ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কোম্পানির নামে ইচ্ছেমতো টাকা আদায় ;###;মহানগর, হাইওয়ে, শিল্প পুলিশের জড়িত থাকার অভিযোগ ;###;নেপথ্যে প্রভাবশালীরা ;###;ওয়েস্কেল ও ফেরিঘাটে অনির্ধারিত চাঁদা ;###;সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নামে গাড়িপ্রতি ১০ টাকা বাধ্যতামূলক

পথে পথে চাঁদাবাজি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১ জুন ২০১৬

পথে পথে চাঁদাবাজি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঘটনা প্রায় দুই সপ্তাহ আগের। মালিক সমিতি-শ্রমিক নেতাদের চাঁদা পরিশোধের পর বেনাপোল থেকে পণ্য নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা দেয় ঢাকা মেট্রো-ট-এ-১১-৫১৪৯ নম্বর ট্রাকটি। পথে হাইওয়ে পুলিশকেও টাকা গুনতে হয়েছে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটেও চাঁদা বাধ্যতামূলক। সর্বশেষ মানিকগঞ্জ ওয়েস্কেলেও ট্রাকটি আটকানো হয়। মধ্যরাতে ট্রাকটি আটকিয়ে বাড়তি পণ্য পরিবহনের অভিযোগ আনা হয় চালকের বিরুদ্ধে। মাপার পর ওজন হয় ১৫ টন। অথচ গাড়িসহ ২০ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন বৈধ। এরপরও চাঁদা দাবি করেন ওয়েস্কেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নিয়মের মধ্যে থাকায় ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানান চালক আবুল বাশার। এ নিয়ে বাগবিত-া। এক পর্যায়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ করেন চালক। শেষ পর্যন্ত ৮০০ টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়া পান তিনি। সড়ক-মহাসড়কে পরিবহন চাঁদাবাজির চিত্র ঠিক একই রকম। সারাদেশে পরিবহন চাঁদাবাজির ঘটনা অনুসন্ধানে সবচেয়ে বেশি কোম্পানির নামে ইচ্ছেমতো চাঁদাবাজির তথ্য মিলেছে। পণ্যবাহী পরিবহনে ঢাকা-চট্টগ্রাম-বেনাপোল ও সিলেট মহাসড়কে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। দেশের সব ফেরিঘাট, ওয়েস্কেলে ইচ্ছেমতো চাঁদাবাজি হচ্ছে। হাইওয়ে, শিল্প পুলিশসহ চাঁদাবাজির অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেও। পরিবহন মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা, ভূঁইফোর রাজনৈতিক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ বিস্তর। অনেক ক্ষেত্রে পরিবহন মালিকরা কার্যত অসহায়। তবে তারা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চাঁদাবাজি বন্ধ হলে স্তরে-স্তরে চাঁদা দেয়ার লাগাম টেনে ধরা অনেকটাই সম্ভব। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধেরও দাবি জানিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি মল্লিক ফখরুল জনকণ্ঠকে বলেন, পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আমার নিয়মিত বৈঠক হয়। তারা কখনও হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে হয়রানি বা চাঁবাজির অভিযোগ করেননি। সড়ক-মহাসড়কে কোন চালক যেন অকারণে পুলিশের হয়রানির শিকার না হয় এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। এর পরও যদি কেউ অনৈতিক কাজে জড়িত থাকেন কিংবা প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে সেই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ব্যাপারে কোন আপোস করা হবে না বলে জানান তিনি। পণ্যবাহী পরিবহনে তিন সড়কে চাঁদাবাজি ॥ পরিবহন মালিক, শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পণ্যবাহী পরিবহনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-বেনাপোল ও সিলেট সড়কে। মূলত কয়েকস্তরে পণ্যবাহী পরিবহন থেকে চাঁদা তোলা হয়। ফেরিঘাট, জেলা পুলিশ, ওয়েস্কেল, প্রভাবশালীদের ভাতা, মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদায় যায় সবচেয়ে বেশি অর্থ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেনাপোল থেকে একটি ট্রাক ঢাকা আসার পথে প্রথমে স্থানীয়ভাবে পরিবহন মালিক, শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতাদের টাকার ভাগ গুনতে হয়। এরপর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে বিআইডব্লিউটিএ-বিআইডব্লিউটিসি’র নির্দিষ্ট চাঁদা পরিশোধ করার পাশাপাশি সিরিয়ালসহ নানা কায়দায় ট্রাকপ্রতি ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা বাড়তি গুনতে হয়। দ্রুত গন্তব্যে আসা ও পণ্যের ক্ষতির কথা চিন্তা করে বাড়তি অর্থ পরিশোধ করা ছাড়া বিকল্প কিছু না থাকার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। চালকসহ মালিকদের অভিযোগ, বাড়তি অর্থ স্থানীয় পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হাতে যায়। সর্বশেষ মানিকগঞ্জ ওয়েস্কেলে ছয় চাকার ট্রাকের ক্ষেত্রে গাড়িসহ ২০ টন ওজন বৈধ হলেও নানা কায়দায় বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে প্রতিদিন। এখানে গাড়ি প্রতি ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা নেয়ার অভিযোগ করেছেন পরিবহন নেতারা। হাইওয়ে ও জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে পণ্যবাহী পরিবহনে হয়রানির অভিযোগ এনে মালিকরা বলছেন, নানা অজুহাতে মামলা হয় পণ্যবাহী পরিবহনের বিরুদ্ধে। গাড়ি ঠিক থাকলেও মামলাসহ হয়রানির নজির অহরহ। অর্থাৎ টাকা না দিলেই এসব হয়রানি নীরবে সহ্য করতে হয়। টাকা দিলে মামলাও হয় না, হয়রানিও নেই। দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে পণ্যবাহী পরিবহনগুলো। পরিবহন নেতারা জানিয়েছেন, কাউড়াকান্দি ও শরীয়তপুর ঘাটে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম দুদু পরিবহন চাঁদাবাজির অন্যতম হোতা। তিনি আবার দক্ষিণবঙ্গ বাস মালিক সমিতি সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক। তার নেতৃত্বে ঘাটে চাঁদাবাজি হয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ডভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির মহাসচিব আব্দুল মোতালেব মহাসড়কে সব ওয়েস্কেলে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও বেনাপোল রুটে সবচেয়ে বেশি চাঁদা গুনতে হয়। দাউদকান্দি-বারবকুন্ড, সিলেট ও মানিকগঞ্জে স্থাপিত ওয়েস্কেলে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে তিনি বলেন, মালিকরা পণ্যবাহী পরিবহনে চাঁদা গুনতে গুনতে এখন অস্থির। ইচ্ছেমতো বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদা দিতে হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিতে হয় দেশের বিভিন্ন ফেরিঘাটগুলোতে। তিনি বলেন, এক সময় কেন্দ্রীয় পরিবহনে নেতাদের উপর সবকিছু নির্ধারণ করা ছিল। স্থানীয় মালিক সমিতি ও ইউনিয়ন গঠনে সরকার বৈধতা দিয়েছে। তাই সব জেলা-থানা ও উপজেলায় এখন পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন সক্রিয়। তাই চাঁদাবাজির মাত্রাও বদলেছে। ঘটনা ৩১ মে মঙ্গলবার সকালের। বেনাপোল থেকে একই প্রতিষ্ঠানের পণ্য নিয়ে ঢাকার দিকে আসছিল পাঁচটি ট্রাক। খুলনা মেট্রো-ট-১১-১৪০৬, যশোর-ট-১১-০৮০৬, পিরোজপুর-ট-১১-০১৮২, চট্ট-মেট্রো-ট-১১-৫৩৯৯, ঢাকা মেট্রো-ট-১৬-১৭৮৪Ñএই নম্বরের ট্রাকগুলো মানিকগঞ্জ ওয়েস্কেলে পৌঁছানোর পর কর্তৃপক্ষ বাড়তি ওজন নিয়ে চলার অভিযোগ তোলে। প্রতিটি গাড়িতে সর্বোচ্চ ১২ টন মাল ছিল। নিয়ম অনুযায়ী গাড়িসহ সর্বোচ্চ ওজন ২০ টনের মধ্যে হতে হবে। নির্ধারিত ওজনের কম থাকলেও ট্রাকগুলো ছাড়তে রাজি ছিলেন না ওয়েস্কেল কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত ট্রাকপ্রতি এক হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়ে ঢাকায় আসেন চালকরা। