ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঢাকা বইমেলা, পাঠকের প্রতীক্ষা শেষ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১ জুন ২০১৬

পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঢাকা বইমেলা, পাঠকের প্রতীক্ষা শেষ

মোরসালিন মিজান ॥ কেমন হলো ঢাকা বইমেলা? উত্তর- যেমন হয়। এই যেমন হয় কথাটির ব্যাখ্যা এখন আর কারও অজানা নয়। হ্যাঁ, প্রাণহীন বিবর্ণ একটি আয়োজন। আজ এখানে। কাল ওখানে। যেন শহর পরিভ্রমণ। এবারের মেলাটি স্থানান্তরিত হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমিতে। জাতীয় চিত্রশালা প্লাজার খোলা জায়গাটিতে স্টল সাজানো হয়েছিল। মেলার আয়োজক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। সহায়তা করছে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি। সপ্তাহব্যাপী নিরীক্ষা মঙ্গলবার শেষ হয়েছে। এবার আরও শ্রীহীন, বিচ্ছিন্ন একটি চেহারা। তবে কিছু মানুষ প্রকৃতই বইপ্রেমিক। এই প্রকৃত বইপ্রেমীদের জন্য বাড়তি প্রচারের দরকার হয়নি। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই এসেছেন তারা। দুই দশজন মাত্র। তাতে কী? বই এবং বইপ্রেমীদের দেখে ভাল লেগেছে। ঢাকা বইমেলার এই ছিল প্রাপ্তি। এবার মেলা শুরু হয়েছিল গত ২৫ মে। প্রথম দিন আনুষ্ঠানিকতা ছিল। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ছিলেন অনুষ্ঠান মঞ্চে। এসব প্রচারের আওতায় এসেছে। পরের দিন থেকে পাঠক আসবেন- এমন আশা ছিল। সেভাবেই বই দিয়ে স্টল ভর্তি করেছিলেন প্রকাশকরা। প্রতিটি স্টলেই শত শত বই। নানা বিষয়ে লেখা। কিন্তু না পাঠকের দেখা নেই। নেই আর আছে হয়নি। আরও নেই হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ছিল এক দৃশ্য। স্টলের সামনে বই বিছিয়ে দিয়ে ভেতরে বিক্রেতা। কিন্তু বিক্রির দেখা নেই। পাঠকের অপেক্ষায় থেকে থেকেই সমাপনী দিন! মেলার শেষ দিন বিকেলে চিত্রশালা প্লাজায় গিয়ে দেখা যায়, শূন্যতা গিলে খাচ্ছে সব। কোন কোন স্টল আগেভাগেই গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। খোলাই হয়নি কোন কোনটি। স্টলের দায়িত্বে থাকা ছেলে মেয়েরা একত্রিত হয়ে আড্ডা গল্প জমানোর চেষ্টা করছেন। বাকিরা ঘুমে অচেতন। বসে বসেই ঘুমোচ্ছিলেন। বইয়ের একটি মেলার এমন চিত্র দেখে মন সত্যি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বিষণœ মন নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান ইউপিএলের বই যারপরনাই সুনির্বাচিত। যে কোন অবস্থায় ভাল বিক্রি হয়। কিন্তু ঢাকা বইমেলায় হয়েছে শতভাগ উল্টোটি। স্টলের দায়িত্বে থাকা আল মামুন বললেন, বইয়ের বিক্রি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। উদ্বোধনী দিন কোন বিক্রি হয়নি। পরবর্তী দিনগুলোতে ১ হাজার টাকার বেশি বিক্রি করতে পারিনি। জনপ্রিয় লেখকদের বই প্রকাশ করে থাকে অনন্যা। এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টলের দায়িত্বে ছিলেন জয়নাল আবেদীন। তিনি বলেন, মেলায় হুমায়ূন আহমেদের ৪৫টি বই প্রকাশ করেছি আমরা। যে কোন মেলায় লেখকের ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার বই বিক্রি হয়। এখানে গত ছয় দিনে একটি বই বিক্রি করতে পেরেছি! হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য অন্য। এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হাবিব জানান, বই বিক্রি একবারেই খারাপ। হুমায়ূন আহমেদের বইও নামমাত্র গেছে। কিছু গেছে হরিশংকর জলদাসের। এভাবে প্রতিদিন হাজার টাকার বেচাবিক্রি। ছয় দিনে একটি বইও বিক্রি হয়নিÑ এমন স্টলও আছে। একটির নাম অংকুর। স্টলের দায়িত্বে থাকা মোঃ দুলাল বাইরে বাইরে ঘুরছিলেন। তাকে অন্যদের সহায়তায় খুঁজে নিতেই যেন বিব্রত হয়ে গেলেন। বললেন, দুইশর মতো বই নিয়ে এসেছিলাম মেলায়। একটি বইও বিক্রি হয়নি। এভাবে যার সঙ্গেই কথা বলা যায়, অভিন্ন তথ্য। অবশ্য মেলা ঘুরতে ঘুরতেই কিছু পাঠকের দেখা মিলল। এই পাঠক যে সে পাঠক নন। অসচেতনভাবে এখানে চলে এসেছেন বলে মনে হলো না। বইয়ের টানেই এসেছেন। কথা বলে তা আরও নিশ্চিত হওয়া গেল। আপন মনে বই দেখছিলেন শিল্প ব্যাংকের সাবেক জোনারেল ম্যানেজার আমজাদ হোসেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আগে একদিন এসেছিলাম। শেষ দিনে আবার আসলাম। বইয়ের সান্নিধ্য তো, ভাল লাগে। কিন্তু মেলাটি তো পাঠকশূন্য। কেমন লাগে এই ব্যাপারটা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনকার জেনারেশন বই পড়ে না। প্রিন্টেড কিছুতেই তাদের কোন আগ্রহ নেই। আমরা বই পড়ে অভ্যস্থ। এখনও বই ছাড়া চলে না। তাই আসি। মেলায় বইয়ের সংগ্রহ কেমন? জানতে চাইলে একটি স্টল থেকে বই হাতে নিয়ে প্রতিবেদকের চোখের সামনে ধরেন তিনি। বলেন, খাদিম হোসেন রাজার বই। অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনা ইত্যাদি তিনি লিখেছেন। কত যে তথ্য। এমন আরও বহু বই আছে। কিন্তু এই জেনারেশন না পড়লে ভাল বই দিয়ে কী হবে? তরুণ প্রজন্মের প্রতি এই যে হতাশা, অস্বীকার করার সুযোগ কই? তবে কিছু ব্যতিক্রমও চোখে পড়ল। শুধু ব্যতিক্রম নয়। আশা জাগানীয়া। প্রবীণ পাঠকের অভিযোগ শতভাগ সত্য নয়Ñ এমনটি বলতেই যেন মেলায় উপস্থিত হয়েছিলেন নওরীন ও নাতাশা। নীরবে ঘুরে ঘুরে বই দেখছিলেন এই প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি। যেটা পছন্দ, কিনছিলেন। এভাবে দু’জনের হাতেই যখন বই ভর্তি, কথা হলো তাদের সঙ্গে। পরিচয় জেনে অবাক হতে হলো। উভয়ই ডাক্তার। বারডেম হাসপাতালে আছেন। এবং বইয়ের পোকা। ডাক্তাররা ব্যস্ত থাকেন। একাডেমিক বইয়ের বাইরে যান না। এমন প্রচলিত ধারণা পুরোপুরি সত্য নয় জানিয়ে ডাঃ নওরীন বলেন, আমার মা বই পড়েন। সেখান থেকে আমি কিছুটা পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথ পড়ে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারি। হুমায়ূন আহমেদও বেশ লাগে। এর পর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাঃ নাতাশাকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ও কিন্তু সব ধরনের বই পড়ে। নাতাশা নিজে আরও সুন্দর বললেন। বললেন, আমি সর্বভুক। সব বই পড়ি। এ ক্ষেত্রে কোন বাধাই শেষমেশ বাধা হতে পারে না। তিনি জানান, পত্রিকায় ঢাকা বইমেলার খবর পড়েছিলেন। তার পরদিনই এসেছিলেন একবার। আজ আবার এসেছেন। আধুনিক এই সময়েও বই কেনা এবং দেখা দুটোই তারা উপভোগ করেন বলে জানান। হ্যাঁ, এই পাঠকরাই প্রকৃত। ঢাকা বইমেলার আয়োজকদের ভুল-ত্রুটি সীমাবদ্ধতার কথা অনেক হয়েছে। তার চেয়ে নওরীন নাতাশাদের কথা হোক। এটা অনেক বেশি স্বস্তির।
×