ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সাদাসিধে কথা ॥ সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৩ জুন ২০১৬

সাদাসিধে কথা ॥ সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা

আমি মাঝে মাঝেই একটা প্রশ্ন শুনতে পাই, ‘সৃজনশীল পদ্ধতি কি কাজ করছে?’ প্রশ্নটা শুনে আমি সব সময়েই অবাক হয়ে যাই এবং এর উত্তরে কি বলব বুঝতে পারি না। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘রাত্রে ঘুমানোর পদ্ধতি কি কাজ করছে’ তাহলে আমি যেরকম বুঝতে পারি না কি উত্তর দেব এটাও সেরকম! এর থেকেও বেশি অবাক হই যখন শুনি কেউ বলছে, ‘পড়ালেখার পদ্ধতি যদি সৃজনশীল না হয় তাহলে সৃজনশীল প্রশ্ন কাজ করবে কেমন করে?’ এই প্রশ্নটি শুনলে বুঝতে পারি যিনি প্রশ্ন করছেন তিনি ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ নয় লেখাপড়ার বিষয়টিই ধরতে পারেননি! কেন আমি এরকম একটি কথা বলছি সেটা একটু বোঝানোর চেষ্টা করি। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নামটি দিয়ে শুরু করা যাক। যখন এটা শুরু করা হয়েছিল তখন এর নাম ছিল কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন। এর অর্থ পরীক্ষার প্রশ্নগুলো একটা কাঠামো বা স্ট্রাকচারের মাঝে করা হবে। আগে যে কোনো এক ধরনের কাঠামোর ভেতরে ছিল না তা নয়, তবে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নটি আরো বেশি কাঠামোর ভেতরে থাকবে, তাহলে প্রশ্ন তৈরি করাও সহজ হবে, মূল্যায়নও সহজ হবে। যখন এই পদ্ধতি চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হলো তখন অভিভাবকেরা উঠে পড়ে লাগলেন এটাকে বন্ধ করার জন্য! তাদের বক্তব্য খুবই পরিষ্কার, ‘পদ্ধতিটি অত্যন্ত ভালো, তবে আমাদের ছেলেমেয়েরা পাস করে বের হয়ে যাক, তখন এটি চালু করা হোক!’ আমরা কয়েকজন তখন এই পদ্ধতিটির পক্ষে কথা বলেছি এবং সে কারণে আমাদের নিয়ে কমিটি ইত্যাদি তৈরি করে দেয়া হলো। সেই কমিটির কয়েকজনের কাছে মনে হলো ‘কাঠামোবদ্ধ’ শব্দটা প্রাণহীন এবং যান্ত্রিক, লেখাপড়ার এত সুন্দর একটা পদ্ধতির এরকম খটমটে একটা নাম থাকা ঠিক হবে না এবং প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে ‘কাঠামোবদ্ধ’ নামটা পরিবর্তন করে সেটাকে বলা হলো ‘সৃজনশীল’। এই নামটা সৃজনশীল না হয়ে ‘সার্বজনীন’ হতে পারত, ‘শিক্ষার্থীবান্ধব’ হতে পারত, কিংবা ‘আধুনিক’ও হতে পারত। এমনকি বেঞ্জামিন ব্লুম নামে যে শিক্ষাবিদের বিশ্লেষণকে ভিত্তি করে এই পদ্ধতি গড়ে উঠেছে তার নামানুসারে ‘ব্লুম পদ্ধতি’ও হতে পারত। (আমার ধারণা এই দেশের মানুষের সাদা চামড়া ও বিদেশী মানুষের জন্য এক ধরনের আলগা সমীহ আছে। তাই ব্লুম পদ্ধতি নাম দেয়া হলে কেউ এর সমালোচনা করার সাহস পেত না।) কাজেই কেউ যখন জিজ্ঞেস করে সৃজনশীল পদ্ধতিতে লেখাপড়া না করালে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়া হবে কেমন করে, তখন আমি কৌতুক অনুভব করি। ব্যাপারটা আরেকটু ব্যাখ্যা করি। একটা ছেলে বা মেয়ে যখন লেখাপড়া করে তখন তার মূল্যায়ন করার জন্য তাকে কিছু প্রশ্ন করতে হয়। আমি যদি বোকাসোকা মানুষ হই তাহলে আমার প্রশ্নটাও হবে বোকাসোকা। অর্থাৎ আমি এমন কিছু জানতে চাইব যার উত্তর দিতে হলে ছেলে বা মেয়েটাকে কিছু জিনিস মুখস্থ করে রাখতে হবে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জš§ হয়েছিল কত সালে? কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছিল কত সালে? ইলেকট্রনের ভর কত? পারদের ঘনত্ব কত? ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মুখস্থ করার ক্ষমতাটা কোনো কিছু শেখার মূল ক্ষমতা নয়Ñ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয়া আর নকল করে পরীক্ষা দেয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। কাজেই শুধু মুখস্থ জ্ঞান পরীক্ষা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এমনভাবে প্রশ্ন করতে হবে যেন আমরা জানতে পারি ছেলে বা মেয়েটা বিষয়টা আসলেই বুঝেছে কি না, বিষয়টা ব্যবহার করতে পারে কি না কিংবা বিষয়টা নিয়ে একেবারে নিজের মতো করে চিন্তা করতে পারে কি না। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিটি আসলে এই বিষয়টা নিশ্চিত করে। এই পদ্ধতিতে প্রশ্ন করলে আমরা একটা ছেলে বা মেয়ে সত্যি সত্যি একটা বিষয় শিখেছে কি না সেটা অধিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি। বিষয়টা আরো খোলাসা করার জন্য একটা সত্যিকারের উদাহরণ দেয়া যাক। ধরা যাক একজন একটা পাঠ্য বিষয় পড়ে জানতে পারল বাংলাদেশের জনসংখ্যা হচ্ছে ষোলো কোটি। এখন আমি যদি তাকে জিজ্ঞেস করি ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত?’ সে ঝটপট করে বলে দিতে পারবে ‘ষোলো কোটি।’ যে বিষয়টি পড়েনি এবং এই সংখ্যাটা জানে না তার পক্ষে চিন্তাভাবনা করে কোনোভাবেই এটা বের করা সম্ভব না, এটা জানার জন্য তাকে বিষয়টা পড়তেই হবে, পড়ে মনে রাখতে হবে, সোজা কথায় মুখস্থ করতে হবে। এক অর্থে বলা যায় এই প্রশ্নটা করে আমি ছেলে বা মেয়েটার ‘মুখস্থ’ জ্ঞান পরীক্ষা করছি। সৃজনশীল পদ্ধতিতে এই ধরনের প্রশ্নের জন্য থাকে মাত্র এক মার্ক! কিন্তু এই একটি মার্ক সে কখনোই এমনি এমনিভাবে পেয়ে যাবে না- এটা পাওয়ার জন্য তাকে তার পাঠ্য বিষয়টুকু পড়তে হবে। ছেলে বা মেয়েটি সঠিক উত্তর দিলেও আমরা কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারিনি সে বিষয়টা বুঝেছে কি না! হয়তো সংখ্যাটি না বুঝেই মুখস্থ করে রেখেছে। সত্যি সত্যি বুঝেছে কি না পরীক্ষা করার জন্য আমাদের আরেকটা প্রশ্ন করতে হবে। অনেকভাবেই এটা করা সম্ভব, কিন্তু আমরা খুব সহজ একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘বাংলাদেশে আনুমানিক কতজন মহিলা?’ আমরা ধরে নিচ্ছি এই তথ্যটি পাঠ্য বিষয়ে দেয়া নেই, কাজেই এটা বের করার জন্য তাকে একটুখানি চিন্তা করতে হবে। জনসংখ্যা বলতে কি বোঝায় তার জানতে হবে, কোনো গুরুতর কারণ না থাকলে যে একটা দেশে পুরুষ এবং মহিলার সংখ্যা কাছাকাছি হয় সেটাও জানতে হবে। কাজেই ছেলে বা মেয়েটি জনসংখ্যার বিষয়টি কোনো কিছু না বুঝে একেবারে তোতা পাখির মতো মুখস্থ করে না থাকলে ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পারবেÑ বলতে পারবে ‘আনুমানিক আট কোটি।’ আমরা তখন জানব সে বিষয়টা বুঝেছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে কোনো কিছু বুঝেছে কি না সেই প্রশ্নের জন্য থাকে দুই মার্ক। পড়ালেখা শেখার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াতে একটা ছেলে বা মেয়েকে কোনো কিছু শিখতে হলে তাকে তার জ্ঞানটুকু ব্যবহার করা শিখতে হয়। কাজেই এবারে তাকে এমন একটা প্রশ্ন করতে হবে যেটা থেকে আমরা জানতে পারব সে তার জ্ঞানটুকু ব্যবহার করতে শিখেছে কি না। এর জন্য অনেক ধরনের প্রশ্ন করা সম্ভব। আবার আমি খুব সহজ একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘উনিশ শ’ সত্তর সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি, দুই হাজার পনেরো সালে সেটি বেড়ে হয়েছে ষোলো কোটি। দুই হাজার কুড়ি সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত হবে?’ বোঝাই যাচ্ছে এর উত্তর দিতে হলে তাকে ছোটখাটো একটা হিসাব করতে হবে। হিসাব করে সে যদি বের করতে পারে সংখ্যাটি হবে সতেরো কোটি তাহলে বুঝতে হবে সে মোটামুটিভাবে সঠিক হিসাব করেছে। কোনো ছেলে বা মেয়ে তার জ্ঞানটুকু নির্দিষ্ট কোনো দক্ষতা দিয়ে ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে কি না সেটা পরীক্ষা করার এরকম আরো অনেক ধরনের দক্ষতা রয়েছে। যদি আমরা প্রশ্ন করে বুঝতে পারি তার প্রয়োজনীয় দক্ষতাটুকু আছে তাহলে সৃজনশীল পদ্ধতিতে ছেলে বা মেয়েটি পাবে আরো তিন মার্ক। অর্থাৎ জানা, বোঝা এবং ব্যবহার করতে পারার দক্ষতা এই তিনটি মিলিয়ে তাকে ছয় মার্কের মূল্যায়ন করা হয়েছে। যদি আমরা সব মিলিয়ে দশ মার্কের মূল্যায়ন করতে চাই তাহলে আরো চার মার্কের একটি প্রশ্ন করতে হবে। এই শেষ চার মার্কের প্রশ্নটিই হচ্ছে একমাত্র বা সত্যিকারের ‘সৃজনশীল’ প্রশ্ন। এই শেষ প্রশ্নটির গালভরা নামটি হচ্ছে ‘উচ্চতর দক্ষতা’। এই প্রশ্নটি দিয়ে আমরা বুঝতে পারি ছেলে বা মেয়েটির মৌলিকভাবে চিন্তা-ভাবনা বা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আছে কি নেই। আমাদের এই প্রশ্নগুলোর সঙ্গে মিল রেখে একটা সহজ উদাহরণ এরকম হতে পারেÑ ‘দেশের মানুষের আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি না সেটা ব্যাখ্যা কর।’ বোঝাই যাচ্ছে এর উত্তর দিতে হলে তাকে বেশ মাথা খাটাতে হবে। সে নিজের মতো করে চিন্তাভাবনা করে যুক্তি দিয়ে এর যা খুশি উত্তর দিতে পারে। কেউ যদি সঠিক যুক্তি দিয়ে বলে সম্পর্ক আছে তাহলেও সে চার মার্ক পেতে পারে, আবার যদি যুক্তি দিয়ে উল্টোটা বোঝাতে পারে তাহলেও চার মার্ক পেতে পারে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে সৃজনশীল প্রশ্ন আসলে এমন কিছু হাতিঘোড়া বিষয় নয়, একটু গুছিয়ে প্রশ্ন করার পদ্ধতি। আমি এই আলোচনার মাঝে শুধু ‘উদ্দীপক’ নামের অংশটুকু নিয়ে কিছু বলিনি। ছেলেমেয়েদের খেই ধরিয়ে দেয়ার জন্য কোনো একটা কিছু দিয়ে শুরু করে তারপর প্রশ্নগুলো লেখা হয় তার বেশি কিছু নয়Ñ সেটাই হচ্ছে উদ্দীপক। উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্ন করার সময় উদ্দীপকের সঙ্গে একটু মিল রেখে প্রশ্নটা করতে হয়। যাই হোক, সবাইকে বুঝতে হবে সৃজনশীল পদ্ধতি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার অনেক আগে থেকেই কিন্তু ভালো শিক্ষকেরা সৃজনশীল প্রশ্ন করে আসছেন, শুধু আমরা সেগুলোকে এই নামে ডাকিনি। এখন আমরা বিষয়টা আনুষ্ঠানিকভাবে