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানির লোকজন। বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাক চালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিল্লাত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আগের চেয়ে চাঁদাবাজির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। তিনি বলেন, পুলিশ রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি করলে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নামে চাঁদা তোলা হয়। আমি মনে করি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিবহন চাঁদা তোলা বন্ধ করলে মানুষও সাহস পাবে না। এখন একজন চাঁদা নিলে অনেকেই উৎসাহিত হয়ে তুলতে শুরু করেন। শ্রমিক নেতারাও চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্যবাহী পরিবহনে সবচেয়ে বেশি চাঁদা তোলা হয়। গাড়ির কাজগপত্রের নামে, কিংবা গাড়ির রঙ ঠিক নেই এমন অভিযোগ তুলেও পুলিশ চাঁদা নেয় বলেও জানান তিনি। এক্ষেত্রে চালকরা টাকা দিতে বাধ্য। অন্যথায় মামলা দেয়ার হয় বলে অভিযোগ করেন এই শ্রমিক নেতা। চাঁদার হাট গুলিস্তানে ॥ রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় জমজমাট পরিবহন চাঁদাবাজি। অনেকের মতে রীতিমতো চাঁদার হাট বসে এই এলাকায়। বছরের পর বছর একশ্রেণীর রাজনৈতিক সুবিধাভোগী মানুষ বিভিন্ন কোম্পানির নামে চাঁদাবাজি চালিয়ে আসছেন। তাদের কর্তৃত্বের কাছে অসহায় সাধারণ বাস মালিকরাও। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গুলিস্তান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি বাস যাতায়াত করে। সাধারণ মালিকরা বলছেন, বিভিন্ন রুটে প্রভাবশালী কয়েকজন মিলে নানা নামে বাস সার্ভিস চালু করেছেন। গঠন করেছেন মালিক সমিতি। অথচ এমনও সমিতি আছে যাদের কোন নেতার নামে একটি বাসও নেই। কোনটির আছে নামে মাত্র। কিন্তু সমিতির নিয়ন্ত্রণে চলা বিভিন্ন কোম্পানির নামে অনেকেই গাড়ি দিয়েছেন। এ সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এখন এসব গাড়ি থেকে নামে বেনামে নেতারা চাঁদা তুলছেন। মালিকদের অভিযোগ, গুলিস্তান থেকে তারাবো লাইনে শ্রাবণ, হিমালয় পরিবহনসহ ৩০০’র বেশি বাস নিয়মিত যাতায়াত করছে। বাসপ্রতি দিনে চাঁদা নেয়া হয় ৮০০ টাকারও বেশি। মাওয়া ও গাউসিয়া রুটে চলা মেঘালয় ট্রান্সপোর্ট, আসিয়ার পরিবহন, ইলিশ, গ্লোরী, মেঘলা, বোরাকসহ সব ধরনের পরিবহনকেই চাঁদা দেয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক এই এলাকায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গোটা গুলিস্তানের পরিবহন সামাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন বাতেন বাবু। যিনি ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট। তার পক্ষে চাঁদা তোলেন টুটুল নামে এক ব্যক্তি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন (৪৯৪) এর নেতা রহমান মারোয়ারি পরিবহন চাঁদাবাজির আরেক নিয়ন্ত্রক। মহা-ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে তিনি পরিচিত। অনেকেই পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তার আত্মীয় পরিচয় দিয়েও চাঁদাবাজি করছেন বছরের পর বছর। আট ভাগে চাঁদা দিতে হয় সায়েদাবাদের মালিকদের ॥ একটি গাড়িকে প্রতিদিন আট ভাগে চাঁদা গুনতে হয়। অন্যথায় পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকে। এমন তথ্যই জানিয়েছেন সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন রুটের পরিবহন মালিকসহ শ্রমিকরা। তারা বলছেন, চাঁদাবাজি মাত্রার রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ছোট ছোট পরিবহন মালিকদের এখন টিকে থাকাই দায়। সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি বাসকে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির নামে ১২০টাকা দিতে হয়। সিটি করপোরেশনের নামে ৬০ টাকা। টার্মিনাল কমিটির নামে ২০ টাকা। যানজট নিরসনের নামে ১০ টাকা। শ্রমিক ইউনিয়নের নামে আরও ৬০ টাকা। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি মালিকদের দিতে হয় ১০০ টাকা পর্যন্ত। মালিকদের অভিযোগ, পুলিশের চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। যা অতীতের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। তারা বলছেন, সায়েদাবাদ থেকে একটি গাড়ি গাজীপুর যাওয়া পর্যন্ত রাস্তায় যতগুলো পুলিশ বক্স আছে প্রত্যেকটিকে মাসে কিংবা সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। প্রতিটি পুলিশ বক্সের একজন এসি, সার্জেন্ট, টিআইসহ সবাই টাকার ভাগ পান। কিভাবে এই টাকা সংগ্রহ হচ্ছে? জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের পক্ষ থেকে এজেন্টরা সপ্তাহ কিংবা মাসিক হারে এই টাকা মালিক সমিতি থেকে সংগ্রহ করেন। এছাড়াও রাজনৈতিক দলের নামে সায়েদাবাদ-গাজীপুর থেকে চাঁদা দেয়ার কথা জানিয়েছেন মালিকদের অনেকেই। তাদের অভিযোগ, শ্রমিকদের কল্যাণে গাজীপুরে শ্রমিক কমিটির ব্যানারে প্রতিদিন গাড়ি প্রতি ৪০ টাকা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া বিআরটিএ ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়ার সময় সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়। গাড়ি ভাল থাকলেও সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে দ্বিগুণের বেশি টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট আনার কথা জানান তারা। এছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে হাইওয়ে ও শিল্প পুলিশের নামে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে বিপ্লবী সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ছত্রছায়ায় রাজধানীর সব বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এর নেপথ্যে আছেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্য পর্যন্ত। বেশিরভাগ চাঁদাবাজি হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে। পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নামে সায়েদাবাদ, ফুলবাড়িয়া, গাবতলী ও মহাখালীতে যারা চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের নামও উল্লেখ করেন এই শ্রমিক নেতা। বাস থামিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে বগুড়া ও কক্সবাজার সড়কে ॥ ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী বিভিন্ন পরিবহনে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ মিলেছে। বাস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলছেন, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটের বাসগুলো বগুড়ায় চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। হাইওয়েতে বাস থামিয়ে বগুড়া শ্রমিক কমিটির নামে নেয়া হয় এই অর্থ। শ্রমিক কমিটির নেতা লতিফ ও তার ছেলে স্থানীয় বাস মালিক সমিতির নেতার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গাড়িপ্রতি নেয়া হয় ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। রিক্সা ও মোটরসাইকেল ছাড়া সব পরিবহন থেকেই চাঁদা আদায় হচ্ছে। কোন কোম্পানির পক্ষ থেকে নতুন বাস নামানো হলে প্রথমে বিপুল অঙ্কের টাকা দিতে হয় তাদের। পরিবহন চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, মাওয়া-কাউড়াকান্দিসহ দেশের বিভিন্ন ফেরিঘাটে পরিবহন চাঁদাবাজি হচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী, পুলিশ প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএ-বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তারা চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত। ঘাটে প্রতিটি পরিবহন থেকে ৯০০ টাকার স্থলে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। বিএনপি আমলের চেয়ে পরিবহন চাঁদাবাজির পরিমাণ এই সরকারের আমলে কম দাবি করে এনায়েত উল্যাহ বলেন, তবুও যেসব এলাকায় চাঁদাবাজি হচ্ছে সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা চাচ্ছি। পরিবহন সেক্টরে অবৈধ অর্থের