ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জনপ্রিয় হয়েও কবি বিজয়ী হতে পারেননি

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ২৮ মে ২০১৬

জনপ্রিয় হয়েও কবি বিজয়ী হতে পারেননি

কবি নজরুল ফরিদপুরে কয়েকবার এসেছেন এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও কমপক্ষে আটবার যে তিনি এখানে এসেছেন এমন তথ্য বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাঁর ফরিদপুর আসার সঙ্গে প্রতিবারই ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতির যোগসূত্র ছিল। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পর ১৯২৫ সালের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ১৯৪১ এর আগস্ট নজরুল নির্বাক হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৬ বছরে আটবার তিনি ফরিদপুরে এসেছেন। এরমধ্যে দুইবার কবি জসীম উদ্দীনের বাড়িতে উঠেছেন। একবার হুমায়ুন কবিরের বাড়িতে এবং ময়েজ মঞ্জিলে উঠেছেন একবার । নজরুলের ফরিদপুর ভ্রমণের একাধিকবারের প্রত্যক্ষ সঙ্গী কবি জসীম উদ্দীনের ফরিদপুর প্রসঙ্গ বিবৃত হয়েছে। আরেক প্রত্যক্ষ সফরসঙ্গী ফরিদপুরের ‘মোয়াজ্জিন’ পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ আব্দুর রব। তার লিখিত ‘নজরুল নামায়’ উল্লেখ রয়েছে ১৯২৮ সালে নজরুল ফরিদপুরে এসেছিলেন। ১৯২৫ সালে অল বেঙ্গল কংগ্রেস কনফারেন্স, অল বেঙ্গল স্টুডেন্ট কংগ্রেস কনফারেন্স এবং অল বেঙ্গল মুসলিম কংগ্রেস কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় ফরিদপুরের টেপাখোলা মাঠে। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য কবি নজরুল ইসলাম চারজনের দল নিয়ে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বাড়িতে ওঠেন। ফরিদপুর শহরের সঙ্গে তখনও সরাসরি রেল লাইন স্থাপিত হয়নি। পল্লীকবির বাড়ির কাছে অম্বিকাপুর রেলস্টেশনেই ট্রেন থেকে নামতে হতো। এখানেই তাঁদের পরস্পরের দেখা হয়। এটাই সম্ভবত কবি নজরুলের প্রথম ফরিদপুরে সফর। কবির সেবারের ফরিদপুর ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করে পরবর্তীতে পল্লীকবি জসীম উদ্দীন লিখেছেন, ‘একদিন আশ্চর্য হইয়া দেখিলাম, কবি নজরুল কয়েকজন শিষ্যসহ আমাদের বাড়িতে উঠিবার ইচ্ছা করিলেন। কবির সঙ্গে কমিউনিস্ট কর্মী আব্দুল হালিম, গায়ক মণীন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও আরও এক যুবক ছিলেন। আমি কবিকে আনন্দে আমাদের বাড়ি লইয়া আসিলাম। রান্নার দেরি ছিল। কবিকে আমাদের নদী তীরে বাঁশবনের ছায়াতলে মাদুর পাতিয়া বসিতে দিলাম।’ কবি নজরুল সঙ্গে আনা ‘বিষের বাঁশী’ আর ‘ভাঙার গান’ জসীম উদ্দীনের বাড়িতে রেখে কনফারেন্স ময়দানে অংশ নেন পল্লীকবি এখানে তাঁর ‘খাস ভলান্টিয়ারে’র দায়িত্ব পালন করেন। কবি জসীমউদ্দীন লিখেছেন- ‘কবি যখন গান ধরিলেন, সেই গানের কথায় সমস্ত সভা উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। কবি গান ছাড়িলে শ্রোতারা আরও গান শুনিবার জন্য চিৎকার করিয়া উঠিতেছিল। কবির কণ্ঠস্বর যে খুব সুন্দর ছিল তাহা নয়, কিন্তু গান গাহিবার সময় কথা বস্তুকে তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়া জীবন্ত করিয়া তুলিতেছিলেন। কবি যখন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাল-জালিয়াত খেলছে জুয়া’ অথবা ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ প্রভৃতি গান গাইতেছিলেন, তখন সভায় যে অপূর্ব ভাবরসের উদয় হইতেছিল, তাহা ভাষায় বলিবার নয়। সম্মেলন শেষে নজরুল ফরিদপুরে দু’দিন থেকে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই প্রস্তাব শুনে জসীম উদ্দীন অত্যন্ত খুশি হন। কবি জসীম উদ্দীন তার বাড়িতে নজরুলকে নিয়ে যান। এই দু‘দিন জসীম উদ্দীনের বাড়িতে বসে গানের আসর। গানের জলসায় অনেকের মধ্যে স্থানীয় পল্লীগায়ক আজগর ফকির ও মথুর ফকির গান পরিবেশন করেন। কবি আবার ফরিদপুরে আসেন পরের বছর ১৯২৬ সালে ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইনসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে। মুসলমানদের জন্য তখন কেন্দ্রীয় আইন সভায় দু’টি আসন ছিল। কবি নজরুল ইসলাম ঢাকা (ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল-ময়মনসিংহ) আসনে স্বরাজ পার্টির প্রার্থী হন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলিম লীগের ইসমাইল চৌধুরী। এই নির্বাচনের কয়েকদিন আগে কবি আবারও ফরিদপুরে আসেন এবং জসীম উদ্দীনের বাড়িতে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে পল্লীকবি জসীম উদ্দীন লিখেছেন- একদিন গ্রীষ্মকালে হঠাৎ কবি আমার পদ্মাতীরে আসিয়া উপস্থিত। তিনি কেন্দ্রীয় আইন সভার সভ্য হইবার জন্য দাঁড়াইয়াছেন। কবি তখন তাঁর স্যুটকেস হইতে এক বান্ডিল কাগজ বাহির করিয়া আমার হাতে দিয়া বলিলেন, ‘এই দেখ, পীর বাদশা মিয়া আমাকে সমর্থন দিয়া ফতোয়া দিয়েছেন। ঢাকায় আমি শতকরা নিরানব্বইটি ভোট পাব। তোমাদের ফরিদপুরের ভোট যদি আমি পাই তা হলেই কেল্লা ফতে... তবে নির্বাচনে কবি বিজয়ী হতে পারেননি। কবির জামানত জব্দ হয়। নির্বাচনে পরাজয়ের পর কবি নজরুল আবার ফরিদপুরে এসেছিলেন সম্ভবত ১৯২৯ সালে। -অভিজিৎ রায়, ফরিদপুর থেকে
×