ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তৌফিক অপু

নাচ তখন, নাচ এখন

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ৩ জুন ২০১৬

নাচ তখন, নাচ এখন

কিছুদিন আগে প্রতœতাত্ত্বিক ওয়েবসাইট ‘প্যালিওলিথিক’-এ একটি ছবি পোস্ট করা মাত্র বেশ হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। ছবিটি যে অনেক পুরনো তা নিয়ে সন্দেহ নেই, তবে কতটা পুরনো তা বুঝতে এর সঙ্গে দেয়া ডাটাগুলো বেশ ভাল করে পড়তে হয়েছে। ছবিটি প্রস্তর যুগের অর্থাৎ পাথর যুগের। ছবিটিতে পাথরে খোদাই করা রয়েছে বেশ কিছু মানুষের অঙ্গভঙ্গির ছবি। দেখে মনে হবে কিছু মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর কিছু মানুষ এর মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গ-ভঙ্গির মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করছে। বিষয়টা এমন, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দর্শকগুলো মনোযোগের সঙ্গে নাচ দেখছে। এ পাথর খ-টি আবিষ্কৃৃত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই। ছবিটা যতটা অবাক করেছে তারচেয়ে বেশি অবাক হতে হয়েছে প্রাপ্ত ডাটা দেখে। এই নিদর্শন নাকি খ্রিস্টপূর্ব নয় হাজার বছর আগের। তার মানে দাঁড়ায় পাথর যুগের সময়কাল। আর তাই যদি হয় তাহলে এতদিন ধরে চলে আসা নাচ সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করা হয়া তা অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়বে। কারণ এখন পর্যন্ত ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব তিন শ’ শতকের সময়কালে উদ্ভব ঘটে নাচের। কিন্তু নয় হাজার বছর পূর্বের এ দলিল নাচের উদ্ভবের ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। যদিও চূড়ান্ত নিরীক্ষার ফলাফল বাকি রয়েছে। তবে এ কথা সত্যি মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম পন্থা ‘নাচ’-এর উদ্ভব যে বহু আগের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নাচ আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িত। নাচ নিয়ে আমরা রীতিমতো গর্ব করি। বিশ্বের দরবারে বহুবার নাচ দিয়ে মাত করে আসার রেকর্ড আমাদের আছে। সংস্কৃতিমনা আমাদের এ জাতি নিজস্ব সংস্কৃতির পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। এই তো সেদিন ওয়াল্ড ড্যান্স কম্পিটিশনে ‘নেইল ডি মারকো’ ড্যান্স উইথ স্টার সেগমেন্টে ‘দ্য মিরর বল’ অর্জন করেন। নেইল মারকো দীর্ঘদিন ধরে মডার্ন ড্যান্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে এত বড় অর্জন এবারই প্রথম। সে যে আরও অনেকদূর এগিয়ে যাবে এ নিয়ে তর্ক নেই। কারণ ইতোমধ্যে মিডিয়ার পাদপ্রদীপে চলে এসেছেন। উচ্ছ্বসিত মারকো সেই মঞ্চে পুরস্কার হাতে নিয়ে বলেছেন নাচের নানা বিষয়ের কথা, অধ্যবসায় ও অনুশীলনের কথা। তবে শেষ যে কথাটি বলেছেন তা অনেকেরই মন ছুঁয়ে যায়। তিনি জানান, নাচের অনেক শাখায় বিচরণ করেও এশিয়ার মহাদেশে যে ধরনের নাচ প্রবর্তিত তা এখনও শেখা হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের নাচ। অথচ নাচের অনেক বড় একটা সৌন্দর্য এখানে লুকায়িত। আর তাই এ নাচ না শেখা পর্যন্ত নিজেকে পরিপূর্ণ নৃত্যশিল্পী দাবি করা ঠিক হবে না।’ মঞ্চে দাঁড়িয়ে নাচ সম্পর্কে এত বড় কমিপ্লিমেন্ট হয়ত মারকোর মুখেই শোভা পায়। সময়ের ক্রমবিবর্তনে পৃথিবীর নানা দেশে আধুনিক ও সমকালীন নাচের চর্চা রয়েছে। নাচ প্রধানত সম্মেলক সৃষ্টি, শুরুর দিকে এতে সুনির্দিষ্ট কোন ব্যাকরণ মানা হয়নি। যে যখন যার মতো করে বিভিন্ন নাচের মুদ্রা সমন্বয় করে একটি পূর্ণাঙ্গ নাচের আবির্ভাব ঘটান। নাচ এমন একটাই শিল্প যার জন্য কোন ভাষার প্রয়োজন হয় না। কেননা নাচ এবং ভাষা কাজ করে এক সূত্রে। নাচের মুদ্রাগুলো যেন নিজের মনের ভাবকেই প্রকাশ করে। নাচের বিবর্তনকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, প্রাচীন বাংলার নাট্য ও সাহিত্যে নাচ, মধ্যযুগে বাংলার নাচ, ঔপনিবেশিক সময়ের নাচ এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের নৃত্যচর্চা। আমাদের সংস্কৃতিতে ঠিক কবে থেকে নাচের আবির্ভাব ঘটেছে তা সুস্পষ্ট নয়। উপমহাদেশে, সিন্ধু সভ্যতার প্রধান নিদর্শন হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো। এ দুটি সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত মূর্তি, মাটির পুতুল, মাটির ছাপের জন্তু-জানোয়ার আঁকা সিলসহ বেণু, বীণা ও মৃদঙ্গের ব্যবহার প্রমাণ করে সে সময়কার নাচের প্যাটার্ন। মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত তামার তৈরি নৃত্যরত নারী-মূর্তি উপমহাদেশীয় নৃত্যকলার প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে। বৈদিক আর্যযুগে রচিত ‘ঋকবেদ’ (সবচেয়ে প্রাচীন), ‘যযুর্বেদ’, ‘সামবেদ’ ও ‘অথর্ব্যবেদ’-এ নৃত্যের প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়। তবে ধারণা করা হয় রাজদরবার থেকেই নাচের আধুনিকায়ন শুরু। তবে নাচের রয়েছে শক্তিশালী ভিত রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। অল্পতেই যে একে ধারণ করা যাবে এ চিন্তা করা মানেই বোকার স্বর্গে বাস করা। ভারতীয় উপমহাদেশে চারটি ঘরানার নাচ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, ১. ভরতনাট্যম ২. কত্থক ৩. কথাকলি ও ৪. মণিপুরী। ভরতনাট্যম ভরতনাট্যম ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা বিশেষ। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে এ নৃত্যকলার উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রধান চারটি ধারার একটি। বাকি তিনটি হচ্ছে কত্থক, কথাকলি, মণিপুরী। ভরতমুনির লেখা নাট্য শাস্ত্র গ্রন্থে ভরতনাট্যম নাচের বর্ণনা রয়েছে। মহাদেব শিবকে এই নৃত্যশৈলীর ভগবান মানা হয়। আজ ভরতনাট্যম বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় নৃত্যশৈলী। কত্থক এই নৃত্যের ফর্ম প্রাচীন উত্তর ভারতের যাযাবর সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত। কত্থক শাস্ত্রীয় নৃত্যের একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ধারা। সব রকমের শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে কত্থক সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রাচীনকালে বিভিন্ন দেব-দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনায় কয়েকটি