মেঘে? ভোরের উন্মুখ গান? লোকায়ত পাঠ্যক্রম, স্মৃতি ও আগামী?’ কবি কামাল চৌধুরীর লেখার সূত্র ধরেই আলোচনার গভীরে... ‘স্মৃতি ও আগামী’ মানে অতীত ভবিষ্যত। সত্তর যখন ‘বর্তমানে’ ছিল ষাট তখন ‘নিকটাতীত’। ষাটের কবিতার প্রকরণ, বির্বতন কৌশলের খুঁটিতেই সত্তরের কবিতা ছিল দ-ায়মান। কবিতায় যে আধুনিকতা, উত্তর আধুনিকতা বির্তকের সৃষ্টি তা বাংলা কবিতায় ষাটেই প্রবেশ করে। ষাটের ‘হাংরি’ শব্দটি খোলস বদলে সত্তরে ‘পোস্টমর্ডান ’শব্দে রূপ নেয়। কবিরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। উত্তরাধুনিক, আধুনিক। উত্তরাধুনিকতার কবিগণ যোগ দেন ‘হাংরি’ কবিদের দলে। আর আধুনিকতা আঁকড়ে ধরে থাকা কবিগণ হয়ে পড়েন শিকড় ও ঐতিহ্য সন্ধানী। কবি কামাল চৌধুরী তার মধ্যে অন্যতম। ২ কবিতা কি? নানা বির্বতনের মধ্য দিয়ে কবিতার অবস্থান কোথায়? কবিতা কবির শ্রম, ঘাম, মেধা খেয়ে বেড়ে উঠা নন্দগোপাল। এখনও এই যান্ত্রিক সময়ে প্রকৃত কবিতা পাঠকের গা ঘেঁষে দ-ায়মান। প্রকৃত কবিতা কি? নানা মতবাদে না গিয়ে বলব যে কবিতা পাঠকের মনোচক্ষু সিক্ত করে তাই প্রকৃত কবিতা। ক. ‘শেষরাতে আমি ও ধূসর এক স্টেশন আমি ও শালবন বিহার থেকে উঠে আসা শ্রমণের প্রার্থনার ভাষা আমি ও চা দোকানির পাশে রাতজাগা অপেক্ষার কুয়াশাবিন্দু আমি ও ঘটনাক্রম, দৃশ্যকাব্য, হুইসেলে জেগে উঠা কোলাহলপ্রবণ এক জনপদ’ খ. ‘যে চুম্বনে ধূলি-উড়াল শব্দ ছাড়া অন্য কোন বাক্য বিনিময় ছিল না সে অশ্রুত কথাগুলো শ্রুত হচ্ছে আজ পৃথিবীর হুলস্থুল ব্যর্থ কৃষ্ণচূড়ার পাশে আজ দাউ দাউ আগুন। পুড়ে যাওয়ার আগে আমরা ফের ভলেবাসব, সেখানে আমরা ফের মৃত্যুহীন শিলালিপি।’ গ. ‘কোন কোন উৎসবের দিনে আমিও অনিশ্চিত এক খোলা মাঠ আমি ও পদদলিত লতাগুল্ম আমি ও গোত্রহীন সাদা কাগজের পাখি পতনের আগে আমি ও দেখে নিতে চাই সুতো ও সম্পর্কের চতুরতা।’ আধুনিক কবিতা বিষয় প্রকরণে বটবৃক্ষের মতো। কবিতার যাত্রা একরৈখিক থেকে বহুরৈখিক। কবিতায় প্রবেশ করেছে নানা মতবাদ। প্রবেশ করেছে যাপিত জীবন ঘিরে নানা জটিলতা। ফলে, কবিতার শৈল্পিকবোধ ভাবে ভাষায় ভিন্নতর। কাহলিল জিবরান বলেছেন, ‘কবিতা একটি গান যা রক্তাক্ত ক্ষত থেকে জেগে ওঠে কিংবা হাস্যোজ্জ্বল মুখের দীপ্তি থেকে জন্ম নেয়’। তার মানে কবির যাপিত জীবনই কবিতার চারাকে দেয় ঘাম, নুন, বেড়ে উঠার আলো হাওয়া। কবি কখনও বৃদ্ধ হয় না, যতদিন তার তৃতীয় চোখ বা উপলব্ধির চোখ জেগে থাকে। ক. উদ্বিতিতে ‘শেষরাতে আমি ও ধূসর এক স্টেশন’ উচ্ছারণেই দশক উবে যায়, জেগে থাকে কবির নতুন চোখ। এই যে উপলব্ধি তাতো চলতি দশকের কবিরই উপলব্ধি। শালবন বিহার, শ্রমণের প্রার্থনার ভাষা, চা দোকানি, কুয়াশা বিন্দু, ট্রেনের হুইসেল, কোলাহলপ্রবণ জনপদ এ এক চির চেনা চির জানা কবির স্বদেশ। চেনা জানা শব্দে, শব্দের নতুন ব্যঞ্জনায় প্রিয় নিঃসঙ্গতা ঘিরে শুধু কবির মনে নয়, পাঠকের মনেও ভাললাগার রং ছড়ায়। কবিতা পাঠে মনে হয় দৃশ্যগুলো প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ নয়। কবি ছিন্নভিন্ন নয় এক ধরনের মায়াবী শিকল ছড়িয়ে শিকার করেন শব্দের নুড়ি পাথর। কবির ইন্দ্রিয়প্রবণ দরদী শব্দগুলো ও কবিতাকে করে তুলে পাঠকপ্রিয়। খ. উদ্বৃতি অস্থির সময়ের বয়ান। মানুষই মানুষের শান্তি কেড়ে নিচ্ছে। ‘ব্যর্থ কৃষ্ণচূড়ার পাশে আজ দাউ দাউ আগুন’ উচ্চারণেই ভেসে উঠে শান্তি থেকে অশান্তিমুখী জীবন। কবি ব্যর্থ কৃষ্ণচূড়া বলতে সম্ভবত পরাজিত মারখাওয়া মানুষকে বুঝিয়েছেন। কৃষ্ণচূড়া ইন্দ্রিয়ে নাড়া দেয়া চমৎকার প্রতীকাশ্রয়ী লাইনের শেষে কবি লড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। কুটিল এ সময়ে কবি পুড়ে যাওয়ার আগে ভালবাসতে চায়। ভালবেসে বাঁচাতে চায় মানুষ, সভ্যতা। তৈরি করতে চায় মৃত্যুহীন শিলালিপি। কবিতা আজ আর পাঠককে কানেক্ট করে না যারা বলেন, তাদের বিনয় করে বলি, কামাল চৌধুরী কবিতাকে করে তোলেন পেলব কোমল। তার কবিতা মানুষের যাপিত জীবনের বয়ান। তিনি কবিতাকে আনায়সে চড়াতে পারেন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে। ফলে, সত্তরের যুদ্ধ, ভাঙন, সৈরাচারী শাসনের লকলকে জিভ পেরিয়ে তার কবিতা ‘এক শান্তির জনপদ’। গ. উদ্বৃতিতে কবির উপলব্ধি বাস্তবতা থেকেই অতিবাস্তবতায় ধাবিত। তবে শব্দে, বাক্যে, উপমায় অধিবিদ্যা প্রকাশ পায়। কবিই টের পায় মানুষের ভেতরে পচন, হিংসা, ক্রোধ। ফলে, মেকি উৎসবের পাশ কেটে তিনি দেখে নিতে চান ‘সুতো ও সম্পকের চতুরতা’। পাঠক ও টের পান চরম সত্যের পৃথিবীতে প্রেম (সুতো যদি রূপকার্থে প্রেম হয়) ও মায়া দুটোই পতনমুখী। তিনি আরেকটি কবিতায় লিখেছেন, ‘ভাঁড় ও চতুর ঘুঘু গভীর প্রণয়ে লিপ্ত’ কবি মানুষের হাতে পরাজিত হয়েও মানুষের পাশে থাকতে চায়। ভুলে যেতে চায় মানুষের দেয়া কষ্ট। তাই তিনি একই কবিতায় লিখেছেন, ‘ততবার সত্য হয়ে উঠে নিঃসঙ্গতা একাকী লড়াই’। ৩. কবিতার নানা অনুষঙ্গ। আধুনিক কবিতা আরও বেশি পেলবতা, আরও বেশি নান্দনিকতায় ভরা। কবিতায় বোধ, ভাবনা ঘিরে যে দর্শন লুকায়িত থাকে তা কবিতাকে পাঠকপ্রিয়ই করে তোলে। কামাল চৌধুরী কবিতায় নানা ব্যঞ্জনায় দর্শন ছড়িয়ে রাখেন। যা তার পাঠকমাত্রই ওয়াকিবহাল। ক. ভালবাসার মতো একটা দেশ আছে খ. ভালবাসা মৃত মাছি গ. প্রতিটি হারানো দৃশ্যে অশ্রুময় অন্বেষণ থাকে ঘ. আমি ও সত্যজল, নদীশব্দ, রবীন্দ্রসঙ্গীত ঙ. আমাদের গন্তব্য পথে আজ দূরবীক্ষণের চতুরতা চ. যে সমুদ্রের দিকে যাবে তার জন্য ঝাউগাছ অসীম নন্দনতত্ত্ব কবিতায় দর্শন কতভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। কত বির্বতন বিনির্মাণ কবিতার বোধে ভাবনায়। কামাল চৌধুরীর কবিতায় দর্শন অভিজ্ঞতার এক নান্দনিক ভুবন। তিনি অভিজ্ঞতাকে বেধেছেন আধুনিকভাবে ভাষায়। ‘প্রতিটি হারানো দৃশ্যে অশ্রুময় অন্বেষণ থাকে’ পাঠককে ভাবিয়ে তোলে। যুদ্ধ, ভাঙন, প্রিয়জনের মৃত্যু প্রতিটি দৃশ্যের শেষেই বেদনা। কবি সহজ-সরলভাবে সমষ্টিগত ভাবনাকে কবিতায় গেঁথেছেন। ‘আমি সত্যজল, নদীশব্দ, রবীন্দ্রসঙ্গীত’ সত্যজল যদি সততা