ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

সেইখানে যোগ তোমার সঙ্গে আমারও

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২৭ মে ২০১৬

সেইখানে যোগ তোমার সঙ্গে আমারও

বিশ্বের নানা দেশের রাজনীতি নিয়ে খুব যে মাথা খামচাই, নিশ্চয় নয়। আমেরিকা সম্পর্কে আদৌ আগ্রহ নেই। যিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন, যে কদু সেই লাউ। রাশিয়াসহ ইউরোপের তিনটি দেশের রাজনীতির হালচাল, গতি কোন দিকে, নজর রাখতে হয়। যেহেতু মধ্য ইউরোপের জল হাওয়ায় দিন গুজরান। ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নিয়ে কৌতূহল অদম্য। কারণও একাধিক। ভারতে যাই, মূল আস্তানা কলকাতায়। বাংলাদেশ থেকে আত্মীয়কুল আসেন, দিন কয়েকের সান্নিধ্যে নির্বাসিত দেশের স্পর্শ, গন্ধ খুঁজি। বিশ্বের সব দেশের ছাড়পত্র পাই, বাংলাদেশের মেলে না। হয়ত মিলবেও না আর। বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নিবিড়তায় চিড় ধরেনি এখনও, যতই কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হোক না কেন। জল, বাতাস আটকানো যায় না। ভারতের রাজনীতি আজ কোন ভাঙ্গনের পথে, কেন ভাঙ্গন, এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই এখানে। ভারত চরম সাম্প্রদায়িকতার দিকে গতিমান। বিজেপি-মোদি সরকারই রথচালক। রথী স্বয়ং মোদি। যেন কৃষ্ণ। মন্ত্রণাদাতা। সেই মন্ত্রেই হিসেব-নিকেশ। পশ্চিমবঙ্গও সঙ্গী। সঙ্গিনী ‘বঙ্গেশ্বরী’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয়টি লক্ষ করুন। ভারতের পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন। পূর্বাঞ্চলের অসমসহ দক্ষিণের তিনটি রাজ্যে একদিনে ভোট। পশ্চিমবঙ্গে এক মাসব্যাপী, সাত পর্বে। তিন/চারদিন পর পর। ঘটনা এখানেই পরিষ্কার। ভোটাররা যাতে ঢালাও ছাপ্পা ভোট দিতে পারে। মোদির সঙ্গে মমতার বন্দোবস্ত একবারে পাকা, তথা সমঝোতা। কিন্তু ‘আই ওয়াশ করতে হবে। কেন্দ্র থেকে নির্বাচন কমিশনের কর্তা নাসিম জাইদি কলকাতায় এসে খুব হম্বিতম্বি করলেন, হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা। লোক দ্যাখানো তোড়জোড়ও করলেন। অনেক বুথে পুলিশ, সেনাও মোতায়েন, কিন্তু ‘ফস্কা গেঁরো। তৃণমূলের গু-াবাজরা বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দিয়ে, বুক চেতিয়ে, হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছে, পাহারাদার পুলিশ-সেনার চোখে ঠুলি, জাবর কেটে বলে, দেখিনি। কলকাতার, ভারতের বহু দৈনিকে এই ছবি প্রকাশিত, টিভিতেও, নির্বাচন কমিশনের কোন হেলদোল নেই, বরং সাফাই, সব বুথে-কেন্দ্রে নজর দেয়া সম্ভব নয়। বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের আঁতাত, আমাদের ক্ষমতাসীন করো, তোমাদের জন্যও ছাড় আছে। পশ্চিমবঙ্গে তিনটি আসন ছেড়েছে তৃণমূল (পাইয়ে দিয়েছে)। তার মানে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এন্ট্রি। কেউ ভাবেনি কখনও। ভোটের অর্ধেক রেজাল্টই বের হয়নি, মোদি অভিনন্দন জানাচ্ছেন মমতাকে। ৫ মে ভোট শেষে মমতা লাপাত্তা, তিন দিন ডিব্রুগড়ে, বাংলোয়। একা। কারোর সঙ্গে দেখা করছেন না, সাংবাদিকরা পাপারাতসি, নাগাল পান না। যেদিন পেলেন, বিমর্ষ। কারোর সঙ্গে কোন কথা নয়। স্কট ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রী এয়ারপোর্টে। আশঙ্কা হারবেন। ফলাফল ঘোষণার দুই দিন আগে থেকে বঙ্গেশ্বরীর ঠোঁটজোড়ায় বিগলিত হাসি। মহাখুশি। ভোট গণনাই হয়নি, তা হলে ঘটনা কী? মমতার পুলক দেখে, পান দোক্তা-খৈনি বিক্রেতাও বুঝে নিয়েছে মোদির সঙ্গে বঙ্গেশ্বরীর পিরীত পাকা, জিগের আঠা। পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রও স্পষ্ট বলেছেন। ভাবা যায় কি, কলকাতায় বামফ্রন্ট একটি আসনও পায়নি? বামফ্রন্টের মহাদুর্যোগের দিনেও (২০১১ সালের নির্বাচনে) এমন বিপর্যয় ঘটেনি। অসমে ১৫ বছর কংগ্রেসের রাজত্ব, তরুণ গগৈ সাচ্চা মানুষ, খাঁটি সেক্যুলার হিসেবে সম্মানিত, তাঁকে কোতল (ভোটে) করার জন্য বিজেপি মহারণে অবতীর্ণ। সঙ্গে হনুমান, সুগ্রীব। নানা রকম প্রতিশ্রুতি। মোদি, অমিত শাহ (বিজেপির কর্তা), হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন, বক্তৃতার পর বক্তৃতা, সারা অসম চষে খেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে মাত্র দুই বেলা। তাও নামকা ওয়াস্তে মিটিং। বঙ্গেশ্বরীর সঙ্গে তো সমঝোতাই হয়েছে গোপনে, সেইখানে যোগ তোমার সঙ্গে আমারও। অসমে, পশ্চিমবঙ্গে ঘোর অন্ধকার আসন্ন। বিজেপির প্রবেশ, সগর্বে। অহমিয়ার (অসম) সুগ্রীব, হনুমানরা (দুটি মুসলিম দল), জেনে, না কি না-জেনে বিজেপি জোটে যোগ দিয়ে, বিজেপিকে ক্ষমতাসীন করেছে। কিছুদিন যাক, ঠেলা বুঝবে, বিপদ কাকে বলে, বিজেপির আসল চেহারা কি! কে ঘরের শত্রু বিভীষণ? শিখুক, মার খেয়ে শিখুক, আক্কেল হবে। যদি হয়। বঙ্গেশ্বরী মমতা ভাবছেন, বিজেপিকে ঘরে ডেকে নিয়ে, মাদুরে বসিয়ে, সেইখানে যোগ তোমার সঙ্গে আমারও, কিন্তু ভবিষ্যতের চিত্রমালা আলাদা। ঘরে এনে দুধকলা দিয়ে কেউটে পুষলে ছোবল মারবেই একদিন। মমতা ও তৃণমূলকে ঘায়েল করে মাদুর ছেড়ে, চেয়ারে-সোফায় বসবেই। লক্ষণ পরিষ্কার, দেখতেই পাচ্ছি। যে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে মানুষের আশা-ভরসা ছিল, বঙ্গেশ্বরী মরা-গঙ্গায় ডুবