ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদার সাজা হওয়ার আশঙ্কায় বিএনপিতে অনৈক্য বেড়েছে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৮ মে ২০১৬

খালেদার সাজা হওয়ার আশঙ্কায় বিএনপিতে অনৈক্য বেড়েছে

শরীফুল ইসলাম ॥ কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে অনৈক্য ও সমন্বয়হীনতার কারণে বিএনপিতে এখন বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। জাতীয় কাউন্সিলের পর কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর হাইকমান্ডের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দলে ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্য প্রকট হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দুর্নীতির অভিযোগে দুই মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হয়ে যেতে পারে এবং তা হলে মামলার অপর আসামি তারেক রহমানও দেশে ফেরার চেষ্টা করবেন না এমন আশঙ্কা থেকে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। সূত্র মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে ক্ষমতা থেকে দূরে সরে আসা বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় থাকলেও জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে গতি সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন দলীয় হাইকমান্ড। কিন্তু জাতীয় কাউন্সিলের আড়াই মাস পরও ৪ দফায় ৪২ জন ছাড়া আর কাউকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান দিতে না পারা, নতুন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে অন্য নেতারা সহযোগিতা না করা, অপেক্ষাকৃত সিনিয়র নেতাদের ডিঙ্গিয়ে রাজনীতিতে নবীন কিছু নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া এবং সুবিধাবাদী কিছু নেতা দলে সক্রিয় না থেকে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ভবিষ্যতের পথ সুগম করাসহ বিভিন্ন কারণে বিএনপিতে এখন অনৈক্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না দলীয় হাইকমান্ড। আর এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার গ্রেফতারের আশঙ্কা দেখা দেয়ায় নতুন করে বেকায়দায় দলটি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার প্রধান আসামি খালেদা জিয়া আগামী ২ জুন আদালতে হাজির না হলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হবে বলে ইতোমধ্যেই বিশেষ জজ আদালতের বিচারক নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান এ দুটি মামলাসহ আরও ১৩টি মামলার গতি বাড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। আর এ কারণেই দলের নেতাকর্মীদের আশঙ্কা. অস্থিরতা ও অনৈক্য বেড়েছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন দলীয় হাইকমান্ডও। এদিকে বিএনপিতে যে অনৈক্য, সমন্বয়হীনতা ও অস্থিরতা বেড়েছে তার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেয়া সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য থেকেই। ২৫ মে সন্ধ্যায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) আয়োজিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বিএনপি এখন কঠিন সময় পার করছে। তাই দলের এমন সময়ে নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ না হলে দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা-পরোয়ানা বিএনপিকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। তাকে কারা-অন্তরীণ করার জন্যই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলাও এরই অংশ। ২৬ মে নয়াপল্টন ভাসানী ভবনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষে দলের এক যৌথসভায় সভাপতির বক্তব্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের আশঙ্কা প্রকাশ করে তাঁকে গ্রেফতারের পরিণাম ভাল হবে না বলে সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, বিএনপিকে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। যেভাবে ছিল ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে। এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পত্র-পত্রিকায় এখানে-ওখানে গোপন বৈঠকের কথা লেখা হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি যে, কোন একটি চক্র আগে থেকেই একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে বিএনপিকে একটা দলাদলি বা গ্রুপিংয়ের মধ্যে ফেলার। কোন একটা কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এ চক্রান্তটা করে বেড়াচ্ছে। যার একটি ছায়া মহানগর বিএনপিতেও পড়তে দেখা যাচ্ছে। একই অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, খালেদা জিয়া জেলে যাচ্ছেন প্রতিদিন এ খবরটা গণমাধ্যমে আসছে। কিন্তু পদ-পদবির জন্য বিএনপি নেতাকর্মীদের জীবনবৃত্তান্ত দেয়া বন্ধ হয়নি। আজ পর্যন্ত শুনলাম না অমুক নেতার বাসায় বৈঠক হয়েছে সঙ্কট মোকাবেলার জন্য। দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, যাকে ছাড়া দল চলবে না তার বিপদের জন্য আমরা কিছু করি না। আর আমরা পদের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছি। খালেদা জিয়ার মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার অনেক পরিকল্পনা করতে পারে, তাঁকে জেলে নেবেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমরা যদি পথ সৃষ্টি করে দেই, এটা আমাদের সঠিক কাজ হবে না। গয়েশ্বর বলেন, অতীতে যারা ওয়ান-ইলেভেনের সময় ষড়যন্ত্র করছে তাদের আমরা চিনি। তারা সঠিক পথে থাকলে আমাদের কোন সমস্যা নেই। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান যদি জেনে শুনে শত্রুদের অবস্থান দেন সেখানে তো কর্মীরা হতাশ হয়। কখনও কখনও ভয় পায়। তাই নেত্রীকে শক্ত হতে হবে। তাকে চক্রান্তের পয়জনগুলোকে পরিষ্কার করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের মতে, ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের মতো আবারও চরম দুরাবস্থার মুখে পড়তে যাচ্ছে বিএনপি। খালেদা জিয়ার গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা, কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে অনৈক্য, দল পরিচালনায় চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে কিছু কেন্দ্রীয় নেতার বিরোধ, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না দেয়া, জাতীয় কাউন্সিলের আড়াই মাস পরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে বিএনপিতে এখন নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। উল্লেখ্য, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও আসামি। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে একটি বিদেশী ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাত করার অভিযোগে এ মামলা করা হয়। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ এ মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ অপর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এছাড়া বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতি মামলা বাতিল চেয়ে খালেদা জিয়ার করা আবেদন খারিজ করে হাইকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে ২৫ মে। এ রায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন আটকে থাকা এ মামলার বিচারিক কার্যক্রমও আবার শুরু হচ্ছে। রায়ে দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। এছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলারও অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে আদালতে। আর ডান্ডি ডায়িং ঋণখেলাপী মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ১৯ জুন। জানা যায়, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অধিকাংশকেই বিশ্বাস করেন না দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। মাঝেমধ্যে দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বৈঠক করলেও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেন না তিনি। যে কোন সিদ্ধান্ত তিনি একাই নেন। তবে কোন কোন বিষয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা নিলেও এ নিয়ে তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এ পরিস্থিতিতে খোদ বিএনপি নেতাকর্মীদেরই ইদানিং আক্ষেপ করে বলাবলি করতে শোনা যায়, এভাবে দল চলতে পারে না। আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি অথচ দলের ভেতর কোন গণতন্ত্র নেই। দলের কাউন্সিলে সবাই চেয়ারপার্সনকে কমিটি গঠনের দায়িত্ব দিয়েছেন। তাই বলে তিনি আড়াই মাস পরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেবেন না। এদিকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব থেকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব হওয়ার পরও দলে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছেন না মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ কারণে তিনি চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন। দলে কার্যত এখন তার কোন কাজ নেই। মাঝেমধ্যে দলীয় সংবাদ সম্মেলন ও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখা ছাড়া তেমন কোন কাজে তাকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় না। তবে তার পক্ষ হয়ে কোন কোন নেতা খালেদা জিয়াকে মহাসচিবের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার কথা বললেও খালেদা জিয়া বিষয়টিকে তেমন আমলে নেননি বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী বৈরী পরিস্থিতির রেশ কাটিয়ে উঠতে বিএনপিকে এখনও অনেক খেসারত দিতে হচ্ছে। সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতাদের নিয়ে দলে এখনও সন্দেহ-অবিশ্বাস চলছে। তাদের কেউ কেউ বিএনপির আদলে নতুন দল গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় গোপন বৈঠক অব্যাহত রেখেছেন। এ পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়া ও দলের অসংখ্য নেতাকর্মী মামলায় জড়িয়ে থাকায় নাজুক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারছে না দলটি। জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে গতিশীল করে তোলার চেষ্টা করেও অনৈক্য প্রকট হওয়ায় সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা ভর করেছে। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে এবং তারেক রহমান দেশে ফিরে না এলে বিএনপি আবারও ভাঙ্গনের কবলে পড়তে পারে বলেও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে। আর এ আশঙ্কা থেকেই ইদানিং বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছেন দলের ঐক্য ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, অনেক নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে বিএনপিকে। তাই সামনে যদি নতুন করে কোন সমস্যার মোকাবেলা করতে হয় তাহলে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন হবে। ঐক্য না থাকলে সংকট মোকাবেলা করা কঠিন হবে। তাই সিনিয়র নেতারা বার বার দলে ঐক্যের ওপর জোর দিচ্ছেন।
×