ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাস্তবায়নের সীমা এক বছর পেছানোর চিন্তা

ভ্যাট আইন কার্যকরে কঠোর অবস্থানে থাকছে না সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৩০ মে ২০১৬

ভ্যাট আইন কার্যকরে কঠোর অবস্থানে থাকছে না সরকার

এম শাহজাহান ॥ ভ্যাট আইন কার্যকর না করে আপাতত বাস্তবায়নের সময়সীমা এক বছর পিছিয়ে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের দাবি ও আন্দোলনের মুখে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে সরকার। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী অর্থবছরে নতুন ভ্যাট আইনে সংশোধনের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখনও চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। জাপান সফর শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। আইএমএফের পরামর্শে গত ২০১২ সালের আইনটি আরও সংশোধন করে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ সংশোধিত আইনের মাধ্যমেই একটি আধুনিক, বিনিয়োগ, ভোক্তাস্বার্থ ও রাজস্ববান্ধব মূল্য সংযোজন কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে, যাতে ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দিতে পারেন এবং সরকারের কোষাগারে রাজস্ব বাড়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন আইন অনুযায়ী সবক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে চান না ব্যবসায়ীরা। যদিও ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১ জুলাই থেকে আইনটি কার্যকর হওয়ার কথা। এ অবস্থায় ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে ব্যবসায়ীরা আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তাই আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট আইনের আরও সংশোধনের ঘোষণা চান তারা। এমনকি আইনটি যাতে কার্যকর না হয় সে লক্ষ্যে রিট করার প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে। এদিকে নতুন আইনে ‘সমতাভিত্তিক’ ভ্যাট আদায়ের বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ছোট, মাঝারি, বড় সর্বক্ষেত্রে একই হারে (১৫ শতাংশ) ভ্যাট দিতে হবে। পক্ষান্তরে, বর্তমান আইনে একাধিক স্তরে হ্রাসকৃত হারে (বিদ্যমানের চেয়ে কম হারে) মূসক আদায় করা হয়। একই সঙ্গে ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ভ্যাট প্রদানে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। ফলে এখন গড়ে ৩ থেকে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। চলমান এসব সুবিধা বহাল রেখেই নতুন ভ্যাট আইন সংশোধন চান ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সরকার ১৫ শতাংশ হারে আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন মূসক আইন বাস্তবায়ন হলে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। ফলে চাপে পড়বে মানুষ। সূত্রমতে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান ছাড়াও চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন হারে ভ্যাট ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বাংলাদেশেও যেসব উৎপাদনকারী বা ব্যবসায়ী উপকরণ রেয়াত নিতে সমর্থ হবেন না, তাদের ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপের দাবি জানানো হয়েছে। আইনটি সংশোধন করে সবক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত বাতিলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি পাঠিয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, ৮৫ শতাংশ ব্যবসায়ী উপকরণ রেয়াত নিতে পারবেন না। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ ইস্যুতে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন। একইভাবে চিঠি পাঠানো হয়েছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর কাছেও। এফবিসিসিআইয়ের দেয়া সংশোধনী প্রস্তাবে বিশেষ ছাড়ের সুবিধা বহাল রেখে সর্বক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেয়ার পরিবর্তে বিভিন্ন স্তরে হ্রাসকৃত হারে (বিদ্যমানের চেয়ে কম হার) আদায়ের কথা বলা হয়েছে। সংগঠনটি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা প্রস্তাবে বলেছেÑ ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপান, চীনসহ বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত দেশে ভ্যাট আদায়ে বিশেষ ছাড়ের নিয়ম চালু আছে। ওই সব দেশে পণ্য ও সেবার যতটকু মূল্য সংযোজন হয়, তার অংশের ওপর বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট আদায় করা হয়। অথচ বাংলাদেশে নতুন ভ্যাট আইনে এসব বিধান রাখা হয়নি। মোট বিক্রি বা প্রকৃত লেনদেনের ওপর একই হারে ভ্যাট আদায়ের বিধান রাখা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক নীতিমালার পরিপন্থী। এফবিসিসিআই আরও বলেছে, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি নিয়ে সরকার গঠিত যৌথ কমিটি উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ছাড় দিয়ে ভ্যাট আদায় ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছিল। আইনটি চূড়ান্ত করা হলেও যৌথ কমিটির ওই সুপারিশ উপেক্ষিত রয়েছে, যা মোটেই সমীচীন হয়নি। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে আরও বলা হয়েছেÑ নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবসম্মত নয়। এটি কার্যকর হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হবে। কমবে ভ্যাট আদায়। যেসব সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো গ্রহণ করা হলে আদায় সহজ হবে। বাড়বে ভ্যাটের আওতা। তৈরি হবে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ। যে কারণে ব্যবসায়ীদের আপত্তি ॥ ২০১২ সালের ভ্যাট আইনের কিছু ধারা নিয়ে ব্যবসায়ীদের আপত্তি দীর্ঘদিনের। আইএমএফের শর্ত মেনে ভ্যাট আইন পাস করার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন ৩১টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে। ত্রুটি বা দুর্বলতাগুলো নিরসন না করেই এনবিআর আইনটি আগামী অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে পুরোপুরি কার্যকরের উদ্যোগ নেয়ায় ব্যবসায়ী মহলে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের শর্তে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্থানীয় অনেক পণ্যের ওপর যেমন ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে, আমদানি পণ্যে কমানো হচ্ছে সম্পূরক শুল্ক। ফলে স্থানীয় শিল্প কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়তে পারে। এছাড়া নতুন ব্যবস্থায় দেড় শতাধিক পণ্য ছাড়া কোন পণ্যে আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক থাকছে না। এছাড়া জ্বালানির দাম কমায় আন্তর্জাতিক বাজারেও শিল্পে উৎপাদন খরচ কমেছে। এ দুই কারণে আমদানিকৃত পণ্য কম দামে কেনার সুযোগ বাড়ছে। সংশোধন ছাড়াই বিদ্যমান ভ্যাট আইন সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে বেশির ভাগ দেশী পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। বিক্রি যাই হোক, প্যাকেজ ভ্যাট অনুসারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরকারের কোষাগারে বছর শেষে জমা দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। এখন সংশোধন ছাড়াই ভ্যাট আইন সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে অল্প কিছু খাত ছাড়া প্রায় সব পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ বাধ্যতামূলক হবে। অর্থনীতির সাধারণ নিয়মে এই ভার শেষ পর্যন্ত ক্রেতাদেরই বইতে হবে। ব্যতিক্রমী সামান্য কিছু খাত ছাড়া সব খাতেই ভ্যাট আরোপ হবে। তাই বলা যায়, মূসক আদায় ব্যবস্থা ভারসাম্যপূর্ণ না হলে শত শত পণ্যের ভোক্তাশ্রেণী ভোগান্তির শিকার হবে, যা কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। বিদ্যুত বিলে যেমন খরচ বাড়বে, তেমনি পোশাক কিনতেও বাড়তি টাকা গুনতে হবে। বাজারে গেলেও বাড়তি খরচ করতে হবে। এমনকি সাজগোজ করার জন্য গহনা কিনতেও বেশি ভ্যাট দিতে হবে। ফলে ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক খারাপ হবে। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য প্যাকেজ ভ্যাট বহাল করা প্রয়োজন। এর বেশি আদায় করতে গেলে তারা ব্যবসা করতে পারবেন না। তিনি বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের উপযুক্ত সময় এখনও হয়নি। কারণ যৌথ কমিটির সুপারিশগুলো আমলে নেয়া হয়নি, সম্পূরক শুল্ক কমে এলে দেশী শিল্পের সুরক্ষায় কী পদক্ষেপ নেয়া হবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি। বিধিমালা এখনও জারি করা হয়নিÑ সব মিলিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থায় রয়েছে নতুন ভ্যাট আইন। প্যাকেজ ভ্যাট ॥ নতুন ভ্যাট আইনে প্যাকেজ ভ্যাটের বিধান রাখা হয়নি। এর পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের পক্ষে উপকরণ ক্রয় এবং ওই উপকরণ দিয়ে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির হিসাব রাখা সম্ভব নয়। এর পরিবর্তে ফিক্সড ভ্যাট বা প্যাকেজ ভ্যাট বহাল রাখতে হবে। তা না হলে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে না। প্যাকেজ ভ্যাট বহাল ও আইন সংশোধনের জন্য ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে পুরান ঢাকাভিত্তিক ‘ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন করেছে। এ সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবু মোতালেবের নেতৃত্বে ভ্যাট ইস্যুতে বিভিন্ন কর্মসূচী ঘোষণা করা হচ্ছে। প্যাকেজ ভ্যাট পুনর্বহাল এবং এফবিসিসিআই ও এনবিআর কর্তৃক যৌথ কমিটির সাতটি সুপারিশ মেনে নেয়ার দাবিতে আজ সোমবার ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের উদ্যোগে সারাদেশের ব্যবসায়ীবৃন্দ দুপুর বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত তাদের দোকানপাট বন্ধ রেখে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করবেন। এছাড়া ঐক্য ফোরাম নেতৃবৃন্দ পুরান ঢাকার চকবাজার ও মৌলভীবাজারে অবস্থান করবেন
×