লেনদেন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা চাই না দেশের কোথাও পরিবহনে চাঁদাবাজি হোক। এর বিরুদ্ধে আমরা সবাই কঠোর অবস্থান নিয়েছি। গোটা পরিবহন সেক্টরকে শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে এমন দাবি করে তিনি বলেন, গত ৬/৭ বছরে পরিবহন চাঁদাবাজি নিয়ে কোথাও খুনোখুনিসহ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এতেই প্রমাণিত হয়- এই সেক্টরের চাঁদাবাজির দৌরাতœ্য নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তিনি বলেন, অনেকেই অনেক তথ্য দিলেও প্রতিদিন ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি বাস প্রতি ৪০ টাকা পাচ্ছে। এই অর্থ পরিচালন ব্যয় হিসেবে নেয়ার কথা জানান তিনি। লাকসামে কোম্পানির নামে বেপরোয়া চাঁদা ॥ কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুরসহ আশপাশের জেলাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবহন চাঁদাবাজি হয় লাকসাম এলাকায়। এখানে কুমিল্লা-লাকসাম রুটে চলা একটি পরিবহন থেকে গাড়িপ্রতি নেয়া হচ্ছে এক হাজার ৬০০ টাকা। অন্যান্য পরিবহন থেকে নেয়া হয় এক হাজার ২০০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানির নামে এই অর্থ আদায় হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় কোম্পানি করার পর অনেকেই গাড়ি কিনেছেন। সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নামে চলছে ব্যক্তিমালিকানাধীন পরিবহন। এই সুযোগে মালিক সমিতির লোকজন অন্য মালিকদের থেকে অনেকটাই জোরপূর্বক জিবি’র নামে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করছেন। গাবতলীতেও স্তরে-স্তরে চাঁদাবাজি ॥ গাবতলী এলাকা থেকে সাধারণত ঢাকার আশপাশের জেলাসমূহে চলা পরিবহন থেকে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হয়। দূরপাল্লার রুটের বাসগুলোতে তেমন একটা চাঁদাবাজির অভিযোগ মেলেনি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনুমোদনহীন রুট ও বাস থেকে সবচেয়ে বেশি চাঁদা আদায় হয় এই টার্মিনাল থেকে। প্রথমে পার্কিংয়ের জন্য রাখা হয় ৪০ টাকা। যা বৈধ বলেই চালু। এছাড়া টার্মিনালের ভেতর থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসপ্রতি গুনতে হয় ৩২০ টাকা। গাবতলী থেকে সাভার পর্যন্ত চলা বাসপ্রতি চাঁদা গুনতে হয় ১৩০ টাকা। মানিকগঞ্জে ২৮০, পাটুরিয়া ও আরিচাঘাট পর্যন্ত দিতে হয় ৩৩০টাকা, মানিকগঞ্জ পর্যন্ত চলা শুভযাত্রা পরিবহনকে গুনতে হয় ৬৩০ টাকা। গাবতলী থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত প্রভাবশালী কয়েকজন মিলে অবৈধভাবে বাস চালাচ্ছেন। যা বিআরটিএ থেকে অনুমোদিত নয়। এই রুটে প্রতিবাস থেকে ২৩০ টাকা, নবীনগর, হেমায়েতপুর ও জিরানি পর্যন্ত তিন স্তরে টাকা নেয়া হয়। ধামরাই রুটে ২৮০ টাকা চাাঁদা নেয়া হয়। ভিলেজ লাইন পরিবহন থেকে গাবতলীতে ৩২০ ও ঘিওরে ২৫০ টাকা নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও সুকতারা পরিবহন, আনন্দ সুপারসহ সিঙ্গাইর রুটে চলা পরিবহনগুলো থেকে সর্বোচ্চ ৫৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হচ্ছে। ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের নব-নির্বাচিত সভাপতি শওকত হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, গাবতলী টার্মিনালসহ আশপাশের এলাকায় পরিবহন চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করেন দু’জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাদের একজন হলেন জাতীয় পার্টির নেতা ও বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি মফিজুল হক বেবু অপরজন হলেন ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের স্বঘোষিত সভাপতি আব্বাস উদ্দিন। তাদের পেছনে রয়েছেন স্থানীয় একজন সংসদ সদস্য। মূলত সংসদ সদস্যদের ছত্রছায়ায় এসব চাঁদাবাজি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
×