ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণ গোপাল দত্ত

তামাক আণবিক বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৩১ মে ২০১৬

তামাক আণবিক বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর

পৃথিবীতে প্রায় ১ বিলিয়নের অধিক লোক ধূমপান করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের কথা বিবেচনা করলে তামাকের উৎপাদন ও বিপণন বর্তমানে বাড়ছে, তবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত দেশগুলোতে বৃদ্ধির হার বেশি অথচ ধনী দেশগুলোতে কমতির দিকে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক শিশু নিকোটিনযুক্ত বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। এটা একটা ইপিডেমিক আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে, যা কিনা দরিদ্র দেশগুলোতেই বেশি। পৃথিবীর শতকরা ৮০ ভাগ ধূমপায়ী নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বসবাস করে। প্রতি ৬ সেকেন্ডে ১টি মৃত্যুর জন্য ধূমপান কোন না কোনভাবে দায়ী। বয়স্ক ১০টি মৃত্যুর একটির সঙ্গে ধূমপানের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত। যারা ধূমপান করেন তাদের অর্ধেক ধূমপানজনিত কারণে সৃষ্ট রোগে মৃত্যুবরণ করেন। উন্নত দেশের ৩০ ভাগ রোগী ধূমপানের কারণে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এমনকি ধূমপান হতে বিরত থাকতে পারলে অথবা ধূমপান ত্যাগ করলে ক্যান্সারের চিকিৎসার ফলাফল ধনাত্মক হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হলেন কিউবান প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো, যিনি ১৯৮৫ সালে ধূমপানবিরোধী এক সমাবেশে ধূমপান ত্যাগের ঘোষণা দেন। যদিও এর আগে তিনি ৪৫ বছর যাবত চুরুটে অভ্যস্ত ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি এ সময়টাতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যদিও ২০০৬ সালে তিনি গুরুতর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন এবং এখনও জীবিত। নাইটসেড গোত্রভুক্ত একটি হার্ব হলো তামাক, যা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল ভ্রমণ করে বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চাষাবাদের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। শুধু তাই নয়, উৎপাদিত তামাক আমাদের দেশগুলোতে পদ্ধতিগত সিগারেট তৈরি হওয়ার পর সমস্ত বিষ এদেশের কৃষক এবং শ্রমিকের ওপর দিয়ে চালিয়ে রিফাইন্ড প্যাক হিসেবে বিদেশে রফতানি হয়। এমনকি পরবর্তী সময় চোরাইপথে বিভিন্ন দিক দিয়ে এদেশে পুনঃপ্রবেশ ঘটে। যদিও আদিকাল থেকে তামাকের প্রচলন ছিল, ষোড়শ শতাব্দীতে বিভিন্ন সভ্যতায় সিগারেট বা তামাক সভ্যতার একটা অংশ হিসেবে গণ্য হতো। তারপরও ১৬১২ সালে জন রলফ তামাককে ক্যাশ ক্রপ (ঈধংয ঈৎড়ঢ়) হিসেবে ভার্জিনিয়াতে প্রথম উৎপাদন করেন। ঐ সময়ে ভার্জিনিয়া স্টক মার্কেটের অবস্থা খুব নাজুক ছিল বিধায় ভার্জিনিয়ায় উৎপাদিত তামাক যেই মুহূর্তে স্টক মার্কেটে প্রবেশ করে সঙ্গে সঙ্গেই স্টক মার্কেট চাঙ্গা হয়ে ওঠে। যার জন্য তামাককে তখন বলা হতো ব্রাউন গোল্ড। যদিও ব্রাউন সুগার হলো হিরোইন। সাধারণত তামাক ও তামাক জাতীয় পদার্থগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়, যার একটি ধূমপানমুক্ত অর্থাৎ চিবিয়ে খাবার তামাক বা নস্যি হিসেবে