ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

পশ্চিমবঙ্গ-অসমের নির্বাচনী ফল এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২৯ মে ২০১৬

পশ্চিমবঙ্গ-অসমের নির্বাচনী ফল এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

ভারতের পাঁচটি রাজ্যের বিধান সভা নির্বাচনের ফল গত ১৯ মে একসঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে সার্বিক বিশ্লেষণের গড় হিসাবে বাম-কংগ্রেস পিছিয়েছে এবং বিজেপি এগিয়েছে। আর এককভাবে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস প্রত্যাশার চাইতে বেশি আসনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে। অসমে কংগ্রেসের টানা ১৫ বছরের শাসনকে হটিয়ে বড় বিজয় পেয়েছে বিজেপি। ভারতের রাজ্য-রাজনীতি ও নির্বাচনের ফল আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ওপর কোন রেখাপাত করার কথা নয়। কারণ সংবিধান অনুযায়ী বিদেশ নীতি ও সম্পর্কের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভুক্ত। তবে বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সমীকরণে রাজ্যের রাজনীতি ও ক্ষমতা বলয়ের প্রভাবে কেন্দ্রের বিদেশী নীতি প্রভাবিত হয়েছে এবং সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্র নিজেদের মতো করে এগোতে পারেনি। বাংলাদেশ-ভারত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি আমার উপরোক্ত কথার জীবন্ত উদাহরণ। কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় সরকারের আন্তরিকতা ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জীর অসম্মতির কারণে। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় সব কিছু চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও শেষ মুহূর্তে মমতা ব্যানার্জী বেঁকে বসায় সে যাত্রায় আর তিস্তা ও ছিটমহল বিনিময় চুক্তির কোনটাই হলো না। কূলে এসে তরী ডোবায় আমরা নিশ্চিতভাবে হতাশ হলাম। তারপর ভারতের নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মমতা ব্যানার্জী ঢাকায় এলেন। ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের দুঃখ লাঘবে সম্মতি দিলেও তিস্তাকে তিনি ‘না’ বললেন। তার পরেও আমরা তিস্তার বেদনাকে বুকে চেপে রেখে দিদিকে স্বাগত জানালাম, অভিনন্দিত করলাম। দিদি বললেন, ভরসা-আস্থা রাখেন তিস্তাও হবে। আমরাও তখন আশায় বুক বেঁধেছি এই ভেবে যে, হয়ত ২০১৬ সালের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য দিদি অপেক্ষা করছেন। এখন সফলভাবে সে বৈতরণী পার হওয়ায় আমরা নতুন আশায় দিদির অভূতপূর্ব বিজয়কে অভিনন্দন জানিয়েছি। সুতরাং সামনে সুদিনের প্রত্যাশা অযৌক্তিক নয়। সঙ্গে এ কথাটিও বলতে চাই, তিস্তার পানির ন্যায়সঙ্গত হিস্যা পাওয়া আমাদের বৈধ অধিকার। বৈধ অধিকারে বঞ্চিত করা কোনভাবেই আপন ও বন্ধুজনের কাজ হতে পারে না। মমতা ব্যানার্জীকে আমরা আপন মানুষ হিসেবে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। আলাদা রাষ্ট্র হলেও দুই বাংলার অন্যরকম একটা সম্পর্ককে অটুট রাখা ও জোরদার করার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বাম ও মমতাকে কখনও আমরা ভিন্নভাবে দেখি না। সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু দুই বাংলার বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য অশেষ কাজ করেছেন। তাকে সবাই শেষ ভরসার স্থল মেনেছেন। তবে তিনি এখন আর ইহধামে নেই। জ্যোতি বাবুর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দুই বাংলার মানুষের অন্তরে ঠাঁই নেয়ার অপার সুযোগ এখন মমতা ব্যানার্জীর সামনে। বিগত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন। তবে তার ষোলোআনা বাঙালিয়ানার বৈশিষ্ট্যকে তিনি অটুট রেখেছেন। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভা নির্বাচনে এককভাবে লড়াই করে দুই-তৃতীয়াংশ আসনসহ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনকে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মমতার প্রবেশের পথে আরেকটি দ্বার প্রশস্ত হলো বলে মন্তব্য করেছেন ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সেই জায়গার বিবেচনা থেকে বলতে চাই, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং বৃহত্তর স্বার্থে উভয় দেশের নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের সঙ্গে মূল ভারতের ভূখ-গত অখ-তা রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে আজ তা মূল্যায়ন করতে হবে মমতা ব্যানার্জীসহ ভারতের সব নেতৃবৃন্দকে। ভারতের রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের এই বাস্তবতা উপলব্ধির চাক্ষুষ প্রমাণ আমরা দেখেছি ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর। বাংলাদেশের ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির ধারক-বাহকগণের ধারণা ছিল ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ও ভারতের কংগ্রেস সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে যেসব রাজনৈতিক বক্তব্য-বক্তৃতা দিয়েছেন, তার সবকিছুকে পেছনে ফেলে কংগ্রেসের নীতি ও সিদ্ধান্তকে শুধু অটুটই রাখেননি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছেন। এই রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মোদি আজ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন। সুতরাং দুই বাংলার মানুষের সম্পর্ক তো আছেই, তার ওপর ভারত-বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন আজ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এই অপরিহার্য বাস্তবতাকে মমতা ব্যানার্জী নিশ্চয়ই উপলব্ধিতে নেবেন। সুতরাং আমরা ধরে নিতে চাই, বিধান সভা নির্বাচনের অভূতপূর্ব সাফল্যকে তিনি দুই দেশের সম্পকর্কে আরও সুদৃঢ় করার কাজে লাগাবেন। পশ্চিমবঙ্গে অবাঙালী মুসলমানদের একটা অংশ বাংলাদেশের জামায়াত ও জামায়াতপ্রসূত উগ্রবাদী জেএমবি এবং অন্যান্য জঙ্গীর প্রতি সহানুভূতিশীল। ফলে বাংলাদেশ থেকে ধাওয়া খেয়ে জেএমবি ও অন্য জঙ্গীরা এই অবাঙালী মৌলবাদীদের কাছে আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়। এটা দুই দেশের নিরাপত্তার জন্যই হুমকির কথা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১৪ সালে মুর্শিদাবাদের খাগড়াগড়ে জেএমবির আস্তানায় বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে। তখন অভিযোগ ওঠে বাংলাদেশের জেএমবির আশ্রয় প্রদানকারীরা মমতা ব্যানার্জীর ভোট ব্যাংক হওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে না। এই অভিযোগ শতভাগ প্রমাণিত না হলেও দিল্লী কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে অভিযোগটি একেবারে অমূলক মনে হয়নি। আপাতত ভোট পেলেও মমতার সহজাত আদর্শগত বিশ্বাসের কারণে এই ধর্মান্ধ ইসলামিস্ট মৌলবাদীরা শেষ বিচারে মমতার জন্য ঘরের শত্রু বিভীষণ হতে বাধ্য। অসাম্প্র্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপক মানুষের সমর্থন ব্যতিরেকে এত বড় বিজয় অর্জন করা তার পক্ষে সম্ভব হতো না। এই সাধারণ সত্য কথাটি তিনি ধারণ করলে ভাল করবেন। এক দেশের জঙ্গীরা যাতে অন্য দেশে আশ্রয় না পায় সেটাই এখন দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার অন্যতম প্রধান একটি ক্ষেত্র। পশ্চিমবঙ্গের পর অসমের রাজ্য নির্বাচনের ফল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্ব বহন করে। সাতচল্লিশ সালের পর এবারই প্রথম অসমে বড় বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করবে বিজেপি। নির্বাচনী জনসভায় বিজেপির নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে ভাবী মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়ালের বক্তৃতায় বাংলাভাষীর বড় একাংশ মানুষের দিকে ইঙ্গিত করে অনুপ্রবেশের ইস্যুটিকে যেভাবে সামনে এনেছেন তা শান্তিপ্রিয় এবং দুই দেশের সুসম্পর্কে বিশ্বাসী ও প্রত্যাশী মানুষের মনে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। তবে এই নির্বাচনী মাঠের বক্তৃতাকে অনেকেই আবার গুরুত্ব দিচ্ছেন না। নির্বাচনী বক্তৃতায় অবাস্তবতার পাল্লা ভারি থাকে। আর সরকার পরিচালনায় ভারি থাকে বাস্তবতার পাল্লা। ক্ষমতায় এসে সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হয়। ২০১৪ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অসমের জনসভায় একই রকম বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে তার কিছুই এখনও নরেন্দ্র মোদির ভূমিকায় দেখা যায়নি। বরং ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় ভূমির নিষ্পত্তি এবং সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ইস্যুগুলোর ওপর অসমের বিজেপি নেতৃবৃন্দের আপত্তি ও প্রদত্ত সব শর্তকে উপেক্ষা করে তিনি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছেন। অসমের নতুন সরকার নিশ্চয় মনে রাখবে অসম আজ নিরাপদ এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। অসম সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পেছনে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অশেষ অবদান রয়েছে। সুতরাং পুরনো ইস্যুকে নতুন করে সামনে এনে উভয় দেশের সরকারের জন্য সঙ্কট সৃষ্টি করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, প্রজ্ঞার পরিচায়ক হবে না। এ কথা উপলব্ধি করার মতো ভারতে অনেক প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতা আছেন, রয়েছে শক্তিশালী একটি সুশীল সমাজ। আরেকটি ইতিবাচক দিক হলোÑ ভারতের কেন্দ্রে ও অসমে এখন একই দল অর্থাৎ বিজেপি সরকার রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যথার্থ কারণেই বিশেষ গুরুত্ব দেন। ভারতের অভিজ্ঞ কূটনীতিকগণ বলছেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির প্রধান কারিগর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁরা নিশ্চয়ই এমন কিছু হতে দেবেন না, যা ইতোমধ্যে স্থাপিত সম্পর্কের ওপর কোন রকম বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সুতরাং আমরা আশা করতে পারিÑ অসমে বিজেপির উত্থান বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার কারণ হবে না। একইভাবে দ্বিতীয় দফায় বিপুল বিজয় এবং তার মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আস্থা বাড়ার ফলে তিস্তা চুক্তির পথ প্রশস্ত হবে। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×