ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

হাঁটুর আঘাত সারবে হাড়ের শব্দে

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৩ জুন ২০১৬

হাঁটুর আঘাত সারবে হাড়ের শব্দে

হাঁটুর আঘাত খুব যন্ত্রণাদায়ক। আঘাতের কারণে হাঁটু থেকে যেসব শব্দ বেরিয়ে আসে তাতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। তবে সেই কটমট, মচমচ শব্দগুলোরই এখন ডাক্তারদের হাঁটু সন্ধির ক্ষতি কতটুকু হয়েছে, আঘাত কত দ্রুত সেরে উঠছে এবং আরও কতখানি চিকিৎসার প্রয়োজন আছে তা নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষকরা এমন এক বিশেষ ব্যান্ড উদ্ভাবন করছে যা মাইক্রোফোন ও ভাইব্রেশন সেন্সরকে কাজে লাগিয়ে হাঁটুসন্ধির ভেতরকার শব্দ শুনতে ও পরিমাপ করতে পারে। তাঁরা আশা করেন যে, এ থেকে আগামীতে এমন ডিভাইস বের করা যাবে, যা হাঁটুর আঘাতের পর ক্ষতির মাত্রা নির্ণয় করবে। এমনকি আঘাত সেরে ওঠার অগ্রগতি বুঝতেও অর্থপেডিক বিশেষজ্ঞদের সাহায্য করবে। আপাতত যে ডিভাইসটি বেরিয়েছে সেটাই বা কম কিসের। আপনার আঘাতপ্রাপ্ত হাঁটুতে ডাক্তাররা একটা শ্রবণ যন্ত্র ফিতা দিয়ে বেঁধে দেবেন। তারপর শোনা যাবে নানা ধরনের শব্দÑ চড়চড়, মচমচ, পটপট, খটমট। অদ্ভুত ও বিচিত্র। হাঁটু ভাঁজ করলেই এমন সব শব্দ উঠবে। আর সেই বিচিত্র শব্দাবলীই চিকিৎসার কাজে ডাক্তারদের সাহায্য করবে। ডিভাইসটি কিভাবে বেরোলো সে প্রসঙ্গে যেতে গেলে ওমের ইলানের কথা এসে যায়। নিজে হাঁটুর ব্যথায় ভুগছিলেন। সেই দুর্ভোগ থেকেই কিছুদিন ধরে এমন এক ডিভাইস বের করার কথা ভাবছিলেন। পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এই সহকারী অধ্যাপক এক সময় ছিলেন ডিসকাস থ্রোয়ার। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিসকাসে রেকর্ডধারীও ছিলেন। বছরের পর বছর চতুর্দিকে তিনি টর্নেডোর মতো ছুটে বেড়িয়েছেন। সেই ধকল বইবার মতো হাঁটুজোড়া তার ছিল না। তার ওপর যোগ হয়েছিল ওয়েট ট্রেনিংয়ের বাড়তি ধকল ও চাপ। ট্রেনিংয়ে পাঁচ শ’ পাউন্ড ওজন নিয়ে উঁচু হয়ে বসতে হতো। ইনান বলেন যত বেশি চাপ দিতাম হাঁটুটা তত বেশি কটকট বা মচমচ করে উঠত। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স এডভান্সড্্ রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (ডারপা) পুনর্বাসনের সহায়ক পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির ওপর গবেষণামূলক প্রস্তাব পেশের আহ্বান জানালে স্কুল অব ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনানের ধারণাটি গ্রহণ করে। প্রথমদিকের গবেষণায় ইনান যখন তাঁর নি-ব্যান্ডের খটখটে মড়মড়ে আওয়াজের প্রথম রেকর্ডিং শুনলেন তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন। কারণ এই প্রথম কেউ তার নিজের হাড়ে হাড়ের কিংবা হাড়ের সঙ্গে কোমলাস্থির ঘর্ষণের আওয়াজ শুনতে পেল। ডাক্তাররা অস্থিসন্ধির নড়াচড়ার এই শব্দকে ঘড়ঘড় আওয়াজ বলে থাকেন। প্রায় এক শ’ বছর চিকিৎসকরা ভাবতেন হাড়ে হাড়ে ঘর্ষণের আওয়াজের মধ্যে হয়ত কোন বার্তা রয়েছে। তাই তারা বেশ বড়সড় স্টেথোস্কোপ দিয়ে হাড়ের ঘর্ষণের আওয়াজ শুনতেন। এখন ইনান আশা করেন যে তার গ্রুপটি যে ধ্বনিগত অনুধাবন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে মেডিক্যাল বিজ্ঞান তেমন ডিভাইস বের করবে যা শব্দের সাঙ্কেতিক অর্থ মর্মোদ্ধার করে সেটাকে দরকারী কাজে ব্যবহার করতে পারবে। বর্তমানে গবেষকরা রেকর্ডকৃত শব্দগুলো গ্রাফিং করছেন এবং