সম্প্রদায় ছিল যারা নৃত্য ও গীত দিয়ে দেব-দেবীর মাহাত্ম্যাবলী বা গুণকীর্তন পরিবেশন করত। এসব সম্প্রদায়গুলো হচ্ছে কথক, গ্রন্থিক, পাঠক ইত্যাদি ইত্যাদি। সব ক’টির মধ্যে থেকে কথক একটি বিশেষ স্থান আজও অধিকার করে রয়েছে। কথক নৃত্যে প্রধানত রাধা কৃষ্ণের লীলা কাহিনীই রূপায়িত হতো। মুঘল আমলে দরবারী সঙ্গীত ও নৃত্যের যুগ সূচিত হলেই কথক নৃত্যের একটি সুসংহত রূপ গড়ে ওঠে। কথক নৃত্যের সবচেয়ে বেশি বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে লাখনৌর আসাফুদ্দৌলা ও ওয়াজীদ আলী শাহ এর দরবারকে কেন্দ্র করে। কথকের দ্বিতীয় ধারার বিকাশ ঘটে জয়পুুর রাজদরবারে। পরবর্তীতে বারাণসীতেও কথক নৃত্যের বিস্তার ঘটে। নৃত্যই কথকের প্রাণ তবে সহযোগী সঙ্গীতও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মণিপুরী সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম দিক হলো মণিপুরী নৃত্য যা ভারতবর্ষের অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা যেমন কত্থক, ভরতনাট্যম, কথাকলি ইত্যাদির সমপর্যায়ের। মণিপুরী নাচের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হলো রাধাকৃষ্ণের প্রেম অবলম্বনে গোপ-গোপীদের রাসনৃত্য। মণিপুরীদের অন্যান্য ধ্রুপদী নৃত্য ধারার মধ্যে রয়েছে গোষ্ঠলীলা, পুঞ্চলোম, খুবাকইসেই, উদুখল ইত্যাদি। লোকনৃত্যের মধ্যে লাই-হারাওবা, খাম্বা-থইবী, মাইবী-জগোই ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বৈষ্ণব পদাবলি, পালাকীর্ত্তন, ভজন ও আরতির সুর ও সঙ্গীত মণিপুরী সঙ্গীত এবং নৃত্যকলার অন্যতম দিক। ১৯১৯ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গ্রাম মাছিমপুরে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের পরিবেশিত রাসনৃত্য দেখে বিমোহিত হন এবং শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য প্রবর্তন করেন। বিশ্বময় মণিপুরী নৃত্যের এই প্রচার, প্রসার ও সুখ্যাতি পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের সিলেট জেলার নিভৃত পল্লী মাছিমপুরের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী রমণীদের অসামান্য ও অনবদ্য ভূমিকা। কথাকলি ভারতের কেরালায় কথাকলি নাচের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। সাবলীল নাচ হিসেবে কথাকলি নাচের সুখ্যাতি রয়েছে। নাচের এ সংগ্রহই আমাদের করেছে আরও বেশি সমৃদ্ধ। আমাদের দেশে এখনও এর চর্চা অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতাত্তোর এদেশে নাচের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ঠিক সে সময় থেকেই এদেশের নাচ বিশ্বের দরবারে নিজের একটি জায়গা করে নেয়। ক্লাসিক্যাল নাচের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি উত্তরণ ঘটে গীতি নৃত্যনাট্য এবং ফোক ড্যান্সের। এ দুটি নাচ নিয়ে এদেশের শিল্পীরা বহুবার বিদেশে গিয়ে সুনাম কুড়িয়ে এনেছে। এক্ষেত্রে নৃত্যশিল্পী জি এ মান্নান, রাহিজা খানম ঝুনু, রওশন জামিল, মিনু হক, জিনাত বরকতউল্লাহ, মুনমুন আহমেদ, শামীম আরা নীপা, শিবলী মোহাম্মদ এর স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের