ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

কারা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ৩১ মে ২০১৬

কারা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে

আমরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে আছি কয়েকটি হত্যাকা-, ব্যাংক অর্থলুট, বাংলা নববর্ষে নারীদের সম্ভ্রমহানি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিসহ এসব অপঘটনার মূল অপরাধীদের গ্রেফতার, বিচার ও দ- প্রদানের আশায়। মানুষের মনে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সিআইডি, ডিবি, পুলিশ, র‌্যাব সবার ভূমিকা ও আন্তরিকতা নিয়ে কতগুলো প্রশ্ন জেগেছে। প্রথমত. ২০১৩ সালে রাজীব হায়দার, গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা সদস্য নিজ বাড়ির সামনে খুন হয়! কেন খুন হলো? সহজ উত্তর, গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে বাংলাদেশ ’৭১-এর পর জিয়া-খালেদা-এরশাদ এবং খালেদা-নিজামী-তারেকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শাসনামলের দীর্ঘ চার দশক পর বাংলাদেশের সঠিক উত্তরাধিকারী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংগঠন গড়ে উঠেছে। এরা ’৭১-এর অসমাপ্ত যুদ্ধের শেষ অধ্যায় ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সর্বোচ্চ দ- কার্যকরের মাধ্যমে এটি সম্পন্ন করার প্রধান দাবি নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল। সন্দেহ নেই, ’৭১-এর পরাজিত যুদ্ধাপরাধীরা চার দশকে ক্ষমতা, অর্থবিত্ত দ্বারা তাদের ভ্রান্ত আদর্শপন্থী, স্বাধীনতা ও উন্নয়নবিরোধী একটি নতুন প্রজন্ম, শিক্ষিত-মূর্খ এবং আলবদরের মতো বর্বর খুনীচক্র তৈরি করে চলছে। এরাই ২০১৩-এর নতুন প্রজন্মের ‘আলবদর’ তাদের নাম জেএমবি বা আনসারুল্লাহ্ যাই হোক। বর্তমানে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী যারা লাখ লাখ বাঙালী মুক্তিযুদ্ধপন্থী নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করেছিল, এখন তাদের মুষ্টিমেয় নেতার সম্পূর্ণ আইনী প্রক্রিয়ায় বিচার ও দ- কার্যকর হচ্ছে যা ছিল তাদের কাছে অকল্পনীয়। এরই প্রতিশোধ হিসেবে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মিত্র দল তাদের নতুন প্রজন্মের আলবদরদের দিয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করাচ্ছে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত রাজীব, দীপ, অভিজিত, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নিলয়, দীপন, নাজিম, জুলহাস, তনয়, দেশী-বিদেশী সাধু, বিশপ, ভিক্ষু এবং অধ্যাপক তাহের, অধ্যাপক ইউনূস, অধ্যাপক শফিউর, অধ্যাপক রেজাউলসহ আরও যেসব প্রগতিশীল, মুক্তমনা তরুণ, ধর্মগুরু ও অধ্যাপক জঙ্গীদের হাতে নিহত হয়েছেন, অনেককে হত্যার হুমকি দিয়ে মেসেজ, পত্র পাঠিয়ে খুনের টার্গেট করেছে তাদের হত্যাকারী, হুমকিদাতার গ্রেফতার ও বিচার এতদিনেও হলো না কেন? অভিজিত হত্যায় সবচেয়ে বেশি সন্দেহের মধ্যে থাকার কথা ছিল যে ব্যক্তিটি একা অভিজিতকে বইমেলার একটি স্টলের সামনে চায়ের দাওয়াত দিয়েছিল, যে দাওয়াত অভিজিতের অপর কোন বন্ধু পায়নি, সেই নয় কি? সে ব্যক্তিকে ধরা হলো না কেন? তার কাছ থেকে খুনী চক্রের সব খবর জানা যেত বলে সবার বিশ্বাস। সে সময় পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছিল, সিসিটিভির ছবিও পেয়েছিল। এখন পুলিশ বলছে, হত্যার এক বছর পেরিয়ে যাবার পর অভিজিত হত্যার তিনজন সন্দেহভাজন খুনী নাকি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে! রাজীব হত্যার প্রধান পরিকল্পক রানা সে সময়ই পালিয়ে গিয়েছিল বলে শুনেছি । তাকেও ধরার ব্যবস্থা করা অসম্ভব কিছু নয় যদি সরকার ও পুলিশ আন্তরিক থাকে। ওয়াশিকুরের হত্যাকারী একজনকে তো এক সাহসী হিজড়া ধরে দিয়েছিল পুলিশকে- তার কি হলো? সেই ব্যক্তিই তো পুরো চক্রকে ধরিয়ে দিতে পারে। আমরা মনে করি, খুনীকে চরম দ- দিয়ে সমাজকে বোঝাতে হবে- সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার কোনরকম খুন, হত্যাকা-কে প্রশ্রয় দেয় না। প্রায় ত্রিশের বেশি যুক্তিবাদী তরুণ ও প্রগতিশীল শিক্ষককে, এমনকি টাঙ্গাইলের গ্রামের হিন্দু দর্জিকে, কিছুদিন আগে নিরীহ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে জঙ্গীরা খুন করল, যাদের কারও হত্যার বিচার না হওয়ায় খুনীরা এখনও একের পর এক পরিকল্পিত হত্যাকা- চালিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে পুলিশে জামায়াত-বিএনপি, জঙ্গীপন্থীরা আছে। এই বিষয়গুলোর তদন্ত জরুরী নয় কি? দ্বিতীয়ত. কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সংস্কৃতিকর্মী তনুর হত্যা, ময়নাতদন্ত ও তদন্ত নিয়ে অদ্ভুত কা- পর্যবেক্ষণ করছি আমরা। বলা বাহুল্য, তনু হত্যার পর মহিলা আইনজীবী সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তার মরদেহ দেখে বলেছিলেন, তনুর মাথার পেছনে ভারি আঘাত ছিল নাক দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল, শরীরের অন্যান্য স্থানে ক্ষতচিহ্ন ছিল। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে এলো, তার দেহে ধর্ষণ বা আঘাতের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মৃত মেয়েটিকে কষ্ট দিয়ে, জীবিত তার স্বজন, মা-বাবা, ভাই, বন্ধুদের মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে দ্বিতীয়বার তার মরদেহ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত করা হলো। সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণের আলামত পেল, হত্যার পূর্বে তাকে তিনজন ধর্ষণ করেছিল বলে সিআইডির এক কর্মকর্তা মিডিয়াকে বলেন। তাহলে প্রথম ময়নাতদন্ত রির্পোটে কেন ধর্ষণের উল্লেখ ছিল না! গলদটা কোথায় তা বের করলেই আসল খুনী বের করা কঠিন হবে না। আমি তনুর মা-জননী সাহসিকাকে অভিনন্দন জানাব। সত্যি, মা, আপনার সাহস, সত্যের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার এবং পুলিশ, সিআইডির দুর্বলতা ও আন্তরিকতাহীনতাকে পরাজিত করেছে। আপনি মুক্তিযোদ্ধা রুমির মায়ের মতোই নিষ্ঠুর ক্ষমতাশালীর হাতে আপনার সুন্দর, গানে, নাচে, ছবি আঁকায়, অভিনয়ে পটু, উচ্চশিক্ষা গ্রহণরত একমাত্র কন্যাকে অন্যায়ভাবে চিরতরে হারিয়েছেন; কিন্তু কন্যা হত্যার কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশের মানুষকে অর্থাৎ তনু হত্যার বিচার দাবিকারীদের মনে চিরস্থায়ী স্থান গ্রহণ করেছেন। আপনি খুনীদের দিকে স্পষ্ট নির্ভীক আঙ্গুল তুলেছেন। আমরা মনে করি খুনীদের সবাই ভয় পেলেও একজন জননী ভয় পেতে পারে না। সেই প্রমাণ আপনি দিয়েছেন। আপনার এই সাহসী পদক্ষেপের সঙ্গে দেশের জনগণ আপনাদের পাশে আছে, থাকবে। আরেকটি বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুটের বিষয়ে বেশ কিছুদিন যাবত বলা হচ্ছে ব্যাংক অফিসে যারা অর্থ স্থানান্তরের বিভাগে কর্মরত ছিল, তাদের গোয়েন্দা নজরে রাখা হয়েছে, কেউ দেশ ছেড়ে যেতে যেন না পারে সেজন্য বিমানবন্দরে নাম-ধাম দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি জানা গেল, ওই সেকশনে ২২ বছর যাবত কর্মরত একজনকে মাত্র ক’দিন আগে পদচ্যুত নয়, বদলি করা হয়েছে। অথচ এক পদে সাধারণত তিন বছরের বেশি কাউকে রাখা হয় না। বলা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, অদক্ষতা, উদাসীনতা ছিল, তা কি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত? এখনও ওদের কেউ গ্রেফতার হয়নি। অথচ যে তরুণটি কিছুদিন ব্যাংকের আইটি সেকশনে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছিল, তাকে একদিন কারা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আলবদরীয় স্টাইলে এবং কার নির্দেশে ছয়-সাতদিন পর দয়া করে মুক্তি দিয়েছিল? ভাবতে খারাপ লাগে নির্দোষকে আলবদরীয় কায়দায় তুলে নিতে পারে এই মুক্তিযুদ্ধের সরকারের আমলে? এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে? প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন- গণতান্ত্রিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপন্থী সরকারকে এসব আলবদরীয় ঘটনা কেন সহ্য করতে হচ্ছে? সরকারের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপকে কারা বারবার বানচাল করছে? কারা তথ্যপ্রযুক্তির এই উন্মুক্ত বিশ্বে ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে? সেটি কি গোয়েন্দারা জানেন না? ’৭১-এ শুরু হওয়া হিন্দু উৎখাত এখনও মনে হয় আওয়ামী লীগ নামধারী কিছু নেতার সহযোগেই চলছে। দেখছি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুশূন্য হওয়ার পথে চলছে, তাও আবার ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারের আমলে! আওয়ামী লীগের সব অর্জন এবং সাফল্যক ম্লান করতেই চলছে এসব খুন, দখল, উৎখাত, নারী নির্যাতন অপরাধ ও কর্মকা-- তা জনগণও বুঝতে সক্ষম। প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই এসব দেখছেন। তবে টেবিলের ওপাশে জনগণের উল্টোপাশে থাকলে বোধ হয় জনগণের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে অনেক সময় কাল্পনিক, সুদূরের স্বপ্ন বলে মনে হয়। নতুবা বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় থাকতে এসব হবে কেন? প্রধানমন্ত্রী তনুর সাহসী মা ও পরিবারের পাশে থাকুন। তনু হত্যার বিচারের বাধাদানকারী ও প্রকৃত খুনীদের বিচার এবং দ- দিয়ে তাকে, ওই মাকে পুরস্কৃত করুন। পাশাপাশি দেশের সকল হত্যাকা- ও নারী নির্যাতনের অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করার এবং বিচার শুরু করার ব্যবস্থা নিন। মানুষের শেষ ভরসাস্থল আপনিই। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×