ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বুড়িগঙ্গা হবে হাতিরঝিল!

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১ জুন ২০১৬

বুড়িগঙ্গা হবে হাতিরঝিল!

রাজধানীর প্রাণপ্রবাহ বুড়িগঙ্গা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে দীর্ঘদিন থেকে। এ বিষয়ে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই যে, রাজধানী হিসেবে ঢাকার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে যে কোন মূল্যে, যে কোন উপায়ে বাঁচিয়ে তুলতে হবে বুড়িগঙ্গাকে। মানবসভ্যতা সর্বদাই নদ-নদীবাহিত। সেই সুদূর চার শ’ অথবা ততধিক বছর আগে স্বচ্ছসলিলা স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গার তীরে পত্তন হয়েছিল ঢাকার। প্রাচ্যের অন্যতম রহস্যনগরী হিসেবে যার খ্যাতি। ভুবনবিখ্যাত মসলিনসহ শায়েস্তা খাঁর আমলে অত্যন্ত সস্তায় নিত্যপণ্য প্রাপ্তির সুবাদে একদা ঢাকা পেয়েছিল আন্তর্জাতিক সুনাম। অতঃপর ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই, অলিগলি পেরিয়ে ঢাকা এখন মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী। এত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন সত্ত্বেও সর্বাধিক যেটা দুঃখজনক ও মর্মান্তিক তা হলো, ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা এখন মৃতপ্রায়। একেই তো শীর্ণ তনু, ততধিক ক্ষীণ প্রবাহ, বিবর্ণ কালো বর্ণের পঙ্কিল পানি, ভাসমান ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ, অবরুদ্ধপ্রায়। প্রকৃতপক্ষে যা একটি বড়সড় নর্দমা বলেই প্রতিভাত হয়। সেই প্রায় প্রাণহীন স্তব্ধপ্রায় দুর্গন্ধকবলিত বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে কোন স্বপ্ন দেখা দুঃস্বপ্নের নামান্তর বৈকি। তবু বাস্তবতা হলো মানুষ স্বপ্ন দেখে নিরন্তর। এরই একটি নমুনা বোধ করি বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে আরও একটি হাতিরঝিল নির্মাণের স্বপ্ন। ঢাকা ইনটিগ্রেটেড আরবান ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড স্মার্ট সিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় নেয়া হয়েছে এই প্রকল্প। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করবে বিশ্বব্যাংক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। পরামর্শ সংস্থা নিয়োগও প্রায়। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে শিকদার মেডিক্যাল থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত নদীর দু’পারের আধুনিকায়ন, দু’পাশে সিরামিকের তৈরি ওয়াকওয়ে, পর্যটকদের জন্য বিনোদন সুবিধা সংবলিত বিলাসবহুল প্রমোদতরী, বিনোদন পার্ক, অবকাশ যাপনের জন্য আলিশান রিসোর্ট, হোটেল-রেস্তরাঁ সর্বোপরি সর্বাধুনিক নৌবন্দর ও টার্মিনাল। উপরোক্ত পরিকল্পনা যে খুব অভিনব, আকর্ষণীয়, চিত্তাকর্ষক ও দুর্দান্ত এ কথা বলতে হবে এক বাক্যে। তবে এর জন্য সর্বাগ্রে যা করণীয় তা হলো একদার কল্লোলিনী স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গার পরিপূর্ণ পুনরুদ্ধার, যা এক কথায় দুরূহ ও অসম্ভব। কেননা, ভূমিগ্রাসীদের অবৈধ হিংস্র থাবায় ইতোমধ্যেই বুড়িগঙ্গার দুই তীরের অধিকাংশ জমি চলে গেছে বেদখলে। সেসব স্থানে গড়ে উঠেছে বড় বড় অসংখ্য স্থাপনা ও বহুতল ইমারত। সময় সময় সেসবের কিয়দংশ উচ্ছেদ করা হলেও অচিরেই তা চলে যায় দখলদারদের কবলে। কোন কোন স্থাপনা উচ্ছেদ স্পর্শকাতরও বটে। সেক্ষেত্রে দু’পাশের অবৈধ স্থ্পানাগুলো উচ্ছেদ করা না গেলে নদীর প্রবাহ অক্ষুণœ রাখা সম্ভব হবে না কিছুতেই। মনে রাখতে হবে এক সময় বৃষ্টি ও বর্ষার মৌসুমে বুড়িগঙ্গার দু’কূল প্লাবিত হতো। দু’তীরে ছিল সবুজে সবুজ, শ্যামলে শ্যামল। শুভাঢ্যা-কেরানীগঞ্জে হতো চাষবাস। জেলেরা মাছ ধরত। বর্তমানে সেই বুড়িগঙ্গা কেবলই দীর্ঘশ্বাস ও দূষণকবলিত। সেক্ষেত্রে বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করা জরুরী ও অপরিহার্য। হাজারীবাগ ট্যানারি শিল্প নিঃসৃত যাবতীয় কঠিন ও তরল বর্জ্য এককভাবে বুড়িগঙ্গার ৩০ শতাংশ দূষণের জন্য দায়ী। এই বর্জ্য আবার নানা রাসায়নিকে রঞ্জিত ও বিষাক্ত। এর বাইরেও রয়েছে দু’পাশের যাবতীয় নালা-নর্দমা-স্যুয়ারেজ লাইন। নানা শিল্প-কারখানার বর্র্জ্য। বুড়িগঙ্গায় যাবতীয় কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষেপ অনতিবিলম্বে বন্ধ করা না গেলে নদী পুনরুদ্ধার অধরাই থেকে যাবে। উদাহরণ হিসেবে যে হাতিরঝিলের কথা বলা হয়েছে, সেখানে এর মধ্যেই নানা অনিয়ম-অব্যবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেসব বন্ধ করতে হবে অবিলম্বে। বুড়িগঙ্গাকেও সর্বাগ্রে পুনরুদ্ধার করতে হবে, নাব্য পূর্বাবস্থাসহ। এর পরই না হয় অন্যান্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা নির্মাণ, সবুজায়ন, পার্ক ও বিনোদন ব্যবস্থা, থ্রিস্টার-ফাইভস্টার হোটেল! তা না হলে ‘পরি’ ‘কল্পনা’ হয়ে অচিরেই উড়ে যাবে আকাশে!
×