ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাসরীন জেবিনের তিনটি বই

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৭ মে ২০১৬

নাসরীন জেবিনের তিনটি বই

নদী শীতলক্ষ্যার তীরবর্তী বন্দরনগর নারায়ণগঞ্জে জন্ম ও বেড়ে উঠেছেন ড. নাসরীন জেবিন। স্কুল ও কলেজ শেষ করেছেন, নারায়ণগঞ্জেই। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক সম্মান এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। পিএইচডি. ডিগ্রী অর্জন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনা শেষ করে অধ্যাপনা পেশায় যোগ দেন। বর্তমানে ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। তাঁর পেশা শিক্ষকতা হলেও নেশা লেখালেখি। লিখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। তাঁর পিএইচডির অভিসন্দর্ভটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে- নাম ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে নিম্নবর্গ’। অন্য একটি প্রবন্ধের বই ‘বাংলা ছোটগল্প’। আর এ বছর প্রকাশিত হলো তাঁর তিনটি বই- ১. ‘ফিরে এসো সুতপা’ ২. ‘নারীর পৃথিবী নারীর স্বপ্ন’ এবং ৩. ‘দিঘিজল ছুঁয়ে যায় সর্বনাশা চিল’। বই তিনটিই গত ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ করেছে ‘অনন্যা’ প্রকাশনী। ‘ফিরে এসো সুতপা’: এটি নাসরীন জেবিনের উপন্যাস। গ্রন্থের শিরোনামই বলে দেয় এটি একটি অন্য রকম প্রেমের উপন্যাস। সুতপা নামক একটি মেয়ে বা নারীর অন্য রকম জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস। এ সম্পর্কে গ্রন্থের প্রথমেই বলা হয়েছে : ‘বাস্তবতাই জীবনের সত্যনিষ্ঠ শেকড়। যে শেকড়কে ধরে সুতপা আত্মমুক্তির সন্ধানে ছুটেছে। ভদ্র জীবনের সুন্দর-মহৎ সমাজ-মানসকে সে অনুধাবনের চেষ্টা করেছে। ভালবাসার প্রথম আশ্রয় ছিল বাবা- যে তার মানসিক প্রাগসর চেতনাস্তরকে স্পর্শ করেছিল। পরবর্তী ভালবাসা সুতপার জীবনসত্যকে স্পর্শ করেছে। তাই সে বলতে পেরেছিল- ভালবাসি, তোমাকেই আমি ভালবাসি। এরপর দীর্ঘ যন্ত্রণা, খসে পড়া স্বপ্ন নিয়ে এগিয়েছে সে। জীবনে চাওয়া-পাওয়ার মৃত্যু ঘটলেও জয়ী হয়েছিল সে জীবন-যুদ্ধে, যে যুদ্ধ অমিত সম্ভাবনার মুক্ত আকাশ, জীবন মুক্তির স্বাদ এনে দিতে পারে’। খুবই স্পর্শকাতর জীবন সুতপার। এক আদর্শ শিক্ষক পিতার কন্যা সে, যে দেখতে অত্যন্ত সুন্দর, পড়াশোনায় মেধাবী কিন্তু চাওয়ার চেয়ে পাওয়ার দ্বন্দ্বে সে ছিটকে পড়ে জীবন থেকে। গোবরে পদ্মফুল এক যুবককে সে ভালবাসে, কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা সুতপা তার বাবার আদর্শ ও ভালবাসাকে লালন করতে গিয়ে যুবক শুভ্রর সঙ্গে ওর আর সম্পর্ক না। বাবা তাকে বিয়ে দেয় এক ধনাঢ্য ও অসংস্কৃতিবান অন্য যুবকের সঙ্গে, যেখানে সুতপা তার লালিত স্বপ্ন ও আদর্শ নিয়ে একদমই বেমানান, তথাকথিত হাই সোসাইটির গণ্ডিতে সে দিন দিন অস্থির ও যন্ত্রণার বেড়াজালে আটকে যায়। কিন্তু বাবার আলো তাকে পরাজিত হতে দেয় না। কারণ সে একজন শিক্ষিত নারী, সে একজন সঙ্গীত শিল্পী, সে পরাজিত হবার মানুষ নয়। সে বেছে নেয় শিক্ষকতা, সঙ্গীত আর মনে মনে বাবার প্রতি হয় প্রবল অভিমান। এদিকে বাবাও মেয়ের