নৃত্যের ভিত মূলত এদের হাত দিয়েই তৈরি হয়। বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় অনেক নৃত্যশিল্পী তাদের হাতে তৈরি। তবে নাচের প্রশিক্ষণের যে ভাবগাম্ভীর্যতা ছিল সেটা নাকি অনেকটাই ম্লান। আগে গানের লাইন ধরে নাচের মুদ্রা তৈরি করা হতো সবাই মিলে যতক্ষণ পর্যন্ত না নাচের মহড়া শেষ করছে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত চলত রিহার্সেল। ক্ল্যাসিক্যাল নাচের ক্ষেত্রে কিংবা গীতি নৃত্যনাট্যের জন্য একই বিষয় প্রযোজ্য ছিল। এ কারণের উল্লিখিত গুণী নৃত্য শিক্ষকদের হাত ধরে উঠে এসেছে চমকপ্রদ নাচ। বর্তমান সময়ের নৃত্যের রূপরেখা আমাদের দেশে নাচ এখনও জনপ্রিয় হলেও নাচে কেন সেলিব্রেটি তৈরি হচ্ছে না এ নিয়ে বেশ চিন্তিত ও মর্মাহত এদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ এবং নৃত্য বিশেষজ্ঞ কামাল লোহানী। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, বর্তমানে নাচের নাকি ক্রান্তিকাল চলছে। এ কারণও অবশ্য তিনি আবিষ্কার করেছেন। তিনি জানান, স্বাধীনতাত্তোর এবং পরবর্তী সময়ে অনেক চড়াই উৎরাই পারি দিতে হয়েছে এ দেশকে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দাঙ্গাসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে বহুবার। আঘাত হানা হয়েছে কৃষ্টিকালচারের ওপর। এতকিছুর পরেও এক মুহূর্তের জন্য থেমে থাকেনি সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা। যতটা বাধা এসেছে তার চেয়েও বীরদর্পে এগিয়ে গিয়েছে সংস্কৃতি অঙ্গন। প্রতিবার সাহসী ভূমিকা পালন করেছে সংস্কৃতি কর্মীরা। যার ফলাফলও হাতে হাতে পেয়েছি আমরা। দুর্দান্ত সব সৃষ্টির দেখা মিলেছিল সে সময়ে কি গান, কি নাটকে কি নৃত্যে। সবই যেন এক সুতোয় ঝনঝনিয়ে বাজত। আর সে সুরে অসুরের দেখা মেলাই ছিল দায়। প্রতিবারই জয়ী হয়েছি আমরা। আমার লেখা বই ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং নৃত্য শিল্পের বিস্তার’ এ বার বারই উঠে এসেছে এসব ঐতিহ্যবাহী ঘটনার কথা। নৃত্যে সে সময় যেন বিপ্লব ঘটেছিল। বিশেষ করে হুদা সাহেব যখন বুলবুল ললিতকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলেন সে সময় থেকে। সে সময়ের গীতি নাট্যের জোয়ার নাচের সংজ্ঞাই যেন পাল্টে দিতে লাগল। নাটক সিনেমার চেয়েও জনপ্রিয় হতে লাগল গীতিনৃত্য নাট্যগুলো। ঊনষাটে নক্সীকাথার মাঠ দিয়ে আমার শুরু। একষট্টিতে রবীন্দ্রনাথের ১০০ তম জন্মজয়ন্তীতে শ্যামা ও চিত্রঙ্গদা তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো। মানুষের ঢল ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্ল্যাসিক, ফোক কিংবা ভরত নাট্যম নাচের বাইরে নাটকের মতো করে নাচ হতে পারে তা দেখে অনেকেই বিমোহিত ছিল। প্রচুর অনুরোধ ছিল গীতিনাট্যগুলো বার বার অনুষ্ঠিত করার। করলামও, কারণ সে সময়েও স্পন্সর মিলেছিল। কিন্তু আফসোস আজ নাচের অনুষ্ঠানের জন্য পৃষ্ঠপোষক মেলা ভার। নাচ যেন বর্তমান সময়ে উল্টো পথে হাঁটছে। আর এদিকটায় যেন কারও কোন মাথাব্যথা নেই। বিশেষ করে নাচে হিরো হিরোইন নেই। নেই কোন সেলিব্রেটি। শেষমেশ নীপা-শিবলির নামের পর জনপ্রিয় কোন