ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ লাখ নতুন গ্রাহকের মধ্যে নানা শঙ্কা

স্টিল না কাঠের খুঁটি- সিদ্ধান্তহীনতায় পল্লী বিদ্যুতে ভাটা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২ জুন ২০১৬

স্টিল না কাঠের খুঁটি- সিদ্ধান্তহীনতায় পল্লী বিদ্যুতে ভাটা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ কতিপয় ব্যক্তির সিদ্ধান্তহীনতায় ব্যাহত হচ্ছে পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম। স্টিল না কাঠের খুঁটি না দুটো দিয়েই বিদ্যুত লাইন টানা হবে, তা নিয়েই সিদ্ধান্তহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি পল্লী বিদ্যুতের লাইন টানার ক্ষেত্রে কংক্রিট ও কাঠের খুঁটির পাশাপাশি স্টিল খুঁটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্টিলের খুঁটি দিয়ে বিদ্যুত সরবরাহের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। এ বিষয়ে বার বার উদ্যোগ নিয়েও সঙ্কট নিরসন হচ্ছে না। ফলে বিদ্যুতায়নের মতো উন্নয়ন কার্যক্রমে খানিকটা ভাটা পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পের আওতায় থাকা ১৫ লাখ নতুন গ্রাহকের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে নানা শঙ্কা। এ প্রকল্পের খুঁটি কেনার ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৪ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই স্টিলের খুঁটি ব্যবহারের উদ্যোগ হিতে বিপরীত হতে পারে। গচ্চা যেতে পারে পুরো টাকাই। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড কার্যক্রম শুরু করে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সর্বত্রই খাল-বিল-হাওড়-জলাশয়। ভৌগলিক কারণে দেশের অনেক জেলা অপেক্ষাকৃত নিচু। এসব জেলায় অনেক স্থান বছরের অধিকাংশ সময়ই জলমগ্ন থাকে। জলমগ্ন থাকা স্থানগুলোতে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড সাধারণত কাঠের খুঁটি দিয়ে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়। ১৯৯৪ সালে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে চাপের মুখে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড সীমিত আকারে কংক্রিটের খুঁটির ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীতে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের খাম্বা লিমিটেড বিদ্যুতের খুঁটির ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট আমলে এ সিন্ডিকেট কংক্রিটের খুঁটি ব্যবসার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। হাতিয়ে নেয়া অর্থের মধ্যে অনেক টাকা পাচার করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজও বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমে কংক্রিটের খুঁটি আধিপত্য বিস্তার করে আছে। বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে এখনও শতকরা ৮০ ভাগ কংক্রিটের খুঁটি ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও এর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে অন্যদের হাতে। সূত্র বলছে, বর্তমানে পল্লী বিদ্যুতায়ন প্রকল্পে স্টিলের খুঁটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে নতুন একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট খোদ বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুকেও ভুল বোঝাতে সক্ষম হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ নিয়মানুযায়ী পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড কমিটি বরাবরই কাঠের খুঁটি ও কংক্রিটের খুঁটি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার ওপর সমীক্ষা করে থাকে। এমনকি কোন্ এলাকায় কী ধরনের এবং মোট খুঁটির মধ্যে কোন্ প্রকারের কী পরিমাণ খুঁটি ব্যবহৃত হবে তাও সমীক্ষা করে। