ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জয় বাংলা যেভাবে ছিনতাই হয়ে যায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ১ জুন ২০১৬

জয় বাংলা যেভাবে ছিনতাই হয়ে যায়

বেশ কয়েক বছর ধরেই নারায়ণগঞ্জ মুক্তাঞ্চল। ১৯৭১ সালে মুক্তাঞ্চল শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। সেই সময় শত্রুকবলিত দেশে মুক্তাঞ্চল সৃষ্টির খবর আনন্দের নহর সৃষ্টি করত মানুষের মনে। মুক্তাঞ্চল মানে হানাদার পাকিস্তানীরা নেই। তাদের নফর আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটি নেই। মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করছে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই। এখন উল্টোটা। মুক্তাঞ্চলের নাম শুনলে বুকে কাঁপন ধরে। স্বাধীন দেশের ওই সব মুক্তাঞ্চলে কেন্দ্রের শাসন অচল। দলীয় শৃঙ্খলা অচল। সিভিল সমাজের শাখাগুলো নিশ্চুপ। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসন মুক্তাঞ্চলের প্রতিনিধিদের সেবার জন্য সদাজাগ্রত থাকে। কেন্দ্রীয় সরকার বা সরকারী দলের নেতারা কি এসব জানেন না? বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু একটি কারণে সেগুলো না দেখার ভান করেন। সেই কারণটি, নেতারা মনে করেন পাবলিক জানে না। পাবলিক বিলক্ষণ জানে। কারণটি টাকা। গৌণ কারণ দলের আধিপত্য বিস্তার। আসলে সেটি দলের নয়, নিজের আধিপত্য বিস্তার। বাংলাদেশে এ রকম অনেক মুক্তাঞ্চলের অধিপতি আছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কয়েক সংসদ সদস্যও। সংসদ সদস্যদের এই আধিপত্যের শুরু বিএনপি বা খালেদা জিয়ার আমল থেকে। সেই থেকে এর ধারাবাহিকতা অক্ষুণœœ। সাংসদরা আইন প্রণয়ন করবেন শুধু- এ রকম একটি প্রস্তাব আওয়ামী লীগ আমলে উঠেছিল। দলীয় নেতারা বাধা দিয়েছিলেন। কারণ সংসদ সদস্য পদ এখন একটি পেশা। এই পেশা লাভজনক না হলেও কোটি কোটি টাকা খরচ করে কেন কেউ সংসদ সদস্য হবেন? এই টাকা পদ পাওয়ার পর বহুগুণ বাড়ে। যেমন কক্সবাজারের এক সংসদ সদস্য। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী তার সম্পদ বেড়েছে ৩৫১ গুণ। (ভোরের কাগজ, ২৭.৫.১৬) বৃদ্ধি পাওয়া টাকা খরচ হয় ত্রাস বিস্তারে এবং সিভিল সমাজের পরিচিতি ব্যক্তি ও সম্মান ক্রয়ে। এরা অবশ্য জানেন না, কেন্দ্র যখন তাদের মনোনয়ন দেয় তখন ব্যক্তি হিসেবে বিচার করে না, করে সংখ্যা হিসেবে। কেননা, সংসদে যেতে হলে সংখ্যার বিচার হয়, ব্যক্তির বিচার হয় না। সুতরাং সংখ্যা কেনা হয়। এভাবে প্রতিটি দল থেকে আদর্শের বিষয়টি অন্তর্হিত হচ্ছে। ঢাকা বা বড় শহরের অধিবাসীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যান না। সুতরাং একেক এলাকার এমপির দাপটের সঙ্গে তাদের কোন ধারণা নেই। মধ্যযুগের মতো একেকটি এলাকার অধিপতি নব্য এই সামন্তরা। সেখানে কোন অনুষ্ঠান তার অনুমতি ছাড়া করা যায় না। ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের খবরও তাকে দিতে হয় বা আমন্ত্রণ জানাতে হয়। ঢাকার অধিবাসীরা বিষয়টি বুঝবেন না। এখানে মন্ত্রীদের খবরই কেউ রাখে না তা আবার এমপি! এদিক থেকে ঢাকার এমপিরা দুর্ভাগ্যের শিকার। মানুষকে অধীনে রাখার আনন্দটা তারা উপভোগ করতে পারলেন না। গত দুই যুগে কিছু এমপি এই কার্যকলাপ নিয়ে প্রচুর প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কিছুই হয়নি। কারণ তাদের আশ্রয় সংসদ। সেখানে মানুষকে নিয়ন্ত্রণের বা উপকারের অনেক পরামর্শ আলোচিত হয়। কিন্তু নিজেদের নিয়ে হয় না। ভারত, পাকিস্তানেরও অনেক অংশে এ চিত্র পাওয়া যাবে। তবে বাংলাদেশে হয়ত বেশি। সংসদ সদস্যরা কেমন সামন্ত অধিপতির মতো কাজ করেন তার অসংখ্য প্রতিবেদন ঘেঁটে একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট তৈরি করেছেন ঝর্ণা মণি, যা আমি উদ্ধৃত করছি। এই