নাম সেভাবে কানে আসেনি। সত্যিকার অর্থে বর্তমান ছেলেমেয়েদের ধৈর্য শক্তি কমে গেছে। খুঁজছে শর্টকাট সিস্টেম, ঝুঁকছে কমার্শিয়াল নাচে যা আদৌ নাচের কোন্ পর্যায়ে পরে তা আমার জানা নেই। ওগুলো নাচের গ্রামার মেইটেইন করে বলেও মনে হয় না। তবে নাচ শিখতে হলে তো বেসিকটা জানতে হবে। এটা কেন বর্তমান প্রজন্ম বুঝতে চাইছে না। আর এ কারণেই হয়ত আমাদের নাচের এখন করুণ দশা চলছে। আর নাম জানা এবং অজানা নাচের প্রতিষ্ঠানগুলোও যেন একেকটা দোকান হয়ে গেছে। কোন কোয়ালিটি তারা মেইটেইন করছে না। রাখছে না ভাল মানের শিক্ষক। মোটকথা ভাল কাজে খরচ না করে শুধু লুটেপুটে খাওয়া বা সংস্কৃতি বিক্রির পাঁয়তারা। এর জন্য অনেকটাই আমি দায়ী করব বর্তমান সময়ের নৃত্য শিক্ষক ও গবেষকদের। তারা তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে সিনসিয়ারলি কাজটা করছে না। আমার এখনও মনে হাতে পায়ে জোর থাকলে আবার বাংলার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দৌড়ে নাচের এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতাম। এখন তো মানুষজন কথাও শুনতে চায় না। তাই বলে কোন লাভও হচ্ছে না। তবে নৃত্যের উত্তরণ আবশ্যম্ভাবী। বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী, নৃত্যগুরু মাতা উপাধি প্রাপ্ত রাহিজা খানম ঝুনু। নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই যিনি নিজেই একজন নাচের প্রতিষ্ঠান। সেই ষাট দশকের ঢাকা প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে তিনি জানান, সে সময় মুসলিম ঘরের মেয়েরা বাইরে বেরুলেও রিক্সা কিংবা ঘোড়ার গাড়ি পর্দা দিয়ে ঢেকে নিয়ে বের হতো। আর এর কোন ব্যত্যয় ঘটলে সেই মেয়ের কপালে জুটত নানা তিরস্কার। এত বন্দী করে রাখার অন্যতম কৌশল। আর নাচ গান সে তো যেন আকাশ কুসুম কল্পনা। আর এসব বাধ্যবাধকতার কারণেই তখনকার সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের রোল ছেলেদের দিয়েই করানো হতো। অর্থাৎ ছেলেদের মেয়ে সাজিয়ে। সেই বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে আমরা যখন নাচ করতে এলাম অনেক বঞ্চনাই আমাদের সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু কখনই নিজের লক্ষ্য থেকে পিছপা হয়নি। ভালবেসেছি নাচকে আর এ নিয়েই জীবনটা পার করে দিলাম। কি প্রাপ্তি কি অর্জন কখনই তা মাথায় ছিল না। তবে দুঃখ একটাই এত সুন্দর একটা শিল্প হুট করেই যেন উল্টো পথে হাঁটছে। অর্থাৎ শিল্পের সেবা নয় লোক দেখানো। অনেক চেষ্টা এখনও করে যাচ্ছি কিন্তু বর্তমান প্রজন্মে লৌকিকতার টান কমাতেই পারছি না। বুঝে উঠতেই পারছি না কেন তারা এত শর্টকাট খুঁজছে। এভাবে শিল্পী তৈরি হয় না। দু’একজন যে ভাল করছে না তা নয় তবে তা সংখ্যায় এতটাই কম যে উদাহরণ হিসেবে টানা যাচ্ছে না। নাচ সহজ কোন বিষয় নয়। গান গেয়ে কিংবা সুর দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা হয় না সম্পূর্ণ দেহভঙ্গি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় দৃশ্যপট। আর এ ভাব ফুটিয়ে তোলা সহজসাধ্য বিষয় না, প্রয়োজন সঠিক শিক্ষার ও অধ্যবসায়ের। বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েরা