কষ্টে ধুকে ধুকে নিঃশেষিত হন। লিখে যান একটি স্মরণীয় চিঠি, যে চিঠি সুতপা উদ্ধার করে তার বাবার মৃত্যুর পর। যে বাবা তাকে প্রাণের চেয়েও ভালবাসত, সেই বাবার চিঠি হাতে নিয়ে নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। বলতে পারি, সাদা-মাটা, সস্তা কাহিনী ছাপিয়ে নাসরীন জেবিনের এই উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে জীবনঘনিষ্ঠ ও ভিন্নমাত্রার। পাঠককে নতুন চিন্তার খোরাক দিবে এই গ্রন্থটি, এই বিশ্বাস আমার। ‘দিঘিজল ছুঁয়ে যায় সর্বনাশা চিল’ : এটি নাসরীর জেবিনের কাব্যগ্রন্থ। কবিতা সম্পর্কে কবির বক্তব্য ‘কবিতা আমাদের বেঁচে থাকার বিশ্বজাগতিক সুর। যা আমাদের চেতনাস্তরের আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও সঙ্কটকে অন্তর্জালায় বিপন্ন করতে শেখায়নি। আমাদের আস্থার সুস্থির উঠোনে দাঁড় করিয়ে দেয় কবিতা- যাকে ধরে আমরা হয়ে উঠি স্বপ্নচারী, ডিঙিয়ে যাই নিজেই নিজেকে। মনোজগতের প্রত্যাশাকে নতুন প্রাণের চেতনায় বলিষ্ঠ করতে পারে কবিতা, যাকে আশ্রয় করে মানব চৈতন্যের মুক্তি ঘটতে পারে’। এই চৈতন্য ও চেতনা এবং স্বপ্নের আকাক্সক্ষায় নির্মাণ করেছেন কবি নাসরীন জেবিন তাঁর ‘দিঘিজল ছুঁয়ে যায় সর্বনাশা চিল’। গ্রন্থে তাঁর ৯০টি কবিতা স্থান পেয়েছে। প্রেম-প্রকৃতি-সমাজ আর মানুষের ভালবাসার, দ্বন্দ্বের আর স্বপ্নের কাঠামো তৈরি করেছেন কবি তাঁর এই কবিতাগুলোতে। উদ্ধৃতি দেয়া যাক : ক. ‘বিকেলটা পাঠাবো তোমার কাছে/ একটু রং দিবে তাতে-/ কেমন হয়ে গেছে জীবন আমার/ নেই কোনো সবুজ তাতে/ জীবন শুরু হতেই নেমেছে সন্ধ্যা/ রেখেছি তাকে ড্রাই আইসের মতো/ কাটাকুটি করো না তাতে/ কবিতা নিয়ে যাবো টুকরো হাতে/ হৃদয় ভিজবে তাতে/ তোমার নতুন হাটে’। [ড্রাই আইস; পৃষ্ঠা-৭৪]। খ. ‘রুপোলি নদীর জলে নারী তুমি অবিনাসী তাবিজ/ নীরবে দিয়ে যাও ফসলের বীজ/ ভেজা চুলে নারী তুমি অধরা হবে/ কপোলে কপোল ঘষে জ্যোৎস্না নেবে/ সভ্যতা এনে দিলে নারী তুমি লাজে/ পৃথিবী নেবে তা পরম সাজে’। [রুপোলি নদীর জলে; পৃষ্ঠা-২৪]। মোট কথা সবগুলো কবিতাতেই আছে জীবনবোধ। সহজ-সরল ভাষায় কবি নাসরীন জেবিন পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছেন মূর্তমান। নিবিড় চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি কাব্যক্ষেত্রে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবেন বলে মনে করি। ‘নারীর পৃথিবী নারীর স্বপ্ন’ : এটি নাসরীন জেবিনের প্রবন্ধগ্রন্থ। লেখক যেহেতু একজন শিক্ষিত নারী; সেকারণে গ্রন্থের শিরোনামের প্রতি তাঁর দুর্বলতা থাকবেই। এই দুর্বলতা আসলে একটি শক্তি, যে শক্তির প্রথম স্ফূরণ দেখিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি অবরোধবাসিনীদেরকে আলোর মুখ দেখানোর যে প্রবল প্রচেষ্টা দেখিয়েছিলেন, সেই নারীদের পর্যায়ক্রমিক উন্নতি ও আধুনিক হওয়ার কথাই নাসরীন জেবিন তাঁর এই গ্রন্থে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। শুরুতেই বলেছেন, ‘নারী যে ছিল অসন্তোষ আর আক্রোশের পদদলিত স্মৃতিচিহ্ন। সমাজ যাকে করেছিল অবরোধবাসিনী। চিতায় জ্বলে গেছে যে নারীর দেহ-প্রাণ, শতাব্দীর প্রাচীর দিয়ে ঘিরেছে তার মুক্তির স্বাদ। কালের প্রবহমানতায় সে আজ অন্ধ হয়েছে; হয়েছে শিক্ষিত, পরিমার্জিত, আধুনিক। অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে নারী আজ ব্যস্ত। একবিংশ শতাব্দীতে এসে তার মনোশুদ্ধির জয় হয়েছে- বিম্ভায়নের দরোজায় সে জয় আজ ছড়িয়ে গেছে। মানবাত্মাকে জাগিয়ে দিয়েছে যে প্রাণ, সে আর কেউ নয় নারী।’ লেখক তার গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, ‘বাংলার নারীর মুক্তি, স্বাধীনতা, অধিকার পুরোটাই সর্বজনীন প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশায় নারীর ভিতর-বাইরের শক্তিকে আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ নারীর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সমতার ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলার নারী আজ মাটিকে আলিঙ্গন করে কৃষিকাজ থেকে এভারেস্টের চূড়া পর্যন্ত স্পর্শ করে তার স্বপ্নকে দিগন্তপ্রসারী করেছে। পারিবারিক সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে সার্থক নারী আজ যুদ্ধবিমান চালাচ্ছে, প্যারাট্রুপারও হচ্ছে। নারীর এরূপ জয় অন্য নারীর মধ্যে জয়ের নেশাকে আরও স্বপ্ন রঙিন করে তুলেছে।’ আজকের নারীদের জয়যাত্রার শিল্পগাঁথাই হলো নাসরিন জেবিনের এই প্রবন্ধ গ্রন্থটি। একইসঙ্গে গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের বই প্রকাশের মাধ্যমে নাসরীন জেবিন পাঠককে জানান দিচ্ছেন যে তিনি নেশার ভিন্নমাত্রিক অভিযাত্রায় আছেন। যে যাত্রায় নিজের পথ তিনি নিজেই করছেন। এই নিজস্বতায় আছে পরিশ্রম, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা। তাঁর এই মুখরতাকে অভিনন্দন জানাই। নদী শীতলক্ষ্যার তীরবর্তী বন্দরনগর নারায়ণগঞ্জে জন্ম ও বেড়ে উঠেছেন ড. নাসরীন জেবিন। স্কুল ও কলেজ শেষ করেছেন, নারায়ণগঞ্জেই। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক সম্মান এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। পিএইচডি. ডিগ্রী অর্জন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনা শেষ করে অধ্যাপনা পেশায় যোগ দেন। বর্তমানে ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। তাঁর পেশা শিক্ষকতা হলেও নেশা লেখালেখি। লিখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। তাঁর পিএইচডির অভিসন্দর্ভটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে- নাম ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে নিম্নবর্গ’। অন্য একটি প্রবন্ধের বই ‘বাংলা ছোটগল্প’। আর এ বছর প্রকাশিত হলো তাঁর তিনটি বই- ১. ‘ফিরে এসো সুতপা’ ২. ‘নারীর পৃথিবী নারীর স্বপ্ন’ এবং ৩. ‘দিঘিজল ছুঁয়ে যায় সর্বনাশা চিল’। বই তিনটিই গত ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ করেছে ‘অনন্যা’ প্রকাশনী। ‘ফিরে এসো সুতপা’: এটি নাসরীন জেবিনের উপন্যাস। গ্রন্থের শিরোনামই বলে দেয় এটি একটি অন্য রকম প্রেমের উপন্যাস। সুতপা নামক একটি মেয়ে বা নারীর অন্য রকম জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস। এ সম্পর্কে গ্রন্থের প্রথমেই বলা হয়েছে : ‘বাস্তবতাই জীবনের সত্যনিষ্ঠ শেকড়। যে শেকড়কে ধরে