ব্যবহৃত তামাক। অপরটি হলো ধোঁয়াযুক্ত, যার মধ্যে বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা, শিশা, পাইপ ইত্যাদি। বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা, বর্তমানে প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলায় তামাকের চাষ পর্যাপ্ত পরিমাণে দেখা যাচ্ছে। লক্ষণীয় হলো, তামাক চাষে জমিনের চার পাশে কোন বেড়া দিতে হয় না। কেননা ছাগল বা গরু এসব সবুজ পাতা খায় না। যদিও প্রবাদ আছে ‘ছাগলে কিনা খায়’। এখানে প্রমাণিত হয় ছাগল তামাক পাতা খায় না। পরিবেশগতভাবে খাদ্য আর পানীয় সেবনের জন্য একটা সুন্দর জায়গা যেমন ডাইনিং টেবিল বা রেস্টুরেন্টকে আমরা উপযুক্ত মনে করি। চা পানও কিন্তু আমরা কখনও টয়লেটে বসে করি না। একমাত্র ধূমপান মানুষ টয়লেটে বসে করে থাকেন। সুতরাং স্থানের বিবেচনায় এটা খাদ্য বা পানীয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় না। গত কয়েক দশক ধরে যখন সিগারেট বা তামাকের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হচ্ছিল, তখন তামাক কোম্পানিগুলো ই-সিগারেট বাজারজাত করা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যখন তথ্যউপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করলেন ই-সিগারেটও স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ, তাই বাজারে তা স্বীয় অবস্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। ই-সিগারেটে প্রোপিলিন গ্লাইকলের মতো ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থগুলো মানব স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকারক। তারপরেও পিউরেটন নামে ডিসপোসেবল ই-সিগারেট বাজারজাত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সিগারেটের ধোঁয়ায় বা তামাক পাতায় ১৯টি ক্যান্সারের উপাদান আবিষ্কার করা হয়েছে। যার মধ্যে নিকোটিন, পলিনিউক্লিয়ার এ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন, এ্যাক্রোলিন, নাইট্রোসেমাইন, সায়ানাইড, তেজস্ক্রিয় কারসিনোজেন যেমনÑ লিড-২১০, প্লামবাম-২১০, পলনিয়াম-২১০, রেডিয়াম-২২৬, রেডন-২২২ এবং বিসমাথ-২১০ ইত্যাদি। মানবদেহের এমন কোন কোষ নেই বা সিস্টেম নেই যেখানে তামাকের বিষক্রিয়া পৌঁছাতে পারে না। স্পেশাল অনুভূতির অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বার প্রত্যেকটি জায়গায় তামাকের বিষক্রিয়ায় ধূমপায়ীরা খাবার স্বাদ বা গন্ধ পান না। অল্প বয়সে ছানি রোগে আক্রান্তও হতে পারেন। সবচেয়ে ভয়াবহভাবে স্বীকৃত হলো, ফুসফুসের ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের শিরায় সংকোচন, রক্তে কলেস্টেরল বৃদ্ধি, ভিটামিন সি এবং এ যা ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে স্বীকৃত তার পরিমাণ কমে যাওয়া। খাদ্যনালী, কণ্ঠনালী, এমনকি মহিলাদের জরায়ুর ক্যান্সারের জন্য তামাককে দায়ী করা হয়। সিঙ্গাপুরের এক গবেষণায় (২৫ সেপ্টেম্বর ২০১১) দেখা গেছে ৫৭.