ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দোকানপাট এক ঘণ্টা বন্ধ রেখে ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩১ মে ২০১৬

দোকানপাট এক ঘণ্টা বন্ধ রেখে ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ প্যাকেজ ভ্যাট বহাল রাখার দাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশে একঘণ্টা দোকান বন্ধ রেখে মানববন্ধন করেছে ব্যবসায়ীরা। ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে চান না তারা। কিন্তু নতুন আইনে সব ধরনের ব্যবসা ও সেবার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। গত ২০১২ সালে করা আইনে ছোটবড় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সমান হারে ভ্যাট দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে বিশেষ ছাড়ের সুবিধা। তাই নতুন ভ্যাট আইন সংশোধন করে সেখানে প্যাকেজ ভ্যাটের নিয়ম সংযুক্ত করার দাবিতে খুচরা ব্যবসায়ীরা মিছিলও করেছেন। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যৌথ কমিটির ভ্যাট সংক্রান্ত বিষয়ে গৃহীত সাতটি সুপারিশ মেনে নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। সোমবার দুপুর বারোটা-একটা পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে এই কর্মসূচী পালন করেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি ও পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক সংগঠন ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের আহ্বানে শান্তিপূর্ণভাবে এই কর্মসূচী পালন করা হয়। মানববন্ধনের সময় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যান চলাচলে কিছুটা বিঘœ ঘটলেও পরে তা স্বাভাবিক হয়ে আসে। দেশের খুচরা ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির ঘোষিত কর্মসূচীর অংশ হিসেবে রাজধানীর শান্তিনগরে ইস্টার্ন প্লাস মার্কেটের সামনে কেন্দ্রীয়ভাবে এই কর্মসূচীতে অংশ নেন ব্যবসায়ীরা। মানববন্ধন পালনকালে ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরাম ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন পণ্য ও বাজারভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন। ফোরামের সভাপতি আবদুস সালাম সরকারের উদ্দেশে বলেন, এখনকার তুলনায় মূসকের পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। তা দিতে রাজি আছি। কিন্তু ১৫ শতাংশ হারে মূসক দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবু মোতালেব জানান, অনতিবিলম্বে প্যাকেজ ভ্যাট পুনর্বহাল করতে হবে। গুলিস্তান এলাকার শতাধিক মার্কেটের ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে এক ঘণ্টা রাস্তায় মানববন্ধন ও মিছিল করেছে। বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ওই এলাকার হাজার হাজার ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নেমে আসেন। ওই সময় তিনি বলেন, প্যাকেজ ভ্যাট পুনঃবহালের দাবিতে এই মানববন্ধন। খুচরা ও ছোট ব্যবসায়ীদের পক্ষে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রদান করা সম্ভব নয়। তাদের পক্ষে হিসাবরক্ষক রেখে ভ্যাটের হিসাব করা সম্ভব নয়। এছাড়া ভ্যাট আইন চালু হলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নে ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দিতে চান, এখনও দিচ্ছেন। ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য প্যাকেজ ভ্যাটই ভাল। এর বাইরে কিছু করা হলে ব্যবসায়ীরা তা মেনে নেবে না। ২০১২ সালে তৈরি হওয়া ভ্যাট আইন আগামী জুলাই মাসে শুরু হতে যাওয়া অর্থবছর থেকে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। এই আইনে অভিন্ন ১৫ শতাংশ হারে মূসক আদায়ের কথা বলা হয়েছে। আইনটি পর্যালোচনার জন্য গঠিত এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই যৌথ কমিটি সাতটি বিষয়ে একমত হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা ওই একমত হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্যাকেজ মূসক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে। এই দাবিতে আন্দোলনের জন্য পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরাম গঠিত হয়েছে। তাই পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা এই কর্মসূচীতে স্বতঃস্ফূতভাবে অংশ গ্রহণ করে। চকবাজারের মানববন্ধনে বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতি, বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্যাকেজিং রোল প্রস্তুতকারক মালিক ও বণিক সমিতি, বাংলাদেশ টয় মার্চেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড ইম্পোটার্স এ্যাসোসিয়েশন, চকবাজার বণিক সমিতি, বাংলাদেশ ইমিটেশন জুয়েলার ম্যানুফ্যাকচারার্স, এক্সপোর্টার্স এ্যান্ড মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশন, চকবাজার-মৌলভীবাজার প্রসাধনী ব্যবসায়ী সমিতি, চকবাজার ব্যাগ প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি, চকবাজার পাবলিক টয়লেট মার্চেন্ট মালিক সমিতিসহ কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠন ব্যানার নিয়ে অংশ নেয়। ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের উদ্যোগে রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে মানববন্ধন করা হয়েছে। প্যাকেজ ভ্যাট পুনঃবহালের দাবিতে রাজধানীর নিউমার্কেটের সামনে দোকান বন্ধ রেখে মানববন্ধন করেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া মিরপুর রোড, এলিফ্যান্ট রোড, সদরঘাট, কারওয়ান বাজারসহ অনেক স্থানেই দোকান বন্ধ রেখে মানববন্ধন করেছে ব্যবসায়ীরা। ঢাকার বাইরে কুমিল্লা, জামালপুর, খুলনা, মায়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য জেলা থেকেও কর্মসূচী পালনের খবর এসেছে। এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাব ॥ নতুন আইনে যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ৩০ লাখ থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি ভ্যাটের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এফবিসিসিআইর সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে লেনদেনের সীমা আরও ছাড় দিয়ে বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত ভ্যাটমুক্ত রাখতে বলা হয়েছে। এর বেশি লেনদেন হলে ৩ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। নতুন আইনে ছোট ব্যবসায়ীদের ২ শতাংশ ও ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায়ের নিয়ম বাতিল করা হয়েছে। প্রস্তাবে বার্ষিক লেনদেনের ভিত্তিতে ছোট ব্যবসায়ীদের ২ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের কথা বলা হয়েছে। এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাবে প্যাকেজ ভ্যাটের বিদ্যমান বিধান বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে সব বিভাগীয় শহর জেলায় ভ্যাট দেয়ার পরিমাণ বাড়াতে বলেছে। প্যাকেজ ভ্যাটের পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার এবং সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। প্যাকেজ ভ্যাটের বিষয়ে নমনীয় সরকার ॥ ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে প্যাকেজ ভ্যাট পুনঃবহালে নমনীয় সরকার। বাজেট ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। আগামী ২ জুন সংসদে বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এই বাজেটে রাজস্ব আদায়ে সরকার ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। শুধু ভ্যাট থেকেই ৭৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে চায় সরকার। আর এ কারণেই নতুন অর্থবছর থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে সবক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় জানিয়েছেন, ঘোষণা অনুযায়ী নতুন ভ্যাট আইন জুলাই মাস থেকে কার্যকর হবে। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের ইচ্ছা ভিন্ন কাঠামোর ভ্যাট বাস্তবায়ন। তবে আমার নিজের ইচ্ছা হচ্ছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর রাখার। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে একস্তর ভ্যাট রেট কার্যকর আছে। আমাদের দেশেও সে রকম ভ্যাটের হার হবে। তবে এ বছর আমরা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর করব। ওই সময় ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, আমরা আসলে হিসাব রাখতে পছন্দ করি না। আপনি নিজের হিসাব ঠিকমতো রাখলে ভ্যাট নিয়ে কোন চিন্তার কারণ নেই। হিসাব রাখলে নিজের ও দেশের উভয়ের লাভ। আপনারা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট মেনে নেন। মূলত অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য ভালভাবে নেয়নি ব্যবসায়ীরা। তাই দাবি আদায়ে বিভিন্ন কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করা হলো। দাবি পূরণ না হলে আরও বড় ধরনের কর্মসূচীর ঘোষণা দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইএমএফের শর্তে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্থানীয় অনেক পণ্যের ওপর যেমন ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে, আমদানি পণ্যে কমানো হচ্ছে সম্পূরক শুল্ক। ফলে স্থানীয় শিল্প কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়তে পারে। এছাড়া নতুন ব্যবস্থায় দেড় শতাধিক পণ্য ছাড়া কোন পণ্যে আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক থাকছে না। এছাড়া জ্বালানির দাম কমায় আন্তর্জাতিক বাজারেও শিল্পে উৎপাদন খরচ কমেছে। এ দুই কারণে আমদানিকৃত পণ্য কম দামে কেনার সুযোগ বাড়ছে। সংশোধন ছাড়াই বিদ্যমান ভ্যাট আইন সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে বেশির ভাগ দেশী পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এদিকে, বিক্রি যাই হোক, প্যাকেজ ভ্যাট অনুসারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরকারের কোষাগারে বছর শেষে জমা দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। এখন সংশোধন ছাড়াই ভ্যাট আইন সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে অল্প কিছু খাত ছাড়া প্রায় সব পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ বাধ্যতামূলক হবে। অর্থনীতির সাধারণ নিয়মে এই ভার শেষ পর্যন্ত ক্রেতাদেরই বইতে হবে। ব্যতিক্রমী সামান্য কিছু খাত ছাড়া সব খাতেই ভ্যাট আরোপ হবে। তাই বলা যায়, মূসক আদায় ব্যবস্থা ভারসাম্যপূর্ণ না হলে শত শত পণ্যের ভোক্তাশ্রেণী ভোগান্তির শিকার হবে যা কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলহাজ হাফেজ মোঃ এনায়েতুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ীদের বিক্রির ওপর কোন ভ্যাট হয় না। কারণ তারাও আরেকজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করছেন। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে কোন ভোক্তা নেই। তাই আইনটি সংশোধন করে প্যাকেজ ভ্যাট বহাল রাখতে হবে।
×