সুতপা আত্মমুক্তির সন্ধানে ছুটেছে। ভদ্র জীবনের সুন্দর-মহৎ সমাজ-মানসকে সে অনুধাবনের চেষ্টা করেছে। ভালবাসার প্রথম আশ্রয় ছিল বাবা- যে তার মানসিক প্রাগসর চেতনাস্তরকে স্পর্শ করেছিল। পরবর্তী ভালবাসা সুতপার জীবনসত্যকে স্পর্শ করেছে। তাই সে বলতে পেরেছিল- ভালবাসি, তোমাকেই আমি ভালবাসি। এরপর দীর্ঘ যন্ত্রণা, খসে পড়া স্বপ্ন নিয়ে এগিয়েছে সে। জীবনে চাওয়া-পাওয়ার মৃত্যু ঘটলেও জয়ী হয়েছিল সে জীবন-যুদ্ধে, যে যুদ্ধ অমিত সম্ভাবনার মুক্ত আকাশ, জীবন মুক্তির স্বাদ এনে দিতে পারে’। খুবই স্পর্শকাতর জীবন সুতপার। এক আদর্শ শিক্ষক পিতার কন্যা সে, যে দেখতে অত্যন্ত সুন্দর, পড়াশোনায় মেধাবী কিন্তু চাওয়ার চেয়ে পাওয়ার দ্বন্দ্বে সে ছিটকে পড়ে জীবন থেকে। গোবরে পদ্মফুল এক যুবককে সে ভালবাসে, কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা সুতপা তার বাবার আদর্শ ও ভালবাসাকে লালন করতে গিয়ে যুবক শুভ্রর সঙ্গে ওর আর সম্পর্ক না। বাবা তাকে বিয়ে দেয় এক ধনাঢ্য ও অসংস্কৃতিবান অন্য যুবকের সঙ্গে, যেখানে সুতপা তার লালিত স্বপ্ন ও আদর্শ নিয়ে একদমই বেমানান, তথাকথিত হাই সোসাইটির গণ্ডিতে সে দিন দিন অস্থির ও যন্ত্রণার বেড়াজালে আটকে যায়। কিন্তু বাবার আলো তাকে পরাজিত হতে দেয় না। কারণ সে একজন শিক্ষিত নারী, সে একজন সঙ্গীত শিল্পী, সে পরাজিত হবার মানুষ নয়। সে বেছে নেয় শিক্ষকতা, সঙ্গীত আর মনে মনে বাবার প্রতি হয় প্রবল অভিমান। এদিকে বাবাও মেয়ের কষ্টে ধুকে ধুকে নিঃশেষিত হন। লিখে যান একটি স্মরণীয় চিঠি, যে চিঠি সুতপা উদ্ধার করে তার বাবার মৃত্যুর পর। যে বাবা তাকে প্রাণের চেয়েও ভালবাসত, সেই বাবার চিঠি হাতে নিয়ে নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। বলতে পারি, সাদা-মাটা, সস্তা কাহিনী ছাপিয়ে নাসরীন জেবিনের এই উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে জীবনঘনিষ্ঠ ও ভিন্নমাত্রার। পাঠককে নতুন চিন্তার খোরাক দিবে এই গ্রন্থটি, এই বিশ্বাস আমার। ‘দিঘিজল ছুঁয়ে যায় সর্বনাশা চিল’ : এটি নাসরীর জেবিনের কাব্যগ্রন্থ। কবিতা সম্পর্কে কবির বক্তব্য ‘কবিতা আমাদের বেঁচে থাকার বিশ্বজাগতিক সুর। যা আমাদের চেতনাস্তরের আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও সঙ্কটকে অন্তর্জালায় বিপন্ন করতে শেখায়নি। আমাদের আস্থার সুস্থির উঠোনে দাঁড় করিয়ে দেয় কবিতা- যাকে ধরে আমরা হয়ে উঠি স্বপ্নচারী, ডিঙিয়ে যাই নিজেই নিজেকে। মনোজগতের প্রত্যাশাকে নতুন প্রাণের চেতনায় বলিষ্ঠ করতে পারে কবিতা, যাকে আশ্রয় করে মানব চৈতন্যের মুক্তি ঘটতে পারে’। এই চৈতন্য ও চেতনা এবং স্বপ্নের আকাক্সক্ষায় নির্মাণ করেছেন কবি নাসরীন জেবিন তাঁর ‘দিঘিজল ছুঁয়ে যায় সর্বনাশা চিল’। গ্রন্থে তাঁর ৯০টি কবিতা স্থান পেয়েছে। প্রেম-প্রকৃতি-সমাজ আর মানুষের ভালবাসার, দ্বন্দ্বের আর স্বপ্নের কাঠামো তৈরি করেছেন কবি তাঁর এই কবিতাগুলোতে। উদ্ধৃতি দেয়া যাক : ক. ‘বিকেলটা পাঠাবো তোমার কাছে/ একটু রং দিবে তাতে-/ কেমন হয়ে গেছে জীবন আমার/ নেই কোনো সবুজ তাতে/ জীবন শুরু হতেই নেমেছে সন্ধ্যা/ রেখেছি তাকে ড্রাই আইসের মতো/ কাটাকুটি করো না তাতে/ কবিতা নিয়ে