ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

বাজেট ॥ সস্তা শ্রম, মূল্যহীন মেধা

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৩ জুন ২০১৬

বাজেট ॥ সস্তা শ্রম, মূল্যহীন মেধা

এই লেখাটি আমি লিখছি মঙ্গলবার রাতে। এটি ছাপা হওয়ার কথা শুক্রবার। ইতোমধ্যেই বাজেট উপস্থাপিত হয়ে গেছে। অথচ আমি বাজেটের কিছুই জানি না। সাপ-ব্যাঙ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমার জানা আছে মে মাসব্যাপী বিভিন্ন কাগজের নানা ধরনের ‘স্পেকুলেটিভ নিউজ’ যা এখন কার্যত অর্থহীন। এমতাবস্থায় কী লিখব? স্থির করেছি লিখব এমন একটা বিষয়ে যার ওপর আলোচনা কম, বাজেটে তো বটেই। বিষয়টি শ্রম ও মেধা। প্রথমেই শ্রমের কথা, শ্রমিকের কথা বলি। আমরা সকলেই জানি আমাদের কৃষক ভাইয়েরা ফজরের নামাজের আগে ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠে। নামাজের পর তাদের কাজ মাঠে যাওয়া। এর জন্য প্রস্তুতি লাগে। লাঙল-জোয়াল তৈরি করতে লাগে। হালের গরু লাগে (আজকাল অবশ্য পরিবর্তন হচ্ছে অনেক কিছুর)। প্রস্তুতি শেষে তার যাত্রা শুরু। মাঠে কর্মরত থাকাকালীন সময়েই নাস্তা নিয়ে যায় কৃষকের বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে। স্কুলের কী হবে? এর উত্তর দেবেন মন্ত্রী মহোদয়রা। নাস্তার পর দুপুরের খাবার এও মাঠেই, ক্ষেতের আইলে বসে। কৃষক বাড়ি ফেরে বিকেলে। তারপর গোসল-স্নান। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যার অপেক্ষা। বাড়িতে অনেকের কেরোসিনের কুপি জ্বলে না। কৃষক অবশ শরীরে শুয়ে পড়ে। চক্রাকারে চলে তার জীবন। এই যে পরিশ্রমী কৃষক, এই যে তার শ্রম, এর মূল্য কী সে পায়? উত্তর পরিষ্কার, না পায় না। সে ধানের দাম পায় না, আলুর দাম পায় না, টমেটোর দাম পায় না, বেগুন, শাক-সবজি কোনটার দাম পায় না। পায় না পাটের দামও। অথচ সে বছরের পর বছর ধরে শ্রম দিয়ে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার তার শ্রমের মূল্যায়ন করে না। মাঝে মাঝে কুম্ভীরাশ্রু ফেলতে দেখা যায় সরকারগুলোকে; কিন্তু এই যা। ধরা যাক পোশাক শ্রমিকদের কথা। যাদেরকে বলা হয় ‘গার্মেন্টস শিল্পের’ শ্রমিক। এরাই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের জামা-কাপড় সেলাই করে। তাই বিদেশে রফতানি হয়। দিনরাত তারা খাটে। ভোর বেলা লাইন ধরে তারা ফ্যাক্টরিতে যায়। সন্ধ্যা নেই, রাত নেই তারা দল বেঁধে বাড়ি ফিরে। কঠোর শ্রম দিয়ে তারা দাঁড় করিয়েছে একটি দুধাল গাভী ‘গার্মেন্টস শিল্প’। ঘটনাক্রমেই এটা এখন দুটি স্তম্ভের একটি। রেমিটেন্স এবং গার্মেন্টস। এই দুইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ব্যবসায়ীদের ‘চর্বি’ রমরমা এই দুইয়ের ওপর। তাই নয় কী? কিন্তু প্রশ্ন এই শ্রমের মূল্য কী পোশাক শ্রমিকরা পায়? যেটুকু তাদের দেয়ার কথা তারা কী তা পায়? বাদ দিই এই প্রশ্ন। মজুরি বলে যা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত আছে তা কী তারা মাসেরটা মাসে পায়? তাদের কর্মপরিবেশ কী আছে? এসবের উত্তর আমরা জানি। নারী শ্রমিক, পুরুষ শ্রমিক তাদের শ্রমের মূল্য পায় না। এই জগতে বিরাজ করছে এক বিশাল প্রবঞ্চনা। সদম্ভে প্রতি মুহূর্তে ঘোষিত হচ্ছে আমাদের শ্রমের