ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরিধির বাইরে গিয়ে অন্য ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে শান্তিরক্ষা বাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৯ মে ২০১৬

পরিধির বাইরে গিয়ে অন্য ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে শান্তিরক্ষা বাহিনী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিশ্ব শান্তিরক্ষা দিবস আজ। প্রতিবছর ২৯ মে দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি কেন্দ্র করে বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে রবিবার বিকেল ৪ টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ নিহত শান্তিরক্ষীদের নিকটাত্মীয় ও আহত শান্তিরক্ষীদের সংবর্ধনা দেবেন। এর বাইরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা গৌরবময় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা আরও বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার শান্তিরক্ষী বিভিন্ন মিশনে কর্মরত। তারা শুধু শান্তি রক্ষার জন্যই কাজ করছেন না। বিভিন্ন দেশে সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ নানা কাজে ভূমিকা রাখছেন। শান্তিরক্ষীদের চেষ্টায় সিয়েরালিওনে দ্বিতীয় ভাষা বাংলা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা ‘বাংলা বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হয় আশির দশকের শেষদিকে। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ ইরান-ইরাক সামরিক পর্যবেক্ষক মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ১৫ সামরিক পর্যবেক্ষক পাঠানো হয়। সেই থেকে শান্তিরক্ষা মিশন শুরু। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে যৌথবাহিনীতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন। তখন শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ বিশ্বব্যাপী প্রশংসার দাবি রাখে। এরপর ধীরে ধীরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকহারে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার এবং সৈন্য নেয়া শুরু হয়। শান্তিরক্ষী হিসেবে গত ২৪ থেকে ২৫ বছরে বাংলাদেশের প্রায় দেড় লাখ সশস্ত্র ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য পর্যায়ক্রমে অংশ নিয়েছেন। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম। বেড়েছে মিশন সংখ্যা। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ১৩টি শান্তিরক্ষা মিশন কাজ করেছে। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে মিশন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১টি। বর্তমানে শান্তিরক্ষা মিশনের সংখ্যা ৬০টিতে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সক্রিয় অংশীদার। উৎসাহের সঙ্গে জাতিসংঘের ডাকে সাড়া দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘ কার্যক্রমের সঙ্গে বাংলাদেশ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত এবং অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে মহান দায়িত্ব পালন করে আসছে। নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য, কূটনৈতিকভাবে সম্মানজনক এবং সর্বোপরি সাংবিধানিকভাবে অনুমোদিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশ স্বপ্রণোদিত হয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে সৈন্য যোগানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সৈন্য প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা বিশেষ গুণাবলীর কারণে জাতিসংঘ ও বিবদমান উভয়পক্ষের বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে। সুশৃঙ্খল এবং পেশাদারী মনোভাব, কার্য সম্পাদনে নিরপেক্ষতা, জাতিসংঘের নির্দেশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ, মোতায়েনকৃত দেশের জনসাধারণের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক আচরণ বাংলাদেশের সুনাম আরও বেশি করে বয়ে এনে দিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৩৭টি মিশনে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। মিশনগুলো জাতিসংঘ ইরাক-কুয়েত পর্যবেক্ষক মিশন, জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মিশন তাজিকিস্তান, জাতিসংঘ ইরান-ইরাক সামরিক পর্যবেক্ষক, জাতিসংঘ গার্ড কন্টিনজেন্ট ইরাক, জাতিসংঘ সমর্থন মিশন, আফগানিস্তান, জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মিশন জর্জিয়া, জাতিসংঘ ট্রানজিশন কর্তৃপক্ষ, কম্বোডিয়া, জাতিসংঘ অগ্রগামী মিশন কম্বোডিয়া, জাতিসংঘ অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ কম্বোডিয়া, জাতিসংঘ প্রোটেকশন ফোর্স, সাবেক যুগোশ্লাভিয়া, জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মিশন প্রেভলাকা, জাতিসংঘ অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন পূর্ব সেøাভেনিয়া, জাতিসংঘ প্রোটেকশন ফোর্স, জাতিসংঘ সহায়তা মিশন রুয়ান্ডা, জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মিশন লাইবেরিয়া, জাতিসংঘ ভেরিফিকেশন মিশন এঙ্গোলা, জাতিসংঘ ভেরিফিকেশন মিশন এঙ্গোলা, জাতিসংঘ অন্তর্বর্তীকালীন সহযোগিতা কম্বোডিয়া, জাতিসংঘ অপারেশন সোমালিয়া, জাতিসংঘ অপারেশন