ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মধ্যবিত্তের আয় কমছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে ॥ বাজেট কী বলবে?

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২৭ মে ২০১৬

মধ্যবিত্তের আয় কমছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে ॥ বাজেট কী বলবে?

আর মাত্র এক সপ্তাহ আছে, জুনের দুই তারিখেই উন্মোচিত হবে নতুন অর্থবছরের (২০১৬-১৭) বাজেট। এর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হবে সব ‘স্পেকুলেশন’। অবশ্য ইতোমধ্যেই ব্যবসায়ীদের বড় একটা অংশ তাদের ‘দায়িত্বটি’ পালন করে ফেলেছেন। বিনা অজুহাতে, পণ্যের ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও তারা সমস্ত ভোগ্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারের নতুন ভ্যাট আইনে ভ্যাটের হার সকল ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হলে কার্যত সকল পণ্যের দামই বাড়বে বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছিল, ব্যবসায়ীরা তা বাস্তবে কার্যকর করে দিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ পারলেন না তার ‘কনস্টিটিউয়েন্সি’ সামলাতে। তিনি ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়েছেন, ভোক্তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাজার সামলাতে পারেননি। জানি না কপালে কী আছে, বাজেট ঘোষণার পর কী আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আরেক দফা পণ্যের মূল্য বাড়াবেন? ইতোমধ্যেই খবর কিন্তু ভাল নয়। পঁচিশে মে তারিখে প্রকাশিত একটি দৈনিকের খবরে দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্তের আয় হ্রাস পাচ্ছে দ্রুত চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ওয়েজ আর্নার, শ্রমজীবী থেকে শুরু করে বেওয়া-বিধবা, মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত ও বয়স্করা ব্যাংকে টাকা রাখে। কী সঞ্চয়ী আমানত, কী মেয়াদী আমানত- উভয় ক্ষেত্রেই সুদের হার দ্রুত প্রতিদিন হ্রাস পাচ্ছে। খবরটিতে এর বিস্তারিত হিসাব দেয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায় মূল্যস্ফীতির হার ধরে হিসাব করলে ব্যাংক এখন আর কোন সুদ দেয় না। বরং সুদের হার নেতিবাচক। মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশ, আর সুদের হার ৪-৫ শতাংশ- তাহলে প্রকৃত সুদের হার কত হয়? অথচ আজ থেকে ২-৩ বছর আগেও ব্যাংক ৬-৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে ১২-১৩ শতাংশ সুদ দিত। একেই বলে সাধারণ মানুষের কপাল। বর্ণিত অবস্থায় পড়ে মধ্যবিত্ত যে এক লিটার সয়াবিনের স্থলে আধা লিটার সয়াবিন কিনছে তা কী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিব মহোদয়রা জানেন? স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের নিয়ে অভিভাবক আগে রিক্সায় উঠত, এখন প্রখর রোদে তারা হেঁটে স্কুল করে। রিক্সাওয়ালারা দরিদ্র বলেই আমাদের ধারণা, কিন্তু তাদের ‘অত্যাচার’ বলেও একটা কথা আছে। মধ্যবিত্ত বস্তুত সব জিনিসেরই ভোগ কমাচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রী শুনেছি চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট। উনার হিসাবে কী এসব ধরা পড়ছে? না, ভোগ বাড়ছে এটাই তার কথা। কারণ সরকারী কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে। এরা