৫ শতাংশ ধূমপায়ী ধূমপানের কারণে দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারেন এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. এ্যামি খর বলেনÑ বিশ্বব্যাপী তিন কোটিরও বেশি মানুষ এএমডিতে আক্রান্ত অর্থাৎ একিউট ম্যাকুলার ডিজেনারেশন এবং আগামী ২৫ বছরে এর পরিমাণ তিনগুণ বেড়ে যাবে। ইদানীং তামাক কোম্পানিগুলো নারী ও শিশুদের অধিক মাত্রায় তামাক গ্রহণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। যদিও তারা জানেন, যত অল্প বয়সে তামাক সেবন শুরু ততই এর বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে বেশি। তাদের কাছে ভোক্তার স্বাস্থ্য মোটেই বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হলো তাদের বাণিজ্য ও মুনাফা। ধূমপানের বিষক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে যেসব গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা হলোÑ ব্রিটিশ গবেষক রিচার্ড ডল সম্পাদিত। যেখানে তিনি ৩৪৪৩৯ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের গবেষণাকর্ম সন্নিবেশ করেছেন। যাদের একটি অংশ ধূমপায়ী এবং অন্যটি অধূমপায়ী গবেষণা পরিচালনা করেন এবং গবেষণাকাল ১৯৫১ থেকে ২০০১ সাল। যেখানে তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন, ধূমপায়ী ব্যক্তিরা অধূমপায়ীদের চেয়ে ১০ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাদের মৃত্যুজনিত কারণগুলো হলো ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং স্ট্রোক। অর্থাৎ তারা দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। তাছাড়াও ২০০৬ সালের মার্চ মাসে স্কটল্যান্ডের উন্মুক্ত জায়গায় ধূমপান নিষিদ্ধ করার ফলে দেখা গেল আগের বছরের তুলনায় হৃদরোগ ইউনিটে হৃদরোগে আক্তান্ত রোগীর সংখ্যা শতকরা ১৭ ভাগ কমে যায়। এমনকি অধূমপায়ীদের মধ্যে আগের বছরের তুলনায় শতকরা ৬৭ ভাগ কমে যায়। অর্থাৎ আগের বছরগুলোয় তারা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে আক্রান্ত হতেন। ১৯৪৮ সালে যেখানে ১৬ বছরের উর্ধে পুরুষ ধূমপায়ীর সংখ্যা ছিল ৬৫ এবং মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা ছিল ৪০ শতাংশের উপরে। ২০০৭ সালে পুরুষ-মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা ২০ শতাংশে এসে সমানে সমান দাঁড়ায়। ২০১৪ সালে মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা পুরুষদের অতিক্রম করে ২২ শতাংশে স্থান করে নেয়। অবশ্য এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারী ধূমপায়ীদের হার পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় কম। প্রশ্ন কেন ধূমপান বন্ধ হচ্ছে না তার কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ করের প্রভাব কম। ধূমপানে উৎসাহ দানের জন্য যা ব্যয় করা হয় তা ধূমপান নিবারণের জন্য ব্যয়িত অর্থের দশগুণ বেশি। তাছাড়াও রয়েছে অনেক অদৃশ্য কারণ। ধূমপানের কারণে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত, প্রিমেচিউর ডেলিভারি, জন্মগত বিকলাঙ্গসহ নানা রকমের উপসর্গ প্রমাণিত। যদি কোন পরিবারে সন্তানসম্ভবা মা, স্ত্রী বা বোন থাকেন তাহলে ঐ পরিবারের ধূমপায়ী ব্যক্তিকে ঘরে প্রবেশের ২ ঘণ্টা আগে ধূমপান শেষ করে আসতে হবে। কেননা শেষ ধূমপানের পরে প্রশ্বাসে এর সঙ্গে প্রায় ২ ঘণ্টা পর্যন্ত কিছু না কিছু পরিমাণ নিকোটিন ফুসফুস থেকে নির্গত হয়। ধূমপানে বিষপানÑ এটা অবিসংবাদিত এবং সত্য। আমার আজকের এ লেখা ধূমপায়ীদের ধূমপান নিবারণের এক ক্ষুদ্র প্রয়াস হিসেবে তাদের জন্য উৎসর্গকৃত। ৩১ মে“ডড়ৎষফ ঘড় ঞড়নধপপড় উধু আরও জোরেশোরে প্রচার হওয়া উচিত। লেখক : সাবেক ভিসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×