অস্থিসন্ধির গতির পরিধির সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখছেন। উদ্দেশ্য পা মেলে দেয়া ও ভাঁজ করার মধ্যে ঠিক কোন্ জায়গাটায় হাঁটু কড়কড় করে বা পট করে শব্দ করে ওঠে। দেখা গেছে যে, গ্রাফে চড়াই ও উতরাই আছে যা দেখতে ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম বা অন্যান্য পরীক্ষার সাঙ্কেতিক চিহ্নের মতো। আঘাতপ্রাপ্ত হাঁটু ধ্বনিতত্ত্বীয় প্যাটার্নটা সূক্ষ্ম অক্ষত হাঁটুর ধ্বনিতত্ত্বীয় প্যাটার্ন থেকে লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন। ইনান বলেন, আঘাতপ্রাপ্ত হাঁটুর ধ্বনিগত প্যাটার্নে অস্থিরতার প্রতিফলন থাকে। আর সুস্থ হাঁটুর ধ্বনিগত প্যাটার্ন অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইনানের একাউস্টিক ডিভাইসটিকে চিকিৎসা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করা হলে কম দামের ধারণযোগ্য মনিটর উদ্ভাবিত হতে পারে। এতে করে এথলেটরা যারা তাদের হাঁটুর ওপর যথেষ্ট অত্যাচার করেছেন। আর লাভবান হবেন পা পিছলে পড়ে যাওয়া বয়স্ক রোগীরা। তবে রণাঙ্গনে সৈনিকদের হাঁটুর আঘাতের পুনরাবৃত্তি কমিয়ে আনা এবং তাদের নিরাপদে কর্তব্যকর্মে ফিরে যেতে সাহায্য করার দিকেই ডারপার যত আগ্রহ। ইনান বলেন, বেশিরভাগ মানুষই জানে না যে প্রদান যেসব কারণের জন্য সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এ্যাকটিভ ডিউটি থেকে বাদ দেয়া হয় তার একটি হলো হাঁটুর ও পায়ের পুল্কের আঘাত। সৈন্যরা বন্ধুর ও দুর্গম পথ ধরে কয়েক ডজন মাইল মার্চ করে চলার, রণাঙ্গনের নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা উতরানো এবং আবদ্ধ জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুটিশুটি মেরে থাকার সময় তাদের পিঠের ওপর চেপে থাকে এক শ’ পাউন্ড পর্যন্ত জনের ব্যাকপ্যাক। এমনকি পড়ে না গেলে বা মোচর না খেলেও একজন সৈনিকের সার্জারি হতে পারে এবং তারপর তার পুনর্বাসন কেন্দ্রে স্থান হতে পারে। সমস্যাটা কয়েক মাস পর ঠিক হয়ে যেতে পারে। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই সেটা হয় না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার কারণ হলো নতুন করে আঘাতপ্রাপ্তি। পেশাদার এথলেটদের মতো সৈনিকরা আবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে অতিমাত্রায় উদগ্রীব হতে পারে। এতে তাদের পুরনো সমস্যাটা বাড়ে বৈ কমে না। সার্জারি ও চিকিৎসার পর হাঁটুটা সম্পূর্ণ নতুন লাগতে পারে। কিন্তু যখন কোন সৈনিক আবার কর্মজীবনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন আঘাতজনিত দুর্বলতা ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এর ফলে প্রাথমিক আঘাতের চাইতে পৌনপৌণিক আঘাতপ্রাপ্তিটা ১০ গুণ বেশি ঘন ঘন হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় কম খরচের পরিধানযোগ্য ডিভাইস হাঁটুর আঘাত থেকে সেরে ওঠা ভবিষ্যতের সৈনিকদের প্রয়োজনের সময় ভারি ধরনের কাজ থেকে বিরত রেখে তাদের নতুন করে বড় ধরনের আঘাত প্রাপ্তি পরিহারে সহায়ক হতে পারে। এতে দীর্ঘমেয়াদী বিচারে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও লাভবান হতে পারেন। অস্থিসন্ধির আঘাত কালের প্রবাহে জটিল রূপ ধারণ করে। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা দীর্ঘদিনের বেসামরিক জীবনে ব্যথা বেদনায় কষ্ট ভোগ করে। তাদের সচলতা হ্রাস পায়। আগাম অস্টিওআর্থাইটিস দেখা দিতে পারে। সূত্র : লাইফ সায়েন্স
×