কয়জন, বড় জোর ১০-১৫ লাখ লোক। বাকি লাখো-কোটির হিসাব কোথায়? মুশকিল হচ্ছে ‘সংজ্ঞা’ (ডেফিনেশন)। এখন সংজ্ঞা যদি হয় ব্যাপক, তাহলে তো হিসাব মেলানো দায়। কাগজে দেখলাম সপ্তাহে এক-দুই ঘণ্টা কাজ করলেই তিনি আর বেকার নন। আবার দিনে ১২০ টাকা রোজগার করলেই তিনি আর ‘দরিদ্র’ নন। এখন এসব সংজ্ঞা ব্যবহার করে এবং মনোমত তথ্য যোগাড় করে যদি দৃশ্যমান সত্যকে অস্বীকার করা হয় তাহলে তো কথা নেই। জানি না, বাজেটে কী হবে? কিন্তু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে অগণিত মানুষের আয় (ইনকাম) কমছে, অথচ খরচ ঠিকই বাড়ছে। একটা কাঁচাবাজার তার কী হলো যে, সমস্ত সবজির দাম ত্রিশ টাকা কেজি থেকে লাফ দিয়ে ৪০-৫০ টাকা কেজি হবে। উপলক্ষ কী পবিত্র রোজা, উপলক্ষ কী সরকারী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি? ব্যবসায়ীরা জানে বিশাল বাজেট আসছে। পূর্ণভাবে বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করতে হবে। টাকা দরকার। অতএব ট্যাক্সের বিপুল আয়োজন দেখা যাচ্ছে। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় আশানুরূপ হয়নি, অতএব ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিপুল উদ্যোগে রাজস্ব আদায় করতে হবে। অর্থাৎ করদাতাদের ‘ডিসপোজেল ইনকাম’ কমার সমূহ আশঙ্কা। বিপরীতে মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি। তাহলে দাঁড়াল কী? দেখা যাচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি যাতে না হয় তার জন্য লড়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। অবাক কা- আর কী? ‘ভ্যাট’ কে দেয়? ‘ভ্যাট’ মানে ‘ভ্যালু এ্যাডেড ট্যাক্স’। শাস্ত্র বলে এটা ভোক্তারা দেবে। ব্যবসায়ীরা ‘কালেক্ট’ করবে। ভ্যাট সবক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। ব্যবসায়ীদের ক্ষতি কী? তারা ভোক্তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করবে, সরকারকে দিয়ে দেবে। না, দেখা যাচ্ছে তারাই আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। ১৫ শতাংশ আদায়ের বিধান হলে তারা দোকানপাট বন্ধ করে দেবেন। বড় বড় ব্যবসায়ী নেতারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। বলেছেন ভ্যাট কার্যকর হলে মানুষের কষ্ট হবে, সাধারণ ও ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বলাইবাহুল্য তাদের সংখ্যাই তো লাখ লাখ। দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের অবস্থান মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে, তারা তাদের ব্যবসার স্বার্থেই সমভাবে ভ্যাট প্রযোজ্যের বিরোধিতা করছেন। মূল কথা তাহলে ভোগস্তর, মূলকথা তাহলে আয়স্তর। যে বাজেটই হোক না কেন এ দুটো ঠিক না থাকলে বিপদ। বাজেটের আকার, রাজস্বের পরিমাণ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আকার, সরকারের ঋণ, ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ, ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ, ভর্তুকির পরিমাণ, সামাজিক নিরাপত্তার আকার ইত্যাদি নিয়ে হাজার লেখা হতে পারে। সরকারী ব্যাংকগুলোকে বিক্রি করে দেয়া হবে কী না, বীমা কোম্পানির ‘দুষ্টামি’ বন্ধ করা যাবে কী নাÑ এসব নিয়ে অনেক লেখা যাবে। বাজেট বক্তৃতায় শতকথা তুলে ধরা হতে পারে। কৃষকদের বাজেট ও ভাগ্য নিয়ে রকমারি কথা হতে পারে। কিন্তু সব কথার শেষ কথা ‘বাজার’। বাজারে মাল