ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যতিক্রমী বিদ্যাপীঠ, নিজস্ব সংস্কৃতিতে গড়ে উঠছে আলোকিত মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৮ মে ২০১৬

ব্যতিক্রমী বিদ্যাপীঠ, নিজস্ব সংস্কৃতিতে গড়ে উঠছে আলোকিত মানুষ

সমুদ্র হক ॥ নিভৃত গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরাও ইতিহাস-ঐতিহ্য সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখে। এমনকি নোবেল বিজয়ীদের নামও তারা বলতে পারে। যা ঢাকা ও বড় বড় শহরের অনেক নামী-দামী স্কুলের শিক্ষার্থীর অজানা। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের শিবগঞ্জ উপজেলার আমতলি মডেল স্কুলের শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠছে পাঠাগার ও ঐতিহ্য প্রদর্শনের সংগ্রহশালা (জাদুঘর) এবং সংস্কৃতির বলয়ে। যা দেশের অন্য কোথাও নেই। খোঁজখবর করেও এমনটিই জানা গেল। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এই গ্রামেরই ছেলে। নাম মীর লিয়াকত আলী। তিনি জানান, শিক্ষাকে শহরমুখী করা নয়, গ্রামেই উচ্চশিক্ষা ও পাঠদানের ক্ষেত্র সৃষ্টি করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে ২ হাজার ৩ সালে এই স্কুল তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ১০ শতাংশ জমি এবং আরও দুই ভাইয়ের ২০ শতাংশ জমির সঙ্গে ক্রয়কৃত আরও এক বিঘা অর্থাৎ মোট দুই বিঘা জমির সবটুকু দান করেন শিশুদের শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে। যাতে গ্রামের ছেলেমেয়েরা মেধাবী হয়ে শহুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজয়ী হয়ে আসতে পারে। প্লে-গ্রুপ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আমতলি মডেল স্কুলের পাশেই আরেকটি বিদ্যাপীঠ ‘মীর লিয়াকত আলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ স্থাপিত। এই দুই স্কলেই প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জন করছে। তার স্কুলের বড় বৈশিষ্ট্য-বাঙালীর শিকড়ের সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ নিয়ে সাজানো হয়েছে একটি জাদুঘর। যেখানে বাঙালী জীবনের সেকালের ব্যবহৃত এবং আজকের ব্যবহার্য নানা জিনিস ঠাঁই পেয়েছে। প্রজন্মের শিশুরা পরিচিত হয় কেমন ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের জীবনাচরণ। এই সংগ্রহশালায় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক খ-চিত্র ও বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মানুষের জীবন কাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটানো হয়। মুঘল আমল থেকে বর্তমানের দেশ বিদেশের বরেণ্য ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। মুঘল সম্রাট বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেব, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, মহাত্মা গান্ধী, আব্রাহাম লিঙ্কন, জর্জ ওয়াশিংটন, জন এফ কেনেডি এবং নেলসন ম্যান্ডেলাসহ গত শতকের ১৯০১ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত যারা নোবেল বিজয়ী হয়েছেন তাদের সবার পরিচিতিসহ ছয় শতাধিক ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। জাদুঘরে রক্ষিত খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের ছবি ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ওপর অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় ৫০ নম্বরের প্রশ্ন থাকে। যে কোন স্কলের শিক্ষার্থীরা কতটুকু জানল সেই মেধা যাচাই করা হয় এই প্রশ্নপত্রের উত্তরে। যারা এই প্রশ্নের উত্তর সঠিক দিতে পারে ও বেশি নম্বর পায় তাদের পুরস্কৃত করা হয়। এর বাইরে প্রতিবছর মেধাবীদের জন্য স্কলারশিপ ও পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকে। এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ভাষাসৈনিক বাহাউদ্দীন চৌধুরী পাঠাগার। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রতিষ্ঠাতার কথা- বই না পড়লে কেউ জ্ঞানার্জন করতে পারে না। বই না পড়লে মানবমনে ইমাজিনেশন (ভাবনা বা কল্পনা) তৈরি হয় না। কথায় আছে ইমাজিনেশন ইজ মোর পাওয়ার দ্যান নলেজ। এই ইমাজিনেশন আসবে পাঠ থেকে। সর্বোপরি মাতৃভাষা ভালভাবে জানা অতি জরুরী। মাতৃভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য জানা উচিত নতুন প্রজন্মের। যে কারণে এই পাঠাগারের নামকরণ করা হয়েছে একজন ভাষাসৈনিকের নামে। এই পাঠাগার সাধারণেরও পাঠাভ্যাস তৈরি করছে। বই পড়ার পর কি জানলেন তা লিখে দিলে তাৎক্ষণিক নগদ টাকা দেয়া হয়। এছাড়া প্রতিবছর বেশি বই পড়ে বেশি টাকা উপার্জনকারী পাঁচ পাঠককে আকর্ষণীয় পুরস্কার দেয়া হয়। এলাকায় কেউ যেন লেখাপড়া থেকে ঝরে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। যারা সচ্ছল তাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে মডেল স্কুলে। গরিব-মেধাবীদের জন্য বিনা বেতনে এই স্কুলে পাঠের ব্যবস্থা আছে। মডেল স্কুলে প্রভাতী দিবাভাগের ক্লাস শেষ হওয়ার পর সান্ধ্যকালীন বয়স্কদের শিক্ষা দেয়া হয়। এই স্কুলের শিক্ষক এলাকার নিরক্ষর বয়স্কদের জ্ঞান দান করেন। বয়স্করা শুধু অক্ষর জ্ঞান নয়, বাংলা কোন কোন ক্ষেত্রে ইংরেজী শেখা ও অঙ্কের হিসাব করতে পারে সেইসব বিষয়ে জ্ঞান দেয়া হয়। বছরে একাধিকবার স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এলাকার সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচী চালু করা হয়েছে। যেখানে জেলার সরকারী হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ অর্ধশত চিকিৎসকের একটি দল মেডিক্যাল চেকআপে নানা রোগের চিকিৎসা সেবা দেন। গ্রাজুয়েশন ডিগ্রীধারী প্রচারবিমুখ এই শিক্ষানুরাগীর নাম মীর লিয়াকত আলী। গ্রামে শিক্ষা বিস্তারে তার উদ্যোগের কথা বললেন এভাবে-২ হাজার সালের দিকে তার মেয়েকে ঢাকার একটি স্কুলে প্লে-গ্রুপে ভর্তি করতে গিয়ে দেখেন তার শিক্ষিকা স্ত্রী মাসে যে বেতন পান কেজি ক্লাসে শিশুর বেতনও তাই। তখনই তার মনে হয় এই শিক্ষাই যদি গ্রামের ছেলেমেয়েদের নামমাত্র মূল্যে দেয়া যায় তাহলে শহরমুখী শিক্ষা গ্রামেও ভালভাবে ছড়িয়ে দেয়া যাবে। এমনকি গ্রামের শিক্ষার্থীদের বহুমুখী সূযোগের পাঠাভ্যাস গড়ে তুললে তাদের মেধার বিকাশ দ্রুত হবে। এমনি ভাবনা থেকেই একে একে স্কুলে জাদুঘর, লাইব্রেরি ও খেলার মাঠ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এই স্কুলে স্বাস্থ্য সেবা দিতে যাওয়া স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডাঃ সামির হোসেন মিশু বললেন, মডেল স্কুলের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের প্রশ্ন করে উত্তর পেয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছেন যা শহরের অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীরা জানে না। অথচ গ্রামের শিক্ষার্থীরা তা ভালভাবে জানে। সংগ্রহশালায় রক্ষিত বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের ছবি দেখে তারা দ্রুত বলে দেয় কে কি ছিলেন, যা বড়রাও পারে না। সংগ্রহশালা বা জাদুঘরের ছবিগুলো হতে পারে আলোকিত মানুষের গবেষণাগার। স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মহরম আলী জানালেন পাঠ শেষে শিক্ষার্থীদের খেলার মাঠে যাওয়া বাধ্যতামূলক। কারণ খেলার মধ্যে শিক্ষার্থীদের মতে স্পোর্টসম্যান স্পিরিট। পরীক্ষার ফলের দিক দিয়েও এই স্কুল বরাবরের মতোই এগিয়ে। এবার জেএসসিতে ২৪ পরীক্ষার্থীর ১৮ জনই জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর মধ্যে বৃত্তি পেয়েছে ট্যালেন্টপুলে তিন এবং সাধারণ গ্রেডে তিন জন। মডেল স্কুল ও পাসের প্রাথমিক স্কুলের স্যানিটেশনসহ সব বিভাগ এতটাই পরিচ্ছন্ন যে পরিষ্কার মন নিয়েই শিক্ষার্থীরা এসে পাঠ গ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠাতার লালিত স্বপ্ন- গ্রামের এই শিক্ষার্থীরাই একদিন বড় হয়ে দেশ ও জাতির জন্য সুনাম বয়ে আনবে। তার ধ্যান জ্ঞান সবই স্কুলের উন্নতি নিয়ে...।
×