সোমালিয়া, জাতিসংঘ অপারেশন মোজাম্বিক, জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মিশন উগান্ডা/রুয়ান্ডা, জাতিসংঘ মিশন হাইতি, জাতিসংঘ রেফারেন্ডাম মিশন পশ্চিম সাহারা, জাতিসংঘ অর্গানাইজেশন মিশন কঙ্গো, জাতিসংঘ মিশন সিয়েরালিওন, জাতিসংঘ অগ্রগামী মিশন পূর্ব তিমুর, জাতিসংঘ অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন পূর্ব তিমুর, জাতিসংঘ মিশন পূর্ব তিমুর, জাতিসংঘ মিশন কসোভো, জাতিসংঘ মিশন ইথিওপিয়া/ইরিত্রিয়া, জাতিসংঘ মিশন লাইবেরিয়া। বর্তমানে জাতিসংঘের ১৫টি মিশন চালু রয়েছে। এর মধ্যে ১২টিতে রয়েছে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী। এগুলো হলো জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মিশন জর্জিয়া, জাতিসংঘ মিশন কসোভো, জাতিসংঘ রেফারেন্ডাম মিশন পশ্চিম সাহারা, জাতিসংঘ মিশন সিয়েরালিওন, জাতিসংঘ অপারেশন মিশন আইভরিকোস্ট, জাতিসংঘ অর্গানাইজেশন মিশন কঙ্গো, জাতিসংঘ মিশন পূর্ব তিমুর, জাতিসংঘ মিশন ইথিওপিয়া/ ইরিত্রিয়া, জাতিসংঘ মিশন লাইবেরিয়া, জাতিসংঘ সহায়তা মিশন আফগানিস্তান, জাতিসংঘ অগ্রগামী মিশন সুদান, জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মিশন বুরুন্ডি। জাতিসংঘের র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী শান্তি রক্ষা মিশনে ২০০৫ সালের অক্টোবর থেকেই একটানা শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের স্থান এক নম্বরে। জাতিসংঘের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে চালু থাকা ১৫টি শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিচ্ছে ১০৯ সদস্যরাষ্ট্রের ৭২ হাজার ৯৮৩ সেনা। তাদের বেশিরভাগই উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করছে। বর্তমানে সামরিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তিরক্ষায় সক্রিয় শীর্ষ ১০টি দেশ হলো বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, জর্দান, নেপাল, ইথিওপিয়া, উরুগুয়ে, ঘানা, নাইজিরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। জাতিসংঘের করা র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী ১০ হাজার ১৭২ সামরিক সদস্যের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ রয়েছে সবার ওপর। ৯ হাজার ৬৩০ সেনার বহর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তান। ৮ হাজার ৯৯৬ শান্তিরক্ষী নিয়ে ভারতের অবস্থান তৃতীয়। সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী বর্তমান শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল থেকেই অংশ নিচ্ছে ৪০ শতাংশেরও বেশি সেনা। এদিকে, শনিবার দিবসটি কেন্দ্র করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সিএলএনবি নামের একটি সংগঠন আলোচনা সভার আয়োজন করে। ‘আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সফলতা’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এর উদ্বোধন করেন কর্নেল (অব) দিদারুল আলম বীরপ্রতিক। উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালে ১৫ শান্তিরক্ষীর মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশের সফলতা শীর্ষে চলে আসে। বর্তমানে মিশনে সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের পরিচিত বয়ে এনেছে শান্তিরক্ষী, ক্রিকেট ও নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস। আমাদের দেশের শান্তিরক্ষীরা অন্য দেশের শান্তিরক্ষীদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে আলাদা। কারণ, অন্য দেশের শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘের দেয়া কাজের বাইরে কোন কাজ করেন না। কিন্ত আমাদের শান্তিরক্ষী সদস্যরা এর বাইরেও নানা রকম সামাজিক কর্মকা-ে অংশ নিয়ে আসছেন। এজন্য শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের সুনাম আরও বেশি হয়েছে। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সিএলএনবির চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ। আলোচনায় অংশ নেন নার্গিস জাহান বানু, এ্যাডভোকেট আফজাল, শামসুদ্দীন আহমেদ ও মোঃ হানিফ। আলোচকরা বলেন, শান্তিরক্ষীরা শুধু শান্তিরক্ষার কাজই করছেন না। তারা দেশের সুনাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তারা দেশে বিপুল অঙ্কের টাকা রেমিটেন্স হিসাবে আনছেন। দেশের জন্য তাদের অবদান অনেক বেশি। আমাদের সিভিল আমলা নেতাদের ব্যর্থতার কারণে বিদেশে তৈরি করা ক্ষেত্রকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কুয়েতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শান্তিরক্ষী থাকা সত্ত্বেও সেখানে জনশক্তি রফতানি ৭ বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। যদি এই দায়িত্ব শান্তিরক্ষীদের ওপর ছেড়ে দেয়া যেত তাহলে কুয়েতে জনশক্তির দুয়ার আবার খুলে যেত। একইভাবে আফ্রিকার অনেক দেশে কৃষিজমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের বেকার সমস্যার সমাধান করা যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই কাজটি করছে না সরকার। যেসব জেনারেল শান্তি মিশনে কাজ করেছেন তারা বর্তমানে অবসরে গেছেন। তাদের যদি বিশেষ দূত হিসেবে পাঠানো যেত তাহলে বাংলাদেশের শ্রমবাজার আরও বড় হতো। দেশের বেকার সমস্যা অনেক কমে যেত।
×