ধরনের লেখার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ধৃতিটি বড় কিন্তু আমার বক্তব্যের যথার্থতার জন্য এর প্রয়োজন আছে। নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের নজির টেনে প্রতিবেদন শুরু করেছেন ঝর্ণা মণি। ‘নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের এ ধরনের সন্ত্রাসী আচরণ নতুন কিছু নয়। এর আগে ওসমান পরিবারে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে দুটি ইউনিয়নের নিরাপত্তা ইনচার্জ এএসপি মোঃ বশিরউদ্দীন কেন্দ্র দখলে বাধা দিলে ওসমান তাকে টেলিফোনে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন ও হুমকি দেন। শঙ্কিত এএসপি জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেন। এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা জানতে গেলে শামীম তাদের বলেন, ‘সাংবাদিকরা হচ্ছে কুকুর। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন পাড়ার অনেকের পয়সা হলে কুকুর পুষত। ওদের বাড়ির সামনে গেলেই কুকুরগুলো মুখ ভেংচাত। এরপর তাদের আরও পয়সা হলো, তারা মিডিয়া পোষা শুরু করল। এগুলো হলো এ্যালসেশিয়ান কুকুর। প্রশিক্ষিত। লাথি দিলেও এগুলো কামড়াতে আসে।’ এরা জনগণের প্রতিনিধি। আইনপ্রণেতা। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক। তাদের কাছেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন সাধারণ জনগণ। ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের টিমে এই সংখ্যা কম হলেও তাদের দাপটে জনগণের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। একটি শিশুকে বেআইনীভাবে গুলি করে আলোচনায় আসেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব) গিয়াস উদ্দিন তার নিজ দলের সমর্থকদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করেন, যা সেসময় ছবিসহ ফলাও করে প্রচার হয়েছিল গণমাধ্যমে। তিনি প্রকাশ্যে সচিবালয়ের কর্মকর্তাকে হত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন। গত বছরের ৯ মে সিলেটের এক অনুষ্ঠানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে চাবুক মারার ইচ্ছা প্রকাশ করেন সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস। সংসদ সদস্যদের নামের জায়গায় ভুল করে অন্যের নাম উচ্চারণ করায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমার সিলাম নবারুন উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ফখরুল ইসলামকেও লাঞ্ছিত করেছিলেন মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। বরগুনার একজন সংসদ সদস্যের নির্দেশে একটি সালিশে এক গৃহবধূর মাথায় বিষ্ঠা ঢেলে দেয়া হয়েছে। বরগুনারই আরেকজন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে মারধর করেছেন। ময়মনসিংহে সংসদ সদস্যের নির্দেশে এক কলেজ শিক্ষককে দিগম্বর করে রাস্তায় ঘোরানো হয়েছিল। এ ছাড়া কথায় কথায় চড়-থাপ্পড় মারা যেন সংসদ সদস্যদের কারো কারো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। কলেজ চত্বরে গাছ কাটার অভিযোগে রাণীশংকৈল মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে চড় মেরেছিলেন ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। ট্রেনে ডিলাক্স রুমের টিকেট না পাওয়ায় স্টেশন মাস্টার আবদুর রশিদকে মারধর করেন পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। একই দিনে তিনি সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রহরী আমির আফজাল আলীকেও মারধর করেন। রাস্তার উন্নয়নের জন্য ডিও লেটার চাওয়ায় জামালপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ডাক্তার মুরাদ হাসানের হাতে প্রহৃত হন আওয়ামী লীগ নেতা আইনজীবী বদরুদ্দোজা বাহাদুর। খুলনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ননী গোপাল ম-লকে অতিথি না করায় তার হাতে দাকোপ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জয়ন্তী রানী সরদার লাঞ্ছিত হন।’ (ভোরের কাগজ, ২৭.৫.১৬) বিচ্ছিন্নভাবে যখন হঠাৎ হঠাৎ এ সংবাদ পড়ি তখন মনে হয় এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু একত্রে পড়লে কি সুস্থ একটি সমাজের চিত্র ফুটে ওঠে? আমি কারো সমালোচনা করছি না কিন্তু একটি প্রশ্ন তো করতে পারি। সবার জবাবদিহিতা চাওয়া হবে, সংসদ সদস্যদের জবাবদিহিতা থাকবে না? এটি কি গণতন্ত্র? গণতন্ত্র এদের হাতে কতটা নিরাপদ? সমষ্টিগতভাবেও সংসদের এ বিষয়ে কোন জবাবদিহিতা থাকবে না? বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সার্বভৌমত্ব সবার ওপরে এটি কি কথার কথা? এ সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত নির্যাতিতরা কোন প্রতিকার পাননি। সরকার, দল, প্রশাসন কেউ এদের আর্তনাদ শোনে না, শুনতে চায় না এবং এ সমস্ত হচ্ছে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে। যারা এসব করছেন তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল, যাদের মূল স্লোগান জয় বাংলা তারপর জয় বঙ্গবন্ধু। এ স্লোগানের আড়ালে যা করা হচ্ছে তা ৩০ লাখ শহীদ বা শহীদ বঙ্গবন্ধু নিশ্চয় অনুমোদন করতেন না। করলে, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করতেন না। এ অবস্থা শুধু এ আমলে তা মনে করবেন না। সব আমলেই এ অবস্থা ছিল। বিএনপি-জামায়াত আমলে আরও ভয়ঙ্কর ছিল। কিন্তু বিএনপি যা করে, জামায়াত যা করে, আওয়ামী লীগকেও তা করতে হবে? প্রশ্নটা এখানেই। ॥ দুই ॥ ফিরে আসি নারায়ণগঞ্জ প্রসঙ্গে। মুক্তাঞ্চল নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি ট্রাইব আছে। একেক আমলে একেক ট্রাইব ক্ষমতায় আসে এবং অন্যদের ছাড়খার করে দেয়। তবে শক্তিশালী ট্রাইব হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ওসমান ট্রাইব। এই ট্রাইবের পূর্বসূরিদের সুনাম ছিল। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার ট্রাইবের সুনাম সৃষ্টি করেছিলেন ম্যান্ডেলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি একবার বলেছিলেন, ওসমান পরিবার আমার পরিবার। তিনি বোধহয় মোস্তফা সরোয়ার পর্যন্ত সময়কে বিবেচনা করে বলেছিলেন। এখন যারা এই গোত্রের গোত্রপতি তাদের সময়কে বিচার করে বলেছিলেন কিনা সন্দেহ। বলে থাকলে তাদের সৌভাগ্য, আমাদের দুর্ভাগ্য। তারা কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছেন যে তাদের লক্ষ্য করেই এ শব্দাবলী উচ্চারিত হয়েছিল। ওসমান গোত্রপতিরা কিভাবে মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি করেছেন সেটি সবার জানা। এ জানাটা তাদের সুনাম বহন করে না। এটা তারা এখন অনুধাবন করবেন না, কারণ, তারা মাথা ঝিমঝিম রোগে আক্রান্ত। এ রোগটি এখন মহামারীতে পরিণত হচ্ছে। সামান্য ক্ষমতা বা অর্থ হলে বা কোন পদে গেলে জিকা ভাইরাসের মতো ঝিমঝিম ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। রোগের প্রধান লক্ষণ হয়- রোগীর সব সময় ইচ্ছে করে কাউকে চড় দিতে, পশ্চাৎদেশে লাথি মারতে, মাথায় গাট্টা দিতে, নিরস্ত্রকে কান ধরে ওঠাতে, বসাতে, খাবলা দিয়ে টাকা নিতে। নারায়ণগঞ্জের গোত্র অধিপতিরা নিজেকে রবিনহুড মনে করেন। আর তাদের মুগ্ধ প্রজারাও তা বিশ্বাস করেন। এ রকম একজন মুগ্ধ প্রজা ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন, সেলিম ওসমান ১৭টা স্কুল করবেন, মুক্তিযুদ্ধের কমপ্লেক্স করেছেন ইত্যাদি। আমার নামে যদি এ রকম কথা হতো তাহলে আয়কর বিভাগের আমলারা দোরগোড়ায় ঘাঁটি গেড়ে বসতেন। আধুনিক রবিনহুডদের টাকা আসে নূর হোসেনদের কাছ থেকে। আর তাদের সহায়তা করে প্রশাসন। ক্ষমতা বদল হলে গোত্র অধিপতি ‘ইন এক্সাইলে’ যান। সময়মতো ফিরে আসেন। (চলবে)
×