এ জায়গাটায় এসে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলছে। অনেক চেষ্টা করেও তাদের অস্থিরতা কাটছে না। সবাই শর্টকাট খুঁজছে। যা মোটেও কাম্য নয়। নৃত্য একাডেমি দীর্ঘদিন ধরে নাচের একাডেমিগুলো নাচের শিল্পী তৈরি করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। এর মধ্যে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, ছায়ানট, নৃত্যাঞ্চল অন্যতম। এছাড়াও বেশ কিছু একাডেমি রয়েছে যারা নাচকে প্রাধান্য দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের শিল্পকর্ম। কিছু কিছু খ্যাতনামা শিক্ষক ব্যক্তিগত প্রয়াসে চালিয়ে যাচ্ছেন নাচের শিল্পী তৈরি করার কাজ। সবারই উদ্দেশ্য একটাই ভার নৃত্যশিল্পী বের করে আনা। এদেশের নৃত্যের প্রসারে এদের ভূমিকা তাই অনস্বীকার্য। প্রচুর ছেলে মেয়ে নাচ শিখতেও আসছে তবে একাডেমিগুলোর অভিযোগ কেউই দীর্ঘ সময় নিয়ে নাচটা শিখছে না। যখনই কোন শিল্পীর টার্নিং পয়েন্ট চলে আসে তখনই কোন না কোন সমস্যা কিংবা অনাগ্রহ নিয়ে সরে পড়ছে। যার ফলে বিকশিত হচ্ছে নাচের আসল সৌন্দর্য। একটা সময় একাডেমি কেন্দ্রিক নাচের অনেক অনুষ্ঠান হতো। স্পন্সরদের অনাগ্রহ সে অনুষ্ঠানগুলোতে বাদ সাধছে। সবাই কেমন যেন শুধু বাড়তি চমকের আশা করছে। কেউ বুঝতে চাইছে না শিল্পের প্রকৃত সেবার নিয়োজিত থাকলে এই চমকগুলো একে একে ধরা দেবে। তবেই তো তৈরি হবে গুণী শিল্পী। শুধু চোখ ধাঁধানো শো শা তে পড়ে থাকলে শিল্পের শুধু বিনাশই হবে উন্নতি নয়। একাডেমিতে অনেক অভিভাবক আছেন যারা শিক্ষকদের চাপ দেন তার ছেলে বা মেয়ে যেন দ্রুত চ্যানেলে মুখ দেখাতে পারে। অভিভাবকরা বুঝতে চাইছে না তাদের শিক্ষার্থী আদতে কতটুকু প্রস্তুত। যদি তাদের ইচ্ছার ব্যত্যয় ঘটে তখনই তারা তাদের শিক্ষার্থীদের একাডেমি থেকে প্রত্যাহার করে টিভি চ্যানেলের কোন প্রোগ্রাম প্রডিউসারের পেছনে সময়ক্ষেপণ করেন। যা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক। একাডেমিগুলোর যেন চেয়ে দেখা ছাড়া কোন উপায় মিলছে না। এ অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে প্রকৃত নৃত্যশিল্পী বের করে আনা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। মানতে হবে নৃত্যের ধারা ঐতিহ্যের এ ধারক আজ যেন অনেকেই বহন করতে পারছে না বা বহন করতে চাইছে না। এ নিয়ে আমাদের দেশে সৃষ্ট মতবাদ আজ পীড়া দেয়। প্রকৃত নৃত্যে চর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে। শিখতে হবে মন দিয়ে। এখনও প্রচুর ওয়ার্কশপ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে। তবে কমছে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা। যাও বা অংশ নেয় পুরো কোর্স করার ধৈর্য থাকে না। অথচ কোন চ্যানেলে অডিশনের নাম শুনলেই লেগে যায় লম্বা লাইন। বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী ফারহানা চৌধুরী বেবী বলেন, বর্তমান সময়ে নাচের জন্য দেখি না কাউকে মরিয়া হয়ে উঠতে। আমরা তো উঠতে বসতে নাচকে ধ্যানে জ্ঞানে মেনে চলতাম। এছাড়া অন্যকিছু কল্পনাতেও আনতাম না। তেমন ডেডিকেশন বর্তমান প্রজন্মে দেখা যায় না। যে কারণে নাচ থেকে কোন স্টার তৈরি হচ্ছে না। তৈরি হচ্ছে না নাচের জন্য ভাল কোন অনুষ্ঠান। স্পন্সর পাওয়াই দুষ্কর। মেয়েরা বিশেষ করে কিছুদিন নাচে আসে তারপরেই তারা ঝুঁকে যায় নাটক মডেলিং এ। পুরো কোর্স তাদের আর করা হয়ে ওঠে না। তাহলে তারা পরবর্তী প্রজন্মে কি শেখাবে। অথচ এদের অনেকেই আজ নৃত্য শিক্ষক সেজে বসে আছে। টিভি চ্যানেলগুলো নাচের অনুষ্ঠান নামাচ্ছে। যে কারণে টিভিতে নাচের অনুষ্ঠান দেখে দর্শক কোন মজা পাচ্ছে না। সবাই শুধু শর্টকাটে তারকা হতে চায় পয়সা উপার্জন করতে চায়। নাচের অনুষ্ঠানের জন্য যাদের সিলেক্ট করা হয় তাদের রিহার্সেলে ঠিকমতো পাওয়া যায় না। ধৈর্য বলতেই নেই। অন্যদিকে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা যে কোন অনুষ্ঠানে নাচের একটি পার্ট রাখে কিন্তু নাচটি নামানোর জন্য পর্যাপ্ত পয়সা দিতে চায় না। এরা বুঝতে চায় না একটি নাচে যে কত খরচ। সর্বোপরি পেট্রোনাইজটা খুব বেশি জরুরী। তাহলে এখনও যারা রয়েছেন নাচের রোল মডেল হিসেবে তারা হয়তো আরও ভাল কিছু উপহার দিয়ে যেতে পারবেন। একা একা পেরে ওঠা যায় না। এ প্রসঙ্গের রেশ ধরে বুলবুল ললিতকলা একাডেমির নৃত্যের শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বাবু বলেন, কেন জানি এখনকার ছেলেমেয়েরা নাচ শেখার চেয়ে চ্যানেলে মুখ দেখাতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। এ ধরনের চিন্তা চেতনা তাদের সুকুমারবৃত্তি অঙ্কুরেই নষ্ট করে ফেলছে। আবার অনেকে আসে এক বছর কোর্স করতে, কারণ হিসেবে জানা গেছে চ্যানেল বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নাচের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য কিছুটা শিখে যাওয়া। তাদের ভাষ্যমতে নাচের কিছু মুদ্রা দেখাতে পারলেই হলো। তাতেই হয়ে যাবে। আর বর্তমান সময়ে শরীরচর্চার মতো কিছু নাচ একেবারেই গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। না ওগুলো ব্রেক ড্যান্স হয় না মডার্ন। মজার বিষয় হলো শাস্ত্রীয় নাচের শর্টকাট খুঁজে। তাহলে কিভাবে সম্ভব নাচকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন ঘর থেকে প্রকৃত সংস্কৃতির শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠা। তবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মর্যাদা বুঝতে পারবে। আর যে বুঝতে পারবে সে কখনই শর্টকাট খুঁজবে না। না জেনে কোন কাজই করা উচিত নয়। অথচ দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি আমাদের দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় না জানা লোকজনগুলো ফাঁকা হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছে। আদতে দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছি শিল্প সংস্কৃতি থেকে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কখনই নাচের একজন রাহিজা খানম ঝুনু, শামীম আরা নীপা কিংবা শিবলী মোহাম্মদ তৈরি হবে না। প্রয়োজন উত্তরণ এখন পর্যন্ত এদেশের শিল্প সংস্কৃতির অন্যতম ধারক নাচ। সম্ভাবনাও রয়েছে প্রচুর। তবে প্রয়োজন কিছু সৃজনশীল পদক্ষেপের। তাহলে এ শিল্পকে অন্যতম একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
×