ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মহিবুরের মৃত্যুদণ্ড, অন্য দু’ভাইয়ের আমৃত্যু কারাদণ্ড

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২ জুন ২০১৬

মহিবুরের মৃত্যুদণ্ড, অন্য দু’ভাইয়ের আমৃত্যু কারাদণ্ড

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে হবিগঞ্জের দুই সহোদর মহিবুর রহমান বড় মিয়া ও মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া এবং তাদের চাচাত ভাই আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণের দায়ে মহিবুর রহমানকে মৃত্যুদ- এবং তার ভাই মুজিবুর রহমান ও চাচাত ভাই আব্দুর রাজ্জাককে আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বুধবার এ রায় প্রদান করেছেন। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ১১ মে ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে। এ রায়টি ট্রাইব্যুনালের ২৪তম রায়। রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা চার অভিযোগের সবগুলোই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম অভিযোগে হত্যার দায়ে মহিবুরকে মৃত্যুদ- ও তার দুই ভাইকে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। বাকি তিন অভিযোগে আসামিদের প্রত্যেককে ৩৭ বছর করে সাজার আদেশ দিয়েছে আদালত। রায়ে প্রসিকিউশনপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবেন। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত ২৪টি মামলার রায় হয়েছে। তার মধ্যে ৩৪ জনকে বিভিন্ন দ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩ জনের মৃত্যুদ-, একজনের যাবজ্জীবন, একজনের ৯০ বছরের কারাদ- এবং ১১ জনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে পলাতক আছে ৯ জন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীলে চূড়ান্ত রায়ে পাঁচজনের মৃত্যুদ- কার্যকরা করা হয়েছে। আর একজনকে মৃত্যুদ- কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। আপীলে আরও একজনের ট্রাইব্যুনালের দ-ই বহাল রাখা হয়েছে। তিন আসামিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয় বুধবার সকাল পৌনে ৯টায়। কিছু সময় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় রেখে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাদের তোলা হয় কাঠগড়ায়। এর পরপরই তিন বিচারপতি আসন গ্রহণ করেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সূচনা বক্তব্যের পর ২৪০ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত সার পড়া শুরু করেন বিচারপতি মোঃ সোহরাওয়ার্দী। এরপর বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম রায়ের আরেকটি অংশ পড়েন। সবশেষে সাজা ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। হবিগঞ্জের তিন রাজাকারের রায়ে বলা হয়েছে, সরকার ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে বা গুলি করে মহিবুর রহমানের দ- কার্যকর করতে পারবে। তিন আসামি বানিয়াচং উপজেলার মহিবুর রহমান ওরফে বড় মিয়া, মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া এবং আব্দুর রাজ্জাক রায়ের সময় কাঠগড়াতেই উপস্থিত ছিলেন। তারা তিনজনই একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। সে সময় হবিগঞ্জের কয়েকটি গ্রামে তারা যেসব মানবতাবিরোধী কর্মকা- ঘটান তা এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে। এ রায়ে ‘সন্তুষ্ট নন’ জানিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মাসুদ রানা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, তারা আপীল করবেন। নিয়মানুযায়ী এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপীলের সুযোগ পাবেন ট্রাইব্যুনালে দ-িত আসামিরা। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘তারা যে রাজাকার ছিল তা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। এ রায়ে আমরা আনন্দিত। তাদের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় জাতি খুশি হয়েছে।’ যে অভিযোগে সাজা ॥ প্রসিকিউশনের আনা চারটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম ঘটনায় হত্যা, দ্বিতীয় ঘটনায় অগ্নিসংযোগ-লুটপাট, তৃতীয় অভিযোগে ধর্ষণ এবং চতুর্থ অভিযোগে ধরে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে প্রথম অভিযোগে বানিয়াচংয়ের খাগাউড়ায় মুক্তিযোদ্ধা আকল আলী ও রজব আলীকে হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য ট্রাইব্যুনাল মহিবুর রহমানকে মৃত্যুদ-, মুজিবর রহমান ও আব্দুর রাজ্জাককে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করেছে। অভিযোগ দুই-এ খাগাউড়ায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মেজর জেনারেল (অব) এমএ রবের বাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় মহিবুর রহমান, মুজিবুর রহমান ও আব্দুর রাজ্জাককে ১০ বছর করে কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। অভিযোগ তিন-এ খাগাউড়া এলাকার উত্তরপাড়ায় মঞ্জব আলীর স্ত্রী ও আওলাদ ওরফে আল্লাদ মিয়ার ছোট বোনকে ধর্ষণ। পরে আল্লাদ মিয়ার বোন আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় আসামি তিনজনকে ২০ বছর করে কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। সর্বশেষ অভিযোগ চার নম্বরে আনছার আলীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন। ওই নির্যাতনে পঙ্গু হন আনছার। এ ঘটনায় তিনজনকেই সাত বছর করে দ- প্রদান করা হয়েছে। আসামিদের পরিচয় অভিযোগপত্রের তথ্যানুযায়ী, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের কুমুরশানা গ্রামের মহিবুর রহমানের জন্ম ১৯৫০ সালে। তার ছোট ভাই মুজিবুর রহমান জন্ম নেন ১৯৫৫ সালে। মহিবুরকে এলাকার মানুষ চেনে বড় মিয়া নামে আর মুজিবুরের পরিচিতি আঙ্গুর মিয়া নামে। বানিয়াচংয়ের সন্দলপুর বিসি হাই স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন মহিবুর আর মুজিবুর খাগাউড়ার ঢুলিয়া ঘাটুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। তারা দুই ভাই একাত্তরে ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষের দল নেজামে ইসলামীর স্থানীয় নেতা সৈয়দ কামরুল আহসানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী। অন্যদিকে বানিয়াচংয়ের খাগাউড়ার হোসেনপুর গ্রামের মোঃ আব্দুর রাজ্জাকের জন্ম ১৯৫২ সালে। তিনি মহিবুর-মুজিবুরের চাচাত ভাই। রাজ্জাকের প্রতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেই বলে প্রসিকিউশনের দেয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। চাচাত ভাইদের মতো রাজ্জাকও ছিলেন নেজামে ইসলামীর নেতা সৈয়দ কামরুল আহসানের অনুসারী। একাত্তরে রাজ্জাকও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে সক্রিয় হন।
×