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক বর্তমানে ৮০ শতাংশ কংক্রিটের খুঁটি ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি ২০ শতাংশ কাঠের খুঁটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, স্টিলের খুঁটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কোন অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি অতীতে কোন মূল্যায়ন সভা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কিত পর্যালোচনাতেও স্টিলের খুঁটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোন আলোচনা বা পরামর্শ বা বৈঠক হয়নি। নিয়মানুযায়ী যে কোন প্রকল্পে নতুন কোন ব্যবস্থা গ্রহণের আগে দু’একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে নতুন ব্যবস্থার সুফল-কুফল যাচাই-বাছাই করা হয়ে থাকে। স্টিলের খুঁটির ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। পিডিবি (পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড) যেখানে বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে দিন দিন স্টিলের খুঁটির ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে, সেখানে পল্লী বিদ্যুতায়নে স্টিলের খুঁটি ব্যবহারের উদ্যোগের যৌক্তিকতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। এমনকি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের এক পর্যালোচনা সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারিত করার কাজে স্টিলের খুঁটির কোন প্রয়োজনীয়তা নেই বলে সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত ফাইলটি আবার আলোচনায় ওঠে। তখন ওই ফাইলে কাঠের খুঁটির পাশাপাশি বা বিকল্প হিসেবে স্টিলের খুঁটি নেয়ার বিষয়টি সংযুক্ত হয়। সূত্র বলছে, শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে স্টিলের খুঁটি সংযুক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ওই সিন্ডিকেটই এক কর্মকর্তার মাধ্যমে কাঠের খুঁটির বিকল্প হিসেবে স্টিলের খুঁটি সংযুক্ত করে। সম্প্রতি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড গ্রাহককে বিদ্যুত সংযোগ দেয়ার কাজ শুরু করেছে। প্রকল্পে নিয়মানুযায়ী ৮০ শতাংশ কংক্রিটের খুঁটি এবং বাকি ২০ শতাংশ কাঠের খুঁটি দিয়ে লাইন টানার কথা। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডও এমন সিদ্ধান্তই নেয়। কিন্তু চলতি বছর বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের দফতর থেকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন বরাবর একটি ডিও লেটার পাঠানো হয়। সেখানে কাঠের খুঁটির পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে স্টিলের খুঁটি সংযুক্ত করার বিষয়ে আরও আলোচনা করার নির্দেশনা রয়েছে। এমন অভিমত দেয়ার পর এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ খানিকটা ব্যাহত হচ্ছে। কাঠের খুঁটি না স্টিলের খুঁটি দিয়ে বিদ্যুতের লাইন টানা হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড কোন্ পক্ষে থাকবে তা নিয়ে দোটানায় রয়েছে। এ বিষয়ে বার বার যোগাযোগ করা হলেও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন কোন মন্তব্য করেননি। প্রতিমন্ত্রীর এমন ডিও লেটারের প্রেক্ষিতে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের তরফ থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড অদ্যাবধি কোন স্টিলের খুঁটি ব্যবহার করেনি। এমনকি স্টিলের পোল (খুঁটি) স্থাপন এবং মান সম্পর্কে কোন ধারণাও নেই পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, কাঠের খুঁটির চেয়ে কংক্রিটের খুঁটিতে দ্বিগুণ ব্যয় হয়। প্রতি কিলোমিটার লাইন স্থাপনে কাঠের খুঁটিতে চার লাখ আর কংক্রিটের খুঁটিতে আট লাখ টাকা ব্যয় হয়। সেক্ষেত্রে স্টিলের খুঁটির ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। কংক্রিটের খুঁটির চেয়ে কাঠের খুঁটি ব্যবহারে উপযোগিতা ও সুবিধা বেশি। বিশেষ করে ব্যবহার ও পরিবহনের ক্ষেত্রে সুবিধা সবচেয়ে বেশি। কাঠের খুঁটির চাপ সহ্য করা এবং ওজন বহন ক্ষমতা বেশি। কম ব্যয়ে স্থাপন করা যায়। এমনকি পুনঃব্যবহারযোগ্য। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম। বিশেষ করে জলমগ্ন এলাকায় কাঠের খুঁটি পানিতে ভাসিয়ে নেয়া সম্ভব। অথচ কংক্রিট ও স্টিলের খুঁটি অন্য কোন পরিবহন ছাড়া কাঠের খুঁটির মতো ভাসিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কংক্রিট ও স্টিলের খুঁটির চেয়ে কাঠের খুঁটিতেও জটিলতা কম।
×