ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মামলা হলেও আসামিরা ধরা পড়েনি

নির্মম নির্যাতনের শিকার শিশু হাসিনা অবশেষে মারা গেল

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৮ মে ২০১৬

নির্মম নির্যাতনের শিকার শিশু হাসিনা অবশেষে মারা গেল

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ মা সালমা বেগমের অসুস্থতায় পরিবারের ভরণ-পোষণের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিল বারো বছরের হাসিনা। নিজের ভবিষ্যত জলাঞ্জলি দিয়ে মা-বাবার মুখে হাসি ফোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু তার সুখ বেশিদিন টিকেনি। গৃহকর্ত্রী লিজা ও তার স্বামীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে সারা শরীরে জখমের চিহ্ন বহন করে হাসপাতালে বেডে স্থান হলো তার। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নির্মম নির্যাতনের শিকার সেই হতভাগী শিশু গৃহপরিচারিকা হাসিনা (১২) অবশেষে না ফেরার দেশে পাড়ি জামিয়েছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার আর জ্ঞান ফিরেনি। এভাবে আটদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০৬ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নিহত শিশুটির সারা শরীরে জখমের চিহ্ন। নতুন আঘাতের সঙ্গে পুরনো ক্ষত চিহ্নের দগদগে ঘাও ছিল। নিহত শিশু হাসিনার মা সালমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তাদের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানার কালামপুর গ্রামে। তার স্বামী সোবহান দিনমজুর। আগে মোহাম্মদপুরে থাকতেন। সেখানে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসিনাকে রেখে গ্রামে চলে যান সালমা। তিনি জানান, প্রায় ৫ মাস আগে তিনি পরিচিত লিজার (ফারজানা লিজা) বাসায় মেয়ে হাসিনাকে কাজে দেন। লিজা ম্যাডাম তখন তাকে (সালমাকে) বলেছিলেন, তোমার মেয়ে আমার মেয়ের মতোই থাকবে। তার কোন কষ্ট হবে না। তিনি বলেন, আমি ম্যাডামকে (লিজা) চিনতাম। কখন তার স্বামীর নাম জানতে চাইনি। পরে শুনছি শরিফুলই তার স্বামীর নাম। এ সময়ে গৃহকর্মী লিজা ও তার স্বামী শরিফুল তারা মেয়েটিকে অনেক মারধর করে। এক পর্যায়ে মেয়ে হাসিনা অসুস্থ হয়ে পড়লে গৃহকর্তা শরিফুল তাকে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে মেয়েকে রেখে তিনি পালিয়ে যান। দু’দিন পর সংবাদ পেয়ে আমরা ঢামেকে আসি। তিনি বিলাপ করে জানান, আমার মেয়েকে ৫ মাস আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করে শরীফুল ইসলাম ও ফারজানা লিজা। নিহতের বাবা সোবহান জানান, গত সোমবার তারা গ্রামে থেকে এক আত্মীয়ের কাছে জানতে পারেন যে, হাসিনা নামের একটি মেয়ে ঢামেক হাসপাতালে পড়ে আছে। এমন খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পরদিন মঙ্গলবার তারা ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরের লিজার বাসায় যান। সেখানে বাসায় তালা দেখে বুধবার ফের হাসপাতালে যান তারা। পরে বিকেলে ঢামেক ফাঁড়ি পুলিশের সহায়তায় মেয়েকে খুঁজে পান তারা। ঢামেকে ক্যাজুয়ালিটি ইউনিট-২ এর সহকারী রেজিস্ট্রার ডাঃ মোস্তফা আল মামুন জানান, শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। আটদিনেও জ্ঞান ফেরেনি মেয়েটির। অবশেষে শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তিনি জানান, মেয়েটির সারা গায়ে নতুন-পুরনো অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন ছিল। মাথার ক্ষত দিয়ে পুঁজ পড়ছিল। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। বাঁচাতে পারলে মনে শান্তি পেতাম। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর জনকণ্ঠকে জানান, ঘটনা শোনার পরই হাসিনার বাবা-মাকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। এরপর শিশুটির মা বাসার গৃহকর্ত্রী লিজা ও তার স্বামীর শরিফুলের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করেন। শিশুটি মারা যাওয়ায় হত্যা মামলা হিসেবে পরিচালিত হবে। আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই প্রবীর চন্দ্র জনকণ্ঠকে জানান, মোহাম্মদপুরের টাউন হলের একটি মুরগির দোকানে কাজ করে শরীফুল। তাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুরে। শের শাহসূরী রোডের ১৬ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় স্ত্রী লিজা ও তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকে শরীফুল। প্রায় পাঁচ মাস আগে হাসিনাকে তাদের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে রাখা হয়। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জেনেছে, হাসিনার কোন দুর্ঘটনা হয়নি। তার শরীরে নতুন ও পুরনো জখমের সব দাগই হয়েছে নির্মম নির্যাতনের। এর মধ্যে মাথার জখমটিই মারাত্মক। তদন্ত কর্মকর্তা আরও জানান, হাসপাতালে শরীফুল তার ও হাসিনার নাম ঠিক বললেও কোন ঠিকানাই সঠিক দেয়নি। এ কারণে পুলিশ পাঁচদিন ধরে কোন সূত্র খুঁজে পায়নি। আর এই সুযোগে অভিযুক্তরা পালিয়ে যায়। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রবীর চন্দ্র জানান, হাসপাতালে হাসিনাকে ভর্তি করেন শরীফুল। কিন্তু ভর্তির পর শরীফুল মোবাইল ফোন রেখেই পালিয়ে যায়। পরে ওই মোবাইল ফোনটি জব্দ করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান জানান, গত বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে শরীফুল নামে এক ব্যক্তি সেই শিশুটিকে ঢামেকে ভর্তি করেন। ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে শিশুটি ভর্তি করেন। হাসপাতালের খাতায় শিশু হাসিনার বাবার নাম দেয়া হয় মৃত আবদুল রাজ্জাক। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার পূর্ব শাহাপুর, ফরিদগঞ্জ উল্লেখ করা হয়। তখন শরীফুল জানিয়েছেন, শিশুটিকে তিনি মোহাম্মদপুর এলাকার সুনিবিড় হাউজিং সোসাইটি ভবন থেকে এনেছেন। তিনি নিজে গাজীপুর শ্রীপুরে মুরগির ব্যবসা করেন। পরে জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের টাউন হলের মুরগি ব্যবসায়ী তিনি। পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, শরিফুল নামে ওই ব্যক্তি শিশুটির শরীরে জ্বর বলে কর্তব্যরত চিকিৎসককে জানান। ডাক্তার তার শরীরে বিভিন্ন আঘাতের চিহ্ন দেখে বলেন, তার তো শুধু জ্বরই নয়। তার শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এগুলো ডাক্তার দেখার পর শরিফুল হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। পরিদর্শক সিদ্দিকুর জানান, শরীফুল সেই সময় শিশুটিকে ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় তার মোবাইল ফোনটি রাখা হয়। কিন্তু ভর্তির পর শরীফুল ফোন রেখেই পালিয়ে যান। শরীফুলের উল্লিখিত বাসাটি আদাবর থানা এলাকায় হওয়ায় বিষয়টি আদাবর থানা পুলিশকে জানানো হয়। এরপর ডাক্তাররা তাদের নিজ দায়িত্বে শিশুটিকে ভর্তি করান। ভর্তির পর থেকে হাসিনা নামে ওই শিশুটি অচেতন অবস্থায় ছিল। দু’দিন শিশুটি নাম পরিচয়হীনভাবে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এরপর বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়ে মঙ্গলবার মেয়েকে খুঁজতে ঢামেকে আসেন সালমা বেগম ও আব্দুস সোবহান।
×