বিভাষ বাড়ৈ ॥ পদ রক্ষায় বিশ্বব্যাংককে তুষ্ট করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি এ্যান্ড এ্যাকসেস এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্টের (সেকায়েপ) ৪৪ কোটি টাকা অপচয়ের আয়োজন চলছে। এ লক্ষ্যে প্রকল্পের পরিচালকসহ কয়েক কর্মকর্তার বদৌলতে কোন দরপত্র ছাড়াই সরকারী ক্রয় নীতি লঙ্ঘন করে শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ কমিউনিটি মবিলাইজেশনের কাজ দেয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ অদক্ষ প্রতিষ্ঠান বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রকে। কেবল তাই নয়, এ আয়োজন সফল করতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর জন্য দরপত্র আহ্বান করার পর নির্বাচিত তিনটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার বাইরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ কাজের কোন অভিজ্ঞতাই নেই। পুরো ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছ শিক্ষা প্রশাসনে।
তবে অভিযোগ যাই হোক প্রকল্প পরিচালক ড. মাহমুদুল হক দাবি করেছেন, টেন্ডার না হলেও সরকারী কোন নিয়ম লঙ্ঘন হয়নি। তবে তিনি একই সঙ্গে জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ প্রকল্প চলে। বিশ্ব ব্যাংকই চেয়েছে এই কাজটা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র করুক। তারা করলে কাজ ভাল হবে বলে বিশ্বব্যাংক চিঠি দিয়ে জানিয়েছে বলেও দাবি করেছেন পরিচালক। বিশব্যাংক চাইলেই কি যার যে কাজের অভিজ্ঞতা নেই টেন্ডার ছাড়া তাকেই সে কাজ দিতে হবে? এমন প্রশ্নে অবশ্য পরিচালক বলছেন, আমরা মনে করি নিয়ম মেনেই হয়েছে। কোন অনিয়ম হচ্ছে না। জানা গেছে, সরকারী ক্রয় নীতি উপেক্ষা করে দরপত্র ছাড়াই সকায়েপের অধীনে ৪৪ কোটি টাকার শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী (টিটিপি) ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার দায়িত্ব বেসরকারী সংস্থা ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’কে দেয়ার সকল প্রক্রিয়া এখন চূড়ান্ত। প্রকল্পের এ সংক্রান্ত বিষয়টি ‘একনেক’র সভায়ও অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। অথচ কোন প্রকল্প ‘একনেক’ সভায় উপস্থাপনের আগে ‘প্রি-একনেক’ বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এছাড়া দরপত্র ছাড়া বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রকে শিক্ষক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয়া যায় কীনা সে ব্যাপারে সিন্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিষয়টি সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য সিন্ধান্ত নিয়েছিল মন্ত্রণালয়। এসব পদক্ষেপ উপেক্ষা করেই ১০ মে প্রকল্পটি একনেক সভায় উপস্থাপন করা হলে এর অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্প কর্মকর্তা, মাউশি ও পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দরপত্র ছাড়া বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রকে কাজ দেয়ার বিরোধিতা করলেও একটি প্রভাবশালী মহলের চাপে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তড়িঘড়ি করে প্রকল্প ‘একনেক’ সভায় তোলা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারাও পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। রবিবার সকালে এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে কর্মকর্তারা কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হলেন না। এক কর্মকর্তা বলেন, সিদ্ধান্ত ছিল ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে তোলা হবে। সে হিসাবে ফাইলও প্রস্তুত করেছি আমরা। যেহেতু টেন্ডার ছাড়া এত বেশি টাকার কাজ কমিটি অনুমোদন দেয় কিনা তা দেখা দরকার। কিন্তু সব কিছুৃ ভিন্ন কৌশলে এগিয়েছে গোপনেই। প্রি-একনেক হয়নি। একনেকে তোলা হলো কিভাবে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন কর্মকর্তারা। এদিকে একটি অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার মানে অর্থ অপচয় বলে অভিযোগ তুলেছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। সরকারী ঋণের অর্থের এমন অপব্যয় ও অপচয় বন্ধে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের আওতায় শিক্ষক সঙ্কটে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য মানসম্মত অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষক (এসিটি) নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানসম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে কাজ করা হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বর্তমানে একটি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, গণিত, ইংরেজী এবং বিজ্ঞান বিষয়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োগের জন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষের আহ্বান করা আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করা হয়। এর মধ্যে ইংরেজীর জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল, গণিতের জন্য ফিলিপিন্সের মেডিকোর ক্যারিয়ার সিস্টেমস ইনকর্পোরেট (এমসিএস) এবং বিজ্ঞানের জন্য বাংলাদেশের এনভায়রনমেন্ট, এগ্রিকালচার এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেসকে (ইএডিএস) বাছাই করা হয়।
আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রুপে ছয়টি করে প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে এই তিনটিকে নির্বাচন করে তালিকা বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এর মধ্যেই প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হওয়ায় নতুন প্রকল্প পরিচালক এ তালিকা অগ্রাহ্য করে অদক্ষদের কাজ দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। নতুন প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব নিয়েই প্রকল্পের কার্যক্রম তদারকির জন্য ওলিউল ইসলাম নামে একজনকে কোয়ালিটি এস্যুরেন্স কনসালট্যান্ট পদে উচ্চবেতনে নিয়োগ এবং বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পরামর্শক পদে লিয়েনে কর্মরত উপসচিব শরীফ মাসুদের পরামর্শে এ তিন প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রকে কার্যক্রমের দায়িত্ব দেয়ার কাজ শুরু করেন।
ওই দুই কর্মকর্তার পরামর্শে এবং প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের অদক্ষতার সুযোগ নিয়ে প্রকল্প পরিচালক স্টিয়ারিং কমিটিকে ভুল বুঝিয়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রকে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মনিটরিং কার্যক্রমে দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করিয়ে নেন। তবে দরপত্র ছাড়া এ প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার বেশি অঙ্কের কার্যাদেশ দেয়ার সুযোগ না থাকায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তটি সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়।
সূত্র জানায়, স্টিয়ারিং কমিটির সর্বশেষ সভায় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়ার অভ্যাস উন্নয়ন (ডিআরএইচ) কর্মসূচী সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পিপিআর অনুযায়ী, এ ধরনের সংশোধনে মোট বরাদ্দের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে তা শুধুমাত্র একই ধরনের কাজের ক্ষেত্রে সংশোধন করা যায়। বইপড়ার অভ্যাস উন্নয়ন ও অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষক প্রশিক্ষণ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী কাজ। এ ক্ষেত্রে বইপড়ার অভ্যাস উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে শিক্ষক প্রশিক্ষণের কাজ দেয়ার উদ্যোগ পিপিআর-এর লঙ্ঘন এবং সরকারী অর্থের অপচয় বলে দাবি করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কোন অভিজ্ঞতাও নেই।
পিপিআর-এর বিধান অনুযায়ী, সার্ভিস প্যাকেজ বাতিল বা সংশোধিত প্যাকেজ অনুমোদন না করে বিকল্প পন্থায় কোন কাজ সম্পন্ন করার, আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়া স্থানীয়ভাবে ক্রয় প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত কোন ক্রয় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এবং ক্রয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) বা আরডিপিপি সংশোধনের বিশ্বব্যাংকের ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটানো পিপিআর-এর লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে। এসব বিধি এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে।
প্রকল্পের কর্মকর্তারাই পরিচালকের কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ। তবে মন্ত্রণালয়ের সমর্থন পরিচালকের দিতে হওয়ায় কেউ প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না। রবিবার অফিসে অন্তত চারজন কর্মকর্তার কাছে গেলেও কেউ কথা বলতে রাজি হননি। প্রত্যেকেরই কথা পত্রিকায় নাম দিলেও চাকরি থাককে না। তবে তারা বলছেন, অভিজ্ঞতা ছাড়াই একটি প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কাজের দায়িত্বে নিয়োগ করা হবে অনৈতিক। এ অনৈতিক কাজের সুযোগ সৃষ্টি প্রকল্প পরিচালক ও তার সহযোগীরা সরকারের প্রায় ৪৪ কোটি টাকা আত্মসাত বা অপচয় করার সুযোগ নিচ্ছেন। বিশ্বব্যাংককে খুশি রাখলে পথে থাকা নির্বিঘœ হবে বলেই এমন আয়োজন বলে অভিযোগ তুলেছেন কর্মকর্তারা।
কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অবস্থান কি? এ বিষয়ে শিক্ষা সচিব মোঃ সোহরাব হোসেইন জনকণ্ঠকে বলেন, কোন নিয়ম এখানে লঙ্ঘন হয়নি। টেন্ডার একটি প্রক্রিয়ায় কিন্তু যেভাবে দেয়া হচ্ছে সেটাও বৈধ। তবে এটা আমরা দেয়ার জন্য বলিনি। বৈঠকে প্রকল্পের পক্ষ থেকেই বলা হয় যে, কাজটা যাতে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রকে দেয়া হয় সেকথা তাদের বলেছে বিশ্বব্যাংক। তাতেই আমরা রাজি হয়নি। আমরা বলেছি বিশ্বব্যাংকে লিখিত দিতে হবে।
কিন্তু কেন একটি অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানতে দেয়া হচ্ছে? তারা তো বই পড়ার অভ্যাস গড়ার কাজ করে। তারা এ কাজ কিভাবে করবে? এ প্রশ্নে সচিব বলেন, দেখেন যারা টাকা দিচ্ছে তারা বলছে ওরা ভাল কাজ করতে পারবে। প্রকল্পের কর্মকর্তারাও তাই বলছে। তবে আসল কথা হলো বিষয়টি অনেক দিন ধরেই আলোচনায়। এটি মন্ত্রিসভা কমিটিতে উঠবে। যদি দেয়া সম্ভব না হয় সেখানে অবশ্যই আপত্তি আসবে। অনিয়ম কিছু হবে না বলে মনে করছেন শিক্ষা সচিব।