যাবো টুকরো হাতে/ হৃদয় ভিজবে তাতে/ তোমার নতুন হাটে’। [ড্রাই আইস; পৃষ্ঠা-৭৪]। খ. ‘রুপোলি নদীর জলে নারী তুমি অবিনাসী তাবিজ/ নীরবে দিয়ে যাও ফসলের বীজ/ ভেজা চুলে নারী তুমি অধরা হবে/ কপোলে কপোল ঘষে জ্যোৎস্না নেবে/ সভ্যতা এনে দিলে নারী তুমি লাজে/ পৃথিবী নেবে তা পরম সাজে’। [রুপোলি নদীর জলে; পৃষ্ঠা-২৪]। মোট কথা সবগুলো কবিতাতেই আছে জীবনবোধ। সহজ-সরল ভাষায় কবি নাসরীন জেবিন পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছেন মূর্তমান। নিবিড় চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি কাব্যক্ষেত্রে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবেন বলে মনে করি। ‘নারীর পৃথিবী নারীর স্বপ্ন’ : এটি নাসরীন জেবিনের প্রবন্ধগ্রন্থ। লেখক যেহেতু একজন শিক্ষিত নারী; সেকারণে গ্রন্থের শিরোনামের প্রতি তাঁর দুর্বলতা থাকবেই। এই দুর্বলতা আসলে একটি শক্তি, যে শক্তির প্রথম স্ফূরণ দেখিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি অবরোধবাসিনীদেরকে আলোর মুখ দেখানোর যে প্রবল প্রচেষ্টা দেখিয়েছিলেন, সেই নারীদের পর্যায়ক্রমিক উন্নতি ও আধুনিক হওয়ার কথাই নাসরীন জেবিন তাঁর এই গ্রন্থে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। শুরুতেই বলেছেন, ‘নারী যে ছিল অসন্তোষ আর আক্রোশের পদদলিত স্মৃতিচিহ্ন। সমাজ যাকে করেছিল অবরোধবাসিনী। চিতায় জ্বলে গেছে যে নারীর দেহ-প্রাণ, শতাব্দীর প্রাচীর দিয়ে ঘিরেছে তার মুক্তির স্বাদ। কালের প্রবহমানতায় সে আজ অন্ধ হয়েছে; হয়েছে শিক্ষিত, পরিমার্জিত, আধুনিক। অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে নারী আজ ব্যস্ত। একবিংশ শতাব্দীতে এসে তার মনোশুদ্ধির জয় হয়েছে- বিম্ভায়নের দরোজায় সে জয় আজ ছড়িয়ে গেছে। মানবাত্মাকে জাগিয়ে দিয়েছে যে প্রাণ, সে আর কেউ নয় নারী।’ লেখক তার গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, ‘বাংলার নারীর মুক্তি, স্বাধীনতা, অধিকার পুরোটাই সর্বজনীন প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশায় নারীর ভিতর-বাইরের শক্তিকে আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ নারীর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সমতার ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলার নারী আজ মাটিকে আলিঙ্গন করে কৃষিকাজ থেকে এভারেস্টের চূড়া পর্যন্ত স্পর্শ করে তার স্বপ্নকে দিগন্তপ্রসারী করেছে। পারিবারিক সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে সার্থক নারী আজ যুদ্ধবিমান চালাচ্ছে, প্যারাট্রুপারও হচ্ছে। নারীর এরূপ জয় অন্য নারীর মধ্যে জয়ের নেশাকে আরও স্বপ্ন রঙিন করে তুলেছে।’ আজকের নারীদের জয়যাত্রার শিল্পগাঁথাই হলো নাসরিন জেবিনের এই প্রবন্ধ গ্রন্থটি। একইসঙ্গে গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের বই প্রকাশের মাধ্যমে নাসরীন জেবিন পাঠককে জানান দিচ্ছেন যে তিনি নেশার ভিন্নমাত্রিক অভিযাত্রায় আছেন। যে যাত্রায় নিজের পথ তিনি নিজেই করছেন। এই নিজস্বতায় আছে পরিশ্রম, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা। তাঁর এই মুখরতাকে অভিনন্দন জানাই।
×