থাকতে হবে। মাল কেনার লোক থাকতে হবে। চাল, ডাল, নুন, তেল, পিঁয়াজ, রসুন, হাঁস-মুরগি, শাক-সবজি, মাছ-মাংস মানুষকে কিনতে হবে। কেনার সামর্থ্য থাকতে হবে। মানুষকে প্রয়োজনীয় ‘ক্যালরি’ গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য দরকার হবে আয়, দরকার হবে ভোগ। আয়ের ক্ষেত্রে দৃশ্যত দেখা যাচ্ছে কয়েকটি জিনিস। যে এক কোটি লোক বিদেশে থাকে, যাদের প্রেরিত টাকায় গ্রাম থাকে অর্থনৈতিকভাবে উজ্জীবিত, সেই রেমিটেন্সের প্রবাহে টান পড়েছে। গত বছরের তুলনায় রেমিটেন্স কম আসছে। সকল কাগজই এই তথ্য দিনের পর দিন প্রকাশ করছে। এক কোটি লোকের চার কোটির সংসার। তাদেরই নিয়মিত আয় আছে। তাদের আয়স্তরে যদি নিম্নগতি দেখা যায় তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল থাকবে কিভাবে? প্রতিদিন অভিযোগ ছাপা হচ্ছে কাগজে, কৃষকরা ধানের দাম পাচ্ছেন না। তারা ধান চাষ ছেড়ে অন্য ফসলে যাচ্ছেন। বোরোর ফলন কমেছে। কারণ খরচে পোষায় না। গ্রামীণ অবকাঠামোর অবস্থা খারাপ। ঐখানে টাকা গেলে কিছু মানুষ গায়ে গতরে খেটে বাঁচতে পারে। কিন্তু তা নেই। শহরে লোকের চাহিদা নেই। শহরে শ্রমের চাহিদা ছিল গৃহায়ন খাতে। এই খাত মর মর অবস্থায়। সাধারণ শ্রমিকের চাহিদা এখানে নেই। কাঠমিস্ত্রী, রংমিস্ত্রি, লোহার মিস্ত্রি, প্লাম্বার, থাই এলুমিনিয়াম মিস্ত্রি ইত্যাদির কাজ থাকে এবং কাজ বাড়ে আবাসন শিল্প রমরমা থাকলে। স্পষ্টত তা নয় বর্তমান অবস্থা। এই শিল্পের মালিকরা কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ চান। রেজিস্ট্রেশন ফি যাতে হ্রাস হয় তার ব্যবস্থা চান। কোন প্রতিষ্ঠান যাতে ফ্ল্যাট, জায়গা কিনলে ক্রেতাদের হয়রানি না করে তার সুরক্ষা চান। এসব দাবি থেকেই বোঝা যায় শিল্পের অবস্থা কী? ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভাল নয়। অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সরকারের লোক। তিনি বলছেন ঋণের চাহিদা নেই। অতএব ব্যাংকে ব্যাংকে প্রচুর অলস টাকা পড়ে আছে। তাই ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার কমাচ্ছে। এতেই প্রমাণিত হয় বাণিজ্যের অবস্থা কী? বহু শিল্প বসে পড়ছে। তাদের শ্রমিকরা বেকার হচ্ছে। অফিসাররা বেকার হচ্ছে। এসব কে দেখবে? এদের আয় না থাকলে ‘বাজার’ কোত্থেকে হবে। সেল কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা কোম্পানি নিয়মিতভাবে মধ্যবিত্তের চাকরি খাচ্ছে। বেতন-ভাতা একটু বাড়লেই তাকে চাকরিচ্যুত করে খরচ ‘কমানো’ হচ্ছে। অথচ প্রধান নির্বাহীদের বেতন থাকছে আকাশছোঁয়া। আমি যা বলতে চাইছি তা খুবই সাদামাটা কথা। অঙ্কের প্যাঁচ নয়, ভোগ (কনজামশন) ঠিক রাখতে হবে, মানুষের আয় ঠিক রাখতে হবে, মজুরি ঠিক রাখতে হবে, চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী’ হচ্ছে অক্সিজেন। এটা দিয়ে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা প্রকৃতপক্ষে কোন স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমরা অর্থনৈতিকভাবে যে অন্যায়-অবিচার গরিব মানুষের প্রতি করি তার ‘কাফফারা’ হচ্ছে ‘সিএসআর’ বা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী। এর থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত রাখাই হওয়া উচিত আমাদের কর্তব্য। আগামী বাজেটে এ বিষয়গুলোর ওপর কোন পদক্ষেপ দেখতে পাব কী? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×