ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কাঁঠাল পাকা গরম আর বৃষ্টি উপেক্ষা করে উত্তরে ভোট উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৯ মে ২০১৬

কাঁঠাল পাকা গরম আর বৃষ্টি উপেক্ষা করে উত্তরে ভোট উৎসব

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ আগের রাতে টানা বৃষ্টি আর শনিবার সকালের ঘনকালো মেঘ লাল এঁটেল মাটি এলাকার ভোটারদের কাবু করতে পারেনি। খিরার অঞ্চল নামে পরিচিত বগুড়ার পশ্চিমাঞ্চলের কাহালু, দুপচাঁচিয়া, আদমদীঘির ১৯ ইউনিয়নের মানুষকে ভোটের উৎসব থেকে থামাতে পারেনি। উত্তরের নীলফামারীতে কাঁঠাল পাকা গরম উপেক্ষা করে ভোটাররা লাইনে দাঁড়িয়েছে। সিরাজগঞ্জের চরের নারী-পুরুষ মেতেছিল ভোট উৎসবে। এদিকে বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহীর তিন উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের ভোটাররা সংঘর্ষ আর সংঘাতের শঙ্কা উপেক্ষা করে দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। কোথাও কোথাও ঘটেছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবু নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার ১১ ইউনিয়নের ভোটাররা গরমে ভিজে একাকার হয়েও লাইন ধরে ভোট দিয়েছে। সমুদ্র হক, তাহমিন হক ববি, বাবু ইসলাম ও মামুন-অর-রশীদ যথাক্রমে বগুড়া, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী থেকে এসব খবর পাঠিয়েছেন। বগুড়া ॥ সমুদ্র হক বগুড়া থেকে জানান, জেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পাকা সড়ক ধরে যাওয়ার পর সকাল ন’টায় কাহালু ইউনিয়নের বুড়ইল সরকারী প্রাথমিক স্কুল কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় নারী ও পুরুষের পৃথক দুই লাইনে ভোটাররা সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। কর্তব্যরত আনসার সদস্য ভোট কক্ষের দুয়ার আগলে রেখে ভোটারদের প্রবেশ করতে সহায়তা করছেন। পোলিং অফিসার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মর্নিং শোজ দ্য ডে উল্লেখ করে বললেন ভোটাররা খুবই সুশৃঙ্খল। ভালভাবে ভোট হবে। শেষ পর্যন্ত তার কথা ফলেছে। ওই কেন্দ্রে কোন অঘটন ঘটেনি। মালঞ্চা ইউনিয়নের অঘোরমালঞ্চা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকাল দশটার দিকে দেখা যায় ভোটারদের উপস্থিতি অনেক। কেন্দ্রটি বগুড়া-নাটোর আঞ্চলিক সড়কের ধারে। ক’জন ভোটার জানালেন গত রাতের বৃষ্টিতে গ্রামের মানুষের মধ্যে কিছুটা আলসেমি পেয়েছে। তাই রয়েসয়ে আসছে। তরুণ ভোটার আইয়ুব আলী বললেন, গ্রামের মানুষ আনন্দের মধ্যে ভোট দিচ্ছে। প্রিসাইডিং অফিসার দুলাল চন্দ্র বর্মন জানালেন, উল্লিখিত সময় পর্যন্ত ৫শ’ ৫৬ ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৭শ’ ৯০। কাহালু সদর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পাকা সড়ক ধরে যাওয়ার পর তিন কিলোমিটার কাঁচা সড়ক অতিক্রম করে দৃষ্টিতে এলো জয়তুন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই কেন্দ্রেও বেলা এগারোটায় ভোটারদের উপস্থিতি খুব বেশি ছিল না। ক’জন ভোটার বললেন গত রাতের বৃষ্টিতে অনেক রাস্তায় কাদা হয়েছে। এই এলাকায় লালমাটিতে কাদা হলে তার ওপর দিয়ে সাইকেল ভ্যান চলাচল করাই কঠিন। সিএনজি চালিত অটোরিক্সা চলার তো প্রশ্নই আসে না। তখন রোদ উঠেছে। এলাকার বৈশিষ্ট্য হলো যেমন ঘন আঁঠালো কাদা হয় তেমনই এক ঘণ্টার রোদে তা শুকিয়েও যায়। পথঘাট শুকালে দুপুরের পর ভিড় বাড়বে, এমনটি জানালেন তারা। এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ২ হাজার ৭১। ওই সময় পর্যন্ত ভোট পড়ে ৩শ’ ৬০। প্রিসাইডিং অফিসার অশোক কুমার তালুকদার বললেন, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হচ্ছে। নীলফামারী ॥ ঘড়ির কাটা আটটা ছোঁয়া মাত্রই শুরু হয় ভোট উৎসব। আর ভোট শুরুর পূর্বেই কেন্দ্রগুলোতে এসে ভোটাররা সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। এখনকার ভোটাররা বোঝে নিয়মের মধ্যেই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট প্রদান করতে হবে। আমার ভোট আমি দেব দেখে শুনে বুঝে দেব। না, কোন ধরনের হুমকি বা ভয়ভীতির বালাই ছিল না ভোটারদের মাঝে। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটাররা একে একে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করছে এবং তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদান করে বেরিয়ে আসছে। হাসিমুখে ভোট প্রদান আবার হাসি মুখে বাড়ির পথে ফিরে যাওয়া। ভোটকেন্দ্রে নারীদের লাইন ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোট কেন্দ্রের প্রত্যেক বুথের সামনে পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটারের লাইন ছিল অনেক দীর্ঘ। পঞ্চম দফায় শনিবার ইউপি নির্বাচনে সকাল আটটা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকেল চারটা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হয় নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার ১১ ইউনিয়নে। ইউনিয়নগুলো ডাউয়াবাড়ি, কৈমারী, শৌলমারী, বালাগ্রাম, মীরগঞ্জ, গোলনা, শিমুলবাড়ি, ধর্মপাল, গোলমু-া, কাঠালী ও খুটামারা। ইউনিয়নগুলোতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্রসহ ৫৮ জন চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এ ছাড়া সংরক্ষিত নারী আসনে ১৫১ ও সাধারণ ওয়ার্ড সদস্য পদে ৪১০ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছে। সকাল থেকে ভোট উৎসবে একাকার নারী-পুরুষ ভোটাররা। বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেন নীলফামারীর জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন ও পুলিশ সুপার জাকির হোসেন খাঁন। তারা বলেন, এ জেলায় ২য় দফা থেকে চতুর্থ দফার নির্বাচনে নীলফামারীর কোথাও কোন সহিংস ঘটনা যেমন ঘটেনি তেমনি পঞ্চম দফার নির্বাচনেও কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হয়নি। এতে জলঢাকা উপজেলার ১১ ইউনিয়নে ১০০ কেন্দ্রে বিকেল চারটা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। সকাল থেকে দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে দেখা যায় ভোটারদের উপচে পড়া ভিড়। ফলে ওই সময়ের মধ্যে অধিকাংশ ভোট প্রদান শেষ হয়ে যায়। দুপুর দেড়টার পর ভোট কেন্দ্রগুলো ফাঁকা হয়ে পড়ে। সে সময় এক জন দুই জন করে বিক্ষিপ্তভাবে ভোট প্রদান করতে দেখা যায়। রংপুরে নারী-পুরুষ ভোটারদের উৎসবমুখর দিন ছিল ॥ পঞ্চম দফায় শনিবার রংপুরের তিনটি উপজেলার ১৬ ইউনিয়নে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে তাদের আজ ভোট উৎসব। এই উৎসবে তারা আনন্দে আত্মহারা। রংপুরে ওই সব ইউনিয়নে এবার চোখে পড়ে নারী ভোটারদের পাশাপাশি পুরুষ ভোটারদের দীর্ঘ লাইনের দৃশ্য। পুরুষরা এবার নারীদের মতো সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে এসে তাদের ভোট প্রদান করে। রংপুরের তিন উপজেলার যেসব ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়Ñ রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়ন, বদরগঞ্জ উপজেলার ১০ ইউনিয়নের মধ্যে রাধানগর, গোপীনাথপুর, রামনাথপুর, গোপালপুর, কুতুবপুর, বিষ্ণুপুর, কালুপাড়া ও লোহানীপাড়া, মধুপুর, দামোদরপুর ও তারাগঞ্জ উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ইকরচালী, সয়ার, আলমপুর, কুর্শা ও হাড়িয়ালকুটি। ১৬ ইউনিয়নের ১৪৮ কেন্দ্রে ৩০ লাখ ৪২ হাজার ৫ ভোটার ছিল। আর চেয়ারম্যান পদে ৮৮ প্রার্থী ছিল। সিরাজগঞ্জ ॥ থেমে থেমে আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরছে, নিচে কাদাপানি। তারপরও লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটাররা অপেক্ষা করছেন ভোট দেয়ার জন্য। কাজীপুর উপজেলার শুভগাছা ইউনিয়নের ঝুনকাইল সরকারী প্রাইমারী স্কুল কেন্দ্রে সকাল সাড়ে দশটায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটারের এ উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য মেঘাচ্ছন্ন আকাশ পরিষ্কার হয়ে রোদের তাপ বাড়তে থাকে। দুপুরের পর রোদের খরতাপও বাড়ে। প্রচ- খরতাপেও কাজীপুরের দুর্গম চরের নারী-পুরুষরা ভোট উৎসবে মেতে উঠেছিল। ধূ ধূ বালিয়াড়িতে রোদের তপ্ত জ্বালা উপেক্ষা করে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের ভোট নিজে দিতে পেরে ভোটাররা আনন্দিত। প্রায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নারী ভোটারের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। তারা শুরুতেই ভোট দিয়ে ঘরগৃহস্থালীর কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘু পরিবারের ভোটাররাও তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরেছে। কাজীপুর উপজেলার চর আর সমতল ভূমির সম্মিলনের ইউনিয়ন শুভগাছা। যমুনার ভাঙ্গনে বিধ্বস্ত এ ইউনিয়নের মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে। কিন্ত ভোট এলে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের পছন্দের প্রার্থীর জন্য এগিয়ে আসেন, ভোট দেন। ইউনিয়নের ঝুইনকাইল সরকারী প্রাইমারী স্কুল কেন্দ্র সকাল সাড়ে দশটায় লাইনে দাঁড়ানো সুলতা রানী ও দীপালী রানী হালদারের বাড়ি ছিল এক সময় ঝুইনকাইল গ্রামে। যমুনার করাল গ্রাসে গ্রামটি প্রায় ১০ বছর আগে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। তার পর গ্রামের মানুষ বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। সুলতা ও দীপালীরাও বসবাস করে বর্তমান ভোট কেন্দ্র থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে সীমান্তবাজার হালারপাড়ায়। তারা বাসে চড়ে ভোট দিতে এসেছেন ঝুইনকাইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। ভোট দিয়ে তারা নিরাপদে বাড়ি ফিরেছেন। যমুনার ভাঙ্গনে বিধ্বস্ত চোরমারা ঝুইনকাইল গ্রামের সন্ধ্যা রানী দাস একজন গার্মেন্টস কর্মী । তিনিও স্বামীসহ ঢাকা থেকে এসেছেন নিজের এলাকায়। ভোট দিয়ে চলেও যাবেন ঢাকায়। এর সত্যতা মেলে মেঘাই বাজারে গিয়ে। মাইজবাড়ি ও চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের কয়েকটি ভোটকেন্দ্র ঘুরে এসে আমরা ক’জন সাংবাদিক মেঘাই বাজারে চা খেতে খেতে দেখলাম, রাস্তায় দাঁড়ানো কয়েকটি মাইক্রোবাস। ড্রাইভার ডাকাডাকি করছে কোনাবাড়ি-কোনাবাড়ি বলে। অর্থাৎ গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকেও নিজের ইউনিয়নের ভোটার গার্মেন্টস কারখানার কর্মীরা এসেছে ভোট দিতে। তারা ভোট দিয়ে আবার চলেও যাচ্ছেন। কাজীপুরের ১২ ইউনিয়নের ছয়টি দুর্গম চরে। বাকি ৬ সমতল ভূমিতে। এর মধ্যে কাজীপুর সদর ইউনিয়নে আইনী জটিলতায় ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। অপর ১১ ইউনিয়নে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। কোথাও কোথাও মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া, পাল্টাধাওয়ার মতো সামান্য বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও রক্তপাত হয়নি কোথাও। তবে উপজেলার নাটুয়ারপাড়া ইউনিয়নের খাস সুরিবের উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে জালভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে ২ মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৪ জন আহত হয়েছে। আফানিয়া ভোটকেন্দ্রে জালভোট দেবার সময় সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে ৬ মাসের কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক সাইফুল হাসান হাতেনাতে আটক করার পর তাকে এ দ- প্রদান করেন। নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে প্রকাশ্যে প্রচার চালানোর অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট শুভগাছা ইউনিয়নের বীরশুভগাছা ভোটকেন্দ্রে মোসলেম উদ্দিন ও আব্দুল বাছেদকে এক হাজার টাকা করে জরিমানাও করেছেন। রাজশাহী ॥ ভোটের আগে সংঘর্ষ ও সংঘাতের শঙ্কা থাকলেও ভোটের দিন তেমন কিছুই ঘটেনি রাজশাহীর তিন উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের নির্বাচনে। সব শঙ্কা পেছনে ফেলে ভোটাররা সকাল থেকেই উপস্থিত হন নিজ নিজ ভোটকেন্দ্রে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছেন তারা। জেলার কয়েকটি কেন্দ্রে সামান্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও সার্বিকভাবে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ছিল ভোটারদের উপস্থিতি নজরকাড়ার মতো। বেলা এগারোটার মধ্য কোন কোন ভোটকেন্দ্রে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর ইউনিয়নের ভাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় নারী ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে লাইনে দাঁড়িয়ে একের পর এক ভোট দিচ্ছেন। নারী ভোটাররা জানান, তারা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়েছেন। কোন সমস্যা হয়নি। এ কেন্দ্রে ৫০ ভাগের বেশি ভোট কাস্ট হয়েছে। বেলা ১ টার দিকে চারঘাটের খোর্দ গবিন্দপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে ভোটারদের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ। বেলা দেড়টার দিকে এ কেন্দ্রে ৬০ ভাগের বেশি ভোট কাস্ট হয়েছে। কোন শঙ্কা ছাড়াই মানুষ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। এ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসার পর স্থানীয় ভোটার গোলাম রাব্বানী জানান, এখানে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ হচ্ছে। কোন বাধারমুখে পড়েননি কেউ। একই উপজেলার মাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে নারী ও পুরুষের বিশাল লাইন। তারাও নির্বিঘেœ ভোট দিচ্ছেন। সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পরিচিত জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়েও ভোটারদের লম্বা লাইন দেখা যায়। স্থানীয়রা জানান, ভোটের আগে সহিংসতার নানা কথা শোনা গেলেও সকাল থেকে এসব এলাকায় ভোট চলছে শান্তিপূর্ণভাবে। সকালের দিকে কোন কোন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায় প্রতিটি কেন্দ্রে। তবে জেলার ১৪ ইউনিয়নের কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট শুরুর পর সামান্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পঞ্চম ধাপে শনিবার রাজশাহীর পুঠিয়া, দুর্গাপুর ও চারঘাট উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের ১৩১ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হয়। ভোট শুরুর পর শনিবার সকালে চারঘাট উপজেলার নিমপাড়া ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামে সামান্য সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ভোটকেন্দ্রের পাশে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে এই সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হন। কেন্দ্র দখলে মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ ॥ মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল মুন্সীগঞ্জের মোল্লাকান্দি থেকে জানান, ‘বাপ-চাচার মুখে যুদ্ধের কথা শুনছি। চোখে দেখি নাই। যুদ্ধে নাকি গোলাগুলি শুরু হইলে পালাইয়া ঝোপ-জঙ্গলে আশ্রয় নিতো। মাটির সাথে শুইয়া থাকতো। আইজ বুঝছি অমুন বিপদে মানুষ বাঁচার জন্য কি করে’Ñ এমনিভাবে বলছিলেন মুন্সীগঞ্জ সদরের মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের রাজারচর গ্রামের মর্জিনা বেগম (২৯)। পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে শনিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রাজারচর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্র দখলের চেষ্টায় মুহুর্মুহু ককটেলের বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হচ্ছিল। একের পর এক ককটেল এসে পড়ে ভোট কেন্দ্রে। আর প্রকট শব্দ, ধোঁয়া, বারুদের গন্ধ আর ঝলসে যাওয়ার দৃশ্য। কেন্দ্রের ভেতরে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং, পোলিং অফিসার, আনসার এবং এজেন্ট অনেকেই মেঝেতে শুয়ে পড়েন আত্মরক্ষায়। প্রাণ বাঁচাতে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলেন তখন। এ সময় কেন্দ্রের কক্ষের ভেতরে আটকা পড়েন মর্জিনা। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি দরজা বন্ধ করে রাখা স্কুল ভবনের পেছনের অংশের জানালা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসেন। এ সময় আহত হন মর্জিনা। কেন্দ্রের পাশেই বাড়ি তার। সেখানেও পড়ছিল বোমা। পরিবার-পরিজন নিয়ে কি করবেন দিশা পাচ্ছিলেন না মর্জিনা। একই অবস্থায় পড়েন বিভিন্ন বয়সী শত শত নারী-পুরুষ ভোটার। এ অবস্থা চলে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং ম্যাজিস্ট্রেট এসেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। বোমা হামলাকারীদের ধাওয়া দেয় একদল পুলিশ। কিন্তু একপর্যায়ে হামলাকারীরাই পাল্টাধাওয়া করে পুলিশকে। পরিস্থিতির শিকার সহকারী পুলিশ সুপার আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, শুধু সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় আটজনের পুলিশের দলটি নিয়ে বেঁচে আসি। বিলে (ধান-পাটের জমি) ধাওয়া দেয়া হয়। পেছনে কেন্দ্রের পাশের সেতুর উপরে ছিল বিজিবি। তারা যেই চলে গেল পুলিশের সংখ্যা কম দেখে সেই পাল্টা হামলা করল বোমাবাজরা। এ সময় পুলিশ শতাধিক রাউন্ড গুলি ছুড়লে হামলাকারীরাও গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এর আগে ভোট কেন্দ্রে শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। হেলম্যাট থাকায় প্রাণে রক্ষা পেলেও এ সময় সোহেল (৩২) নামে এক পুলিশ কনস্টেবল আহত হন। সাড়ে দশটার দিকে একবার ভোটগ্রহণ শুরু করলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় আবারও বন্ধ করা হয়। পরে বেলা এগারোটার দিকে আবার ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ২ হাজার ৫৫৬ ভোটারের এই কেন্দ্রে এতকিছুর পরও আবার ভোটারের লম্বা লাইন বিস্মিত হওয়ার মতো। ওই গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী শাহনাজ বেগম তিনবার ভোট দিতে এসে ফিরে যান। চারবারের মাথায় বেলা দুটোর দিকে ভোট দেন ওই নারী। এ সময় নারী লাইনে ভোট দেয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন মালা আক্তার। প্রথমবারের মতো ভোট দিতে এসেই নানা বিড়ম্বনা। সমাজকর্মে স্নাতক সম্মানের দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রী বলেন, তারপরও জীবনের প্রথম ভোটটি প্রয়োগ করতে চাচ্ছি। এই লাইনের আরও একটু সামনে ছিলেন আরেক নতুন ভোটার গৃহিণী ফাতেমা বেগম। তাদের প্রশ্ন ভোট নিয়ে এত হাঙ্গামা কেন? কেন্দ্র ঘেঁষা রাজারচর জামে মসজিদেও বোমা এসে পড়ে। টাইলস ভেঙ্গে যায়, ঝলসে যায় দেয়াল। প্রত্যক্ষদর্শী মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ভাল থাকলে এমন ঘটনা ঘটতে পারত না। সহিংসতার সময় পুরনো আমলের বন্দুক দিয়ে গুলি বের হচ্ছিল না। আর পরে আসা সদস্যদের আধুনিক অস্ত্র থাকলেও তাদের ভূমিকা কার্যকরী বলা যাবে না।
×