স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ এ্যাথলেটিক্সের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট হচ্ছে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। ‘হাজী নুরুল ইসলাম স্মৃতি জাতীয় জুনিয়র এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা’র সমাপনী দিনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে কিশোরী ও কিশোর বিভাগে স্বর্ণপদক করায়ত্ত করে যথাক্রমে বিকেএসপির তানজিলা আক্তার এবং নরসিংদী জেলা ক্রীড়া সংস্থার উজ্জল চন্দ্র সূত্রধর।
কথায় আছে, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখ শতবার।’ শতবার নয়, চতুর্থ বারের চেষ্টাতেই সফল হয়েছে তানজিলা। বিকেএসপির উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এর আগেও জাতীয় জুনিয়র এ্যাথলেটিক্সে তিনবার অংশ নিয়েছে। তবে ১০০ মিটারে প্রথম হলো এবারই প্রথম। ‘দ্রুততম মানবী হওয়ার স্বপ্ন আমার অনেকদিনেরই। সেটা এবার পূর্ণ হওয়াতে খুবই খুশি।’
এর আগে এই আসরে ২০১৩ সালে তিনটি ইভেন্টে রৌপ্য পেয়েছিল তানজিলা। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে চোটের কারণে (লিগামেন্ট ইনজুরি) খেলতে পারেনি সে। ‘এই প্রতিযোগিতার জন্য তানজিলার প্রস্তুতি ছিল প্রায় তিন মাসের।’ এক প্রশ্নের জবাবে উত্তর দেন তানজিলার পাশে দাঁড়ানো কোচ মতিউল আলম। ২০১৩ সালের আসরে ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার দৌড়ে এবং লং জাম্পে রৌপ্য পেয়েছিল তানজিলা।
শনিবারের জয় সম্পর্কে তার ভাষ্য, ‘আমার কোচ আমাকে এবার যেভাবে ও যতটুকু অনুশীলন করিয়েছিলেন, তাতে করে আমি আত্মবিশ^াসী ছিলাম এবার আমি কিছু একটা করতে পারব। তবে কিছুটা সংশয়েও ছিলাম। কারণ অনেকদিন খেলায় ছিলাম না এবং বেশিদিন ট্রেনিংও পাইনি। আজকের এই সাফল্যের পেছনে আমার কোচের অবদানের কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।’ তানজিলার বাবা কৃষক, নাম শামসুল ইসলাম। মা গৃহিণী মাজেদা বেগম। গ্রামের বাড়ি পাবনার সুজানগরে। তারা তিন বোন, এক ভাই। ‘আমি তৃতীয় আর বোনদের মধ্যে সবার ছোট। আমাদের পরিবারে একমাত্র আমিই খেলোয়াড়। সবাই বলে খেলাধুলা করে নাকি আমি আমাদের বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছি!’ তানজিলার স্বগতোক্তি। এ্যাথলেটিক্স ক্যারিয়ার প্রসঙ্গে তানজিলার ছোট গল্প, ‘আমার এক খালা স্কুল পর্যায়ে এ্যাথলেটিক্স খেলতেন (অনেক চেষ্টা করেও খালার নামটি মনে করতে পারলো না তানজিলা!) তবে তাকে দেখে নয়, আমি এ্যাথলেটিক্সে এসেছি নিজের আগ্রহেই। যখন ক্লাস টুতে পড়তাম, তখন থেকেই আমি স্কুল পর্যায়ে বিভিন্ন এ্যাথলেটিক্স খেলায় অংশ নিতাম। প্রচুর সাফল্য আছে আমার।’
শুরুর দিকের দিনগুলো কেমন ছিল? ‘শুরুতে বাবা চাইতো না আমি খেলি। তিনি ছিলেন মোটামুটি রক্ষণশীল মনোভাবের। কিন্তু আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা। ছিলাম ভীষণ দুষ্ট। সবাইকে জ¦ালিয়ে মারতাম! বাবা মানা করলেও মা এবং বড় বোনের সাহায্য-সমর্থন পেয়েছি। এভাবেই শুরু।’
এখনও কি বাবা চায় না? ‘যখন হাইস্কুলে উঠি এবং আন্তঃস্কুল এ্যাথলেটিক্সে অনেক পুরস্কার পাচ্ছি, তখন বাবার নেতিবাচক মনোভাব বদলে গিয়ে ইতিবাচক হয়ে যায়।’ তানজিলার জবাব। দীর্ঘ তিনমাস ক্যাম্প করার পর ২০১২ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া তানজিলা আরও জানায়, ‘স্কুল পর্যায়ে পুরস্কার হিসেবে জিতেছি ৪৫ প্লেট এবং ২৫টির বেশি মেডেল।’ ভবিষ্যত পরিকল্পনা? ‘বিউটি আপার (নাজমুন নাহার বিউটি) ১০০ মিটারের এবং ২০০ মিটার দৌড়ে সুর্বণা আপুর (সুবর্ণা আক্তার) বাংলাদেশ গেমসের টাইমিংয়ের রেকর্ডটা ভাঙ্গতে চাই।’ এই আসরে তানজিলা ২০০ মিটার স্প্রিন্টে এবং হাই জাম্পে দ্বিতীয় হয়েছে।
নরসিংদী জেলা থেকে অংশ নিয়ে ১০.৮৩ সেকেন্ডে প্রথম হয়েছে উজ্জল চন্দ্র সূত্রধর। এর আগেও ২০১৩ সালে এই প্রতিযোগিতায় দ্রুততম বালক হয়েছিল সে। ওই আসরে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণ জেতার পাশাপাশি লং জাম্পেও স্বর্ণ জেতে সে। পরের বছর জাতীয় জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট ও লং জাম্পে দ্বিতীয় হয়। ২০১৫ সালে একই আসরে ৭.০৯ সে.মি. লাফিয়ে লং জাম্পে জাতীয় রেকর্ড গড়েন। সেবার ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নেয়নি। কারণটা পর্যাপ্ত অনুশীলনের অভাব। এবার তার আশা ছিল ১০০ মিটার স্প্রিন্টের পাশাপাশি লং জাম্পেও জাতীয় রেকর্ড গড়ার। কিন্তু জ্বরের কারণে হয়নি। মাত্র ১৫ দিনের প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও এর মধ্যে আটদিনই জ্বর ছিল তার।
ফলে এই আসরে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি তার। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে প্রথম হলেও লং জাম্পে হয়েছে দ্বিতীয়। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র উজ্জল দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড়। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থানার গচিহাটা গ্রামে। বাবা কাঠমিস্ত্রী। মা গৃহিণী। ‘বাবা ও মায়ের উৎসাহে এ্যাথলেটিক্সে আসলেও গচিহাটা পল্লী একাডেমি ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মেজর (অবঃ) আকতারুজ্জামান রঞ্জনের সহযোগিতায় এই খেলায় ভাল করার সুযোগ পাই।’ উজ্জলের ভাষ্য। সে আরও যোগ করে, ‘জুনিয়র মিটে প্রথম হতে পেরে খুব ভাল লাগছে। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে প্রথম হওয়ার জন্য আকতার স্যারকে ধন্যবাদ জানাই। ওনার সহযোগিতায় এতদূর আসতে পেরেছি।’
উজ্জলের ভবিষ্যত লক্ষ্য কি? ‘সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই। আর এজন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের। এ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনকে অনুরোধ করব এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিতে।’