চাইছি, একটা কাঠামোর ভেতরে করছি সেটুকুই হচ্ছে পার্থক্য। ভালো প্রশ্নের ধরনই হচ্ছে আমাদের সৃজনশীল প্রশ্ন, এই প্রশ্নগুলো করে একটা ছেলে বা মেয়েকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব। এটা বাংলাদেশের শিক্ষাবিদরা আবিষ্কার করেননি, সারা পৃথিবীর ছাত্রছাত্রীদেরকেই এই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হয়। আমরা এখন এটা শুরু করেছি। কাজেই কেউ যখন প্রশ্ন করে, ‘সৃজনশীল পদ্ধতি কি কাজ করছে?’ তখন আসলে সে জানতে চাইছে, ‘একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে সঠিক প্রশ্ন করার কাজটি কি ঠিক হচ্ছে?’ তাই আমি কি উত্তর দেব বুঝতে পারি না। ॥ দুই ॥ সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমার দুটি মজার ঘটনার কথা মনে পড়ল। তখন মাত্র এটি শুরু হয়েছে, শিক্ষকেরা বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেননি। আমার বোনের মেয়ে যে স্কুলে পড়ে তার ধর্মশিক্ষক সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন, সৃজনশীল প্রশ্নের মাথা মু-ু কিছুই তিনি ধরতে পারেন না। কোনো উপায় না পেয়ে পরীক্ষার আগে ছাত্রছাত্রীদের বললেন, ‘তোরা সবাই বাসা থেকে সৃজনশীল প্রশ্ন করে আনবি, যারটা সবচেয়ে ভালো হবে সেটা পরীক্ষায় দিয়ে দেব।’ ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দেখে কে! যে প্রশ্ন করতে গিয়ে শিক্ষকের মাথা ওলট-পালট হয়ে যায় সেই বিষয় নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বুকের ভেতর কিন্তু কোনো ভয় ডর নেই। দ্বিতীয় ঘটনাটি শুনেছি একজন শিক্ষকের কাছে। একদিন আমাকে বললেন, ‘সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার পর কি ঘটেছে জানেন?’ আমি বললাম, ‘কি ঘটেছে?’ শিক্ষক বললেন, ‘পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে, দোজখ আর বেহেশতের মাঝে পার্থক্য কি? একজন ছেলে লিখেছে দোজখ হচ্ছে ‘মাইর’ এবং ‘মাইর!’ বেহেশত হচ্ছে ‘আ-রা-ম!’ আমি হাসতে হাসতে শিক্ষককে বললাম, ‘আপনি তাকে পুরো মার্ক দিয়েছেন তো? সে কিন্তু পার্থক্যটা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে।’ ॥ তিন ॥ স্কুলের শিক্ষকেরা যেন অধিকভাবে সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন সেজন্য তাদের অনেক ট্রেনিং দেয়া হয়েছে কিন্তু তারপরও মনে হয় বেশিরভাগ শিক্ষক বিষয়টা ঠিকভাবে ধরতে পারেননি। একেবারে হুবহু নিয়ম মেনে প্রশ্ন না করলেই যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে তাও নয়। কিন্তু গৎবাঁধা নিয়ম মেনে প্রশ্ন করলেই কাজ চালানোর মতো প্রশ্ন করা সম্ভব কিন্তু যে কোনো কারণে তাদের মাঝে সেই আত্মবিশ্বাসটুকু গড়ে তোলা যায়নি। তাই ধীরে ধীরে শিক্ষকেরা গাইড বই থেকে প্রশ্ন নেয়া শুরু করলেন। ছাত্রছাত্রীরা যখন বিষয়টা টের পেতে শুরু করল তখন ভালো মার্ক পাওয়ার লোভে তারাও গাইড বই পড়তে শুরু করল। আগে তারা শুধু পাঠ্যবই মুখস্থ করত এখন তাদের পাঠ্যবই এবং গাইড দুটিই মুখস্থ করতে হয়। সরকার থেকে গাইড বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি, এটা অন্য নামে ছাপা হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের এর জন্য যতটুকু চাহিদা