আদর্শের অহঙ্কার ধরি, নদীশব্দ যদি ধরি সফলভাবে বেঁচে থাকা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত যদি ঐতিহ্য, শিকড় ভাবি তাহলে কবিতার দর্শনে জেগে থাকে এক জীবন। ‘যে সমুদ্রের দিকে যাবে তার জন্য ঝাউগাছ অসীম নন্দনতত্ত্ব’ কবিতা প্রজাপতির মতো। যতই ব্যবচ্ছেদ হোক রঙ থেকে যায়। সেই রঙ হলো কবিতার ভাললাগা। তত্ত্ব, তথ্য, রসের রঙ। যা পাঠকের মনে প্রশান্তি ডেকে আনে। সমুদ্র-কোলাহল ঢেউ, মানুষের অবচেতন মনের হাহাকার। সেই হাহাকারে ঝাউগাছ সবুজের প্রতীক। অসাধারণ, কামাল চৌধুরীর বোধের জগত। অপরিচিত ভুবনকে পরিচিত এবং নান্দনিক করে গড়ে তোলার মুন্সিয়ানা। কবিতায় বস্তুজগত মায়াজগতের যে মেলবন্ধন, ভাবের যে বাসনা তা কামাল চৌধুরী পরিপূর্ণভাবে ফুটে তুলেছেনÑ প্রজ্ঞা আর বোধের আরকে। ৪. কবি কবিতার রাজ্যে স্বাধীন। প্রত্যেক কবিরই থাকে নিজস্ব জগত। কবির সতন্ত্র কবিকে দেন আলাদা মর্যাদা ও পাঠকপ্রিয়তা। কামাল চৌধুরীর কবিতায় কতিপয় বৈশিষ্ট : ক. শব্দের নতুন ব্যঞ্জনা খ. কবিতায় সবসময় প্রকৃতির কোল ঘেষা গ. পরিচিত চিত্রকল্পের সঙ্গে পরিচিত উপমার মেলবন্ধন ঘ. কবিতায় স্বভাবজাত দর্শন (তবে বোধের আরকে, প্রজ্ঞার গভীরে) ঙ. অভিজ্ঞতার নান্দনিক উপস্থাপন চ. কবিতা ঐতিহ্য ও শিকড় সন্ধানী ছ. বাস্তবতা পরাবাস্তবতার শৈল্পিকবয়ান ফলে কবির ভাষা ও পাঠকের ভাবনা সমধর্মী হয়ে উঠে। ৫. কবিতায় নানা চিত্রকল্প। সহজ, জটিল, উপমানির্ভর। চিত্রকল্প কবিতার জনপ্রিয়তাকে উসকে দেয়। উপমানির্ভর চিত্রকল্প আরও বেশি নান্দনিক। চিত্রকল্প সমন্ধে এজরা পাউন্ড বলেছেন, ‘বুদ্ধি ও আবেগগত জটিলতা এক নিমেষে যাতে উপস্থাপিত হয় তাই চিত্রকল্প। ক. আমার নেশার ঘোরে বেদেনির মতো চাঁদ ওঠে খ. অতিথি পাখির মতো তবু দূর অভিজ্ঞতা গ. শোকার্ত হায়েনাদের করুণ ও ক্রুদ্ধ চোখের মতো ভোর ঘ. বিধাতার মতো একা ভিজে যাব বলে ঙ. মাতালের মতো চিৎকার করে উঠছে পাথর তোলার শব্দ তার কবিতায় চিত্রকল্প আধুনিকতার ধারঘেঁষেই। ‘বেদেনির মতো চাঁদ’ অন্যরকম নিঃশব্দে ভাললাগা, মনকে মাতাল করে তোলে। ‘শোকার্ত হায়েনাদের করুণ ও ক্রুদ্ধ চোখের মতো ভোর’ আমাদের কে একটা অসুখী ভোরে দাঁড় করিয়ে দেয়, হয় তো সেটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত কোন দেশ। যেখানে ভোর আসে চিড়িয়াখানা জন্তুর বেশে। ‘বিধাতার মতো একা’ এ যান্তিক সময়ে সব মানুষই নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গ আর একাকে কামাল চৌধুরী অভিজ্ঞতা প্রজ্ঞায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘মাতালের মতো চিৎকার করে উঠছে পাথর তোলার শব্দ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখে ভেসে উঠে শ্রমিকের জীবন ধারা। ৬. কবিতার বড় গুণ পাঠককে তৃপ্তি দান করা। ভাবে ভাষায়, শব্দে পাঠককে জাগিয়ে রাখা। কামাল চৌধুরী সেই বিচারে সফল ও স্বার্থক। তার কবিতা মানুষের যাপিত জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে বৃহত্তর ক্যানভাসে তুলে ধরেন।
×