মূল্য সবচেয়ে কম পৃথিবীতে। অতএব বিনিয়োগকারীরা দৌড়ে দৌড়ে বাংলাদেশে আসবে। বস্তুত ঘটছেও তাই। বিশ্ব বিনিয়োগের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যেখানেই শ্রমের মূল্য কম সেখানেই যায় বিনিয়োগ (কেপিট্যাল)। বলা হচ্ছে এই মুহূর্তে চীনে শ্রমের মূল্য বেশি। অতএব বিনিয়োগকারীরা আসবে বাংলাদেশে। কারণ আমাদের দেশে শ্রমিকের মজুরি খুবই কম। মজার ঘটনা বিশ্বের ‘ক্যাপিটালিস্টরা’ সব কিছু দিতে রাজি; কিন্তু শ্রমের মজুরি যথাযথহারে দিতে রাজি নয়। তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশে যায়। যেখানেই মজুরি কম, শ্রমের দাম নেই সেখানেই তারা। আবার এটাও দেখে যাতে কোন আন্দোলন না হয়। চায় তারা শান্ত পরিবেশ। মিডিয়া এসব জিনিস ফলাও করে প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক পুঁজিকে সমর্থন করে। এই শ্রমিকদের সংসার চলে কীনা, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে কীনা, তারা বাচ্চাকাচ্চা নিতে পারে কীনা, তারা দেনাদার কীনা এসব প্রশ্নের কোন জওয়াব নেই। সরকারের দৃষ্টি, রাষ্ট্রের দৃষ্টি, প্রভাবশালীদের দৃষ্টি রফতানির ফিগারের ওপর। এই প্রতি ডলার রফতানিতে শ্রমিকের চোখের জল মিশে আছে কী না এটা কারো প্রশ্ন নয়। একই অবস্থা রেমিটেন্সের ক্ষেত্রেও। লাখ লাখ গরিব কৃষকের ছেলেমেয়ে বিদেশে যাচ্ছে কাজ করতে। বিদেশীরা আমাদের ছেলেমেয়েদের নেয়, কারণ তারা ‘সস্তা’। এদের দাম বাড়লে শ্রম আমদানিকারক পাওয়া যাবে না। সস্তায় খেটে তারা ডলার পাঠায় দেশে। রাস্তাঘাটে তারা মারা যায়, বিনা চিকিৎসায় তারা মারা যায়। বিদেশী মালিকদের অত্যাচারে তারা অত্যাচারিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা ‘বন্ডেড লেবার’। ক্যাপিটালিস্টরা তাদের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার করে। অথচ এসব জেনেও দুটো পয়সার জন্য, দুটো ভাতের জন্য বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে বিদেশে যায়। যাওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেÑ জমি বিক্রি করে, ধার করে। সমুদ্রে ডুবে মরেছে কত বাঙালী। সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি তাদেরকে দেশে রাখতে পারেনি। তারা সস্তা শ্রম দেয়ার জন্য বিদেশে যেতে চায়। এ এক দুর্লভ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে দেশে-বিদেশে। সর্বত্র প্রশংসা ‘সস্তা’ শ্রমের। কোথাও জীবন-জীবিকার কথা নেই, প্রয়োজনের কথা নেই, চিকিৎসা, লেখাপড়া ইত্যাদির কথা নেই। সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া, প্রভাবশালী লোকেরা মিলেমিশে ‘ক্যাপিটালের’ সেবা করে যাচ্ছে। ‘ক্যাপিটালের’ স্বার্থে যা করার তাই করছে। বিপরীতে মেধার মূল্য কী পাওয়া যাচ্ছে? পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে শ্রমের মূল্য, ন্যায্যমূল্য না দিয়ে যে অর্থনীতি আমরা গড়ে তুলতে চাইছি সেখানে শুধু যে শ্রমের মূল্য নেই তা নয়, সেখানে মেধারও কোন মূল্য নেই। প্রতিযোগিতার মূল্য নেই। যে বাজার অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাইছি, সকল বাজেট যে উদ্দেশ্যে প্রণীত সেখানে বাজার অর্থনীতির কোন মৌল উপাদানই উপস্থিত নেই। যে যুবক-যুবতীটির