এম শাহজাহান ॥ মানব মূলধন গঠনে আসন্ন ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে শিশু উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। এজন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে শিশু বাজেট। শিশু সুরক্ষা, কল্যাণ ও বিকাশে বাড়বে সরকারী বিনিয়োগ। শিশুদের প্রারম্ভিক যতেœ বিনিয়োগের সামাজিক রিটার্ন বেশি হওয়ায় তা দারিদ্র্য বৈষম্য হ্রাসে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে শিশু উন্নয়নে প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটেও শিশুদের জন্য পৃথক বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের চেয়ে এ খাতে বাড়ানো হবে বরাদ্দ। বর্তমান পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২৫ হাজার ৮৫৩ কোটি ২৬ লাখ ৮২ হাজার টাকার বাজেট বাস্তবায়ন করছে সরকার। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে কর্মক্ষম অংশের অনুপাত সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে আগামী ২০৪২ সাল নাগাদ। জনমিতির এই সুবিধার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করতে হলে আজকে যে শিশু জন্ম গ্রহণ করবে তার দিকে সবচেয়ে বেশি যতœবান হতে হবে বলে মনে করছে সরকার। শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যত, আগামী দিনে জাতির কা-ারী। তাই এ সময় থেকেই তাদের গড়ে উঠতে হবে। যেতে হবে বহুদূর। ইতোমধ্যে শিশু উন্নয়নে নানা ধরনের প্রশাসনিক ও আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর
মধ্যে শিশু আইন-২০১৩ এবং জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ অন্যতম। এছাড়া বাংলাদেশ জাতিসংঘের কনভেনশন অন রাইটস অব চিল্ড্রেন অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই অনুমোদনের ফলে শিশু রক্ষায় দেশে যে আইনগুলো করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, আগামী বাজেটে শিশু উন্নয়নের লক্ষ্যে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কাজ করা হবে। এগুলো হচ্ছে-স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। পাঁচ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেটে। এতে শিশুদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের হিসাব দেয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, সকল মন্ত্রণালয়ের শিশুকল্যাণ সংক্রান্ত কাজ চিহ্নিত করার জন্য স্ট্রেনদেনিং ক্যাপাসিটি ফর চাইল্ড ফোকাসড বাজেটিং ইন বাংলাদেশ (এসসি-সিএফবি) শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের কাতারে শামিল হতে হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম শিশু কল্যাণে সবচেয়ে বিনিয়োগ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, শিশু অধিকার রক্ষা ও কল্যাণে বর্তমান সরকার চলতি বাজেটের ন্যায় পৃথক ‘শিশু বাজেট’ দিতে যাচ্ছে। বাড়বে বরাদ্দও। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত বাজেট প্রণয়নের কাজ এগিয়ে নেয়া হয়েছে। নারী ও শিশু উন্নয়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে এ দুটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বড় সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের ১৬ দেশের একটি যেখানে শিশুমৃত্যু এবং সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলে-মেয়েদের নিট ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। এ অগ্রগতির যাত্রাপথে তাই শিশুদের কল্যাণে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। কেননা, তারাই দেশের ভবিষ্যত। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে বিদ্যমান জনসংখ্যার বিপুল অংশ শিশু। এই বিপুল অংশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মননশীলতার বিকাশে সর্বোচ্চ যতœ না নেয়া হলে সরকারের সামগ্রিক কর্মপ্রয়াসের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন দুরূহ হবে।
এদিকে, শিশু কল্যাণে সরকার আন্তরিক হলেও শিশুর প্রতি নৃশংসতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শিশুহত্যা প্রতিরোধের আহ্বান এখন সব মহলে জোরদার হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে বলা হয়, দুই-তৃতীয়াংশ শিশুকে মা-বাবা মারধর করেন। ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশুকে মানসিক চাপ দিয়ে শৃঙ্খলা শেখানো হয়। শিশু অধিকার ফোরামের এক হিসাবে দেখা গেছে, গত সাড়ে তিন বছরে ৭৭৭ শিশু নির্যাতনে মারা গেছে। শিশুহত্যা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের কল্যাণে বর্তমান সময় ব্যয়িত অর্থ বা বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে মানবসম্পদ সৃষ্টি করে যা অর্থনীতিকে প্রতিযোগিতামূলক উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে নেবে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে শিশুদের কল্যাণে যত কম বয়স থেকে বিনিয়োগ করা হয়, দীর্ঘমেয়াদে সেই বিনিয়োগের রিটার্ন তত বেশি পাওয়া যায়। প্রারম্ভিক বয়সে শিশুর অবস্থা, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য, আচরণ ও শিক্ষা পরবর্তী জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়া মা’দের বা মেয়েদের অর্থাৎ যারা আগামী দিনের মা তাদের জন্য বিনিয়োগও শিশু কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গবেষণায় প্রমাণিত -পাঁচ বছরের শিশুর মৃত্যুর হার অর্ধেকে নেমে আসে যদি মা’দের প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়।