অভিভাবকদের চাহিদা তার থেকে দশ গুণ বেশি। কাজেই বাজার থেকে গাইড বই উঠে যাবে সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা গাইড বই ছাপিয়ে টু-পাইস কামিয়ে নেয়ার ব্যবসা শুধু যে গাইড বইয়ের বিক্রেতারা করছেন তা নয়Ñ আমাদের দেশের সব বড় দৈনিক পত্রিকাগুলো নিয়মিত গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তাদের ঘুম নেই, তীব্র সমালোচনা করে বড় বড় প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে কিন্তু নিজেরা কেমন করে এত বড় একটা অন্যায় কাজ করে ছেলেমেয়েদের নিপীড়ন করে যাচ্ছেন সেটা কিছুতেই আমি বুঝতে পারি না। প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে রাখা লেখাপড়া নয়Ñ এই সহজ বিষয়টা দেশের বড় দৈনিক পত্রিকাগুলোর সম্পাদকেরা জানেন না, এই দুঃখটি রাখার জায়গা নেই। স্কুলের শিক্ষকেরা যখন গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দিয়ে স্কুলের পরীক্ষা নিতে শুরু করলেন তখন অসংখ্য ছেলেমেয়ে আমার কাছে সেটা নিয়ে অভিযোগ করতে শুরু করেছিল। আমি তাদেরকে বুঝিয়েছিলাম তারা যেন সেটা নিয়ে মাথা না ঘামায়। তারা যেন ভালো করে তাদের পাঠ্যবইটি পড়েই পরীক্ষা দেয়। তার কারণ গাইড বই মুখস্থ করে স্কুলের পরীক্ষাতে ভালো মার্ক পেয়ে কোনো লাভ হবে না। সত্যিকারের পাবলিক পরীক্ষাতে কখনো গাইড বই থেকে কোনো প্রশ্ন আসবে না, কাজেই কোনোভাবে তারা যেন গাইড বই মুখস্থ করে নিজেদের সৃজনশীলতা নষ্ট না করে। তখন একদিন সৃজনশীল পদ্ধতির মাঝে ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ল। আমরা হতবুদ্ধি হয়ে আবিষ্কার করলাম দেশের পাবলিক পরীক্ষাতে গাইড বই থেকে প্রশ্ন দেয়া শুরু হয়েছে। এর চাইতে বড় অপরাধ আর কি হতে পারে আমার জানা নেই। যে প্রশ্নপত্রে পনেরো থেকে বিশ লাখ ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দেবে সেই প্রশ্ন যদি শিক্ষকেরা নিজেরা করতে না পারেন, তাহলে আমরা কার দিকে মুখ তুলে তাকাব? কয়েকদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা বড় সভায় আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে দেশের অনেক বড় বড় শিক্ষাবিদ উপস্থিত ছিলেন। কেমন করে শিক্ষার মান বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে সেখানে অনেক আলোচনা হয়েছে। যারা আলোচনা করেছেন তাদের মাঝে আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকেরাই বেশি ছিলেন, মাঠ পর্যায়ে স্কুলের শিক্ষকেরা কেউ ছিলেন নাÑ তাই আলোচনাটুকু ঠিক বাস্তবমুখী না হয়ে অনেকটা দার্শনিক আলোচনার মতো হয়েছিল। তারপরেও আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই আনন্দিত হয়েছি যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে। শেষ খবর অনুযায়ী এই অঞ্চলের যতগুলো দেশ রয়েছে তার মাঝে বাংলাদেশ শিক্ষার পেছনে সবচেয়ে কম অর্থ খরচ করে। যেখানে জিডিপির ছয় শতাংশ খরচ করার কথা সেই সংখ্যাটি কমতে কমতে এখন দুই শতাংশ থেকেও নিচে নেমে এসেছে। কী সর্বনাশা কথা! যেই দেশে শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে কম সেই দেশের ছেলেমেয়েদের হাতে আমরা কি তুলে দেব? এই দুঃখ আমরা কোথায় রাখব? ১.৬.২০১৬
×