একটা কিছু করে দেখানোর ক্ষমতা আছে, মেধা আছে, শ্রম দিতে পারে সে কী ব্যাংক থেকে এক-দুই কোটি টাকা ঋণ নিতে পারবে? অসম্ভব, অসম্ভব। তার ‘কোলেটারেল’ (জামানত) নেই। তার তদ্বিরের লোক নেই। উত্তরা বা পূর্বাচলে কী একজন নাগরিক এক খ- জমি পেতে পারে? মেধাবী, পরিশ্রমী একজন নাগরিক কী একখ- জমি পাবে? কারা পায়? যাদের সরকারের ‘এক্সেস’ আছে তারাই পায়। ঠিকাদারি কারা পায়, বিদ্যুত বানাবার লাইসেন্স কারা পায়? এসব কী যাদের মেধা আছে, যারা পরিশ্রমী তারা পায়? প্রশ্নগুলো করছি। কারণ এই প্রশ্নগুলো মৌলিক প্রশ্ন পুঁজিবাদ গঠনের। অবশ্য প্রশ্ন, জরুরী প্রশ্ন অন্যত্রও আছে। এসব প্রশ্ন এবার মার্কিনীরাই তুলছে। তুলছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা। তারা প্রশ্ন তুলছেন পুঁজিবাদ সম্পর্কেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ‘টাইম ম্যাগাজিনে’ একটা স্টোরি ছাপা হয়েছে সম্প্রতি। তাতে বলা হয়েছে মার্কিনীদের মধ্যে ৫০ শতাংশের ওপর লোক ‘পুঁজিবাদ’ পছন্দ করছে না। তারা একে ‘বস্তাপচা সিসটেম’ বলছে। এর বদৌলতে মার্কিনীরা বিশ্বের এক নম্বর ধনী দেশ (ডেটর কান্ট্রি) হয়েছে। ঋণ দিয়ে তারা একটা কৃত্রিম সিসটেম টিকিয়ে রেখেছে। তাদের কোন সঞ্চয় নেই। নতুন কোন সম্পদ তৈরি হচ্ছে না। সস্তায় কাজ করতে গিয়ে তারা নিজের দেশের লোককে কর্মহীন করছে। শ্রমিক নিচ্ছে বিদেশ থেকে। তারা উদার-বাণিজ্য নীতিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। চোখের সামনে কিন্তু এসব ঘটছে। অথচ আমরা মার্কিনীদের নতুন শিষ্য হিসেবে ‘যাচ্ছেতাই’ করে যাচ্ছি। শ্রম, মেধা, প্রতিযোগিতার কোন মূল্য দিচ্ছি না। তদ্বির ছাড়া, টাকা ছাড়া চাকরি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা আর অবশিষ্ট নেই। এমনকি শিক্ষকতাতেও। বিপজ্জনক ঘটনা। যেখানে মেধার দাম সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা সেখানেও এটা নেই। এই যে সস্তা শ্রমের প্রশংসায় আমরা মেতেছি তার ইতি হওয়া দরকার। সস্তা শ্রম বাজার দেয় না। দীর্ঘমেয়াদে তা আত্মঘাতী। চীন সস্তা শ্রমে পোশাক শিল্প গড়ে তুলেছে, গড়ে তুলেছে অন্যান্য শিল্প। কিন্তু ধীরে ধীরে শ্রমের মূল্য বেড়েছে। এখন সব যায় যায়। অতএব প্রশ্নটা সস্তা শ্রমের নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে ‘টেকসই উন্নয়ন’। টেকসই উন্নয়ন করতে হলে শ্রমের মূল্য দিতে হবে, কৃষিপণ্যের মূল্য দিতে হবে, মেধা ব্যবহার করতে হবে। প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত করতে হবে। ব্যাংকের লোন নিয়ে ‘মেধাবীরা’ যদি আবুধাবি এবং মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যায় তাহলে উন্নয়নের কী হবে? খবর নিন। তদবিরবাজ ঋণগ্রাহকরা একে একে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন এ সম্পর্কে খবর ছাপা হচ্ছে। এক সময়ে কক্সবাজারে হোটেল বানানোর হিড়িক পড়ে। লোকদের প্রলুব্ধ করে ‘মেধাবী’ একশ্রেণীর ব্যবসায়ী বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে। এদের বেশিরভাগই এখন পলাতক। এসব ঘটনা আমলে নিতে হবে। প্রতি বছর বাজেট দিয়ে শেষে যদি এই ঘটনা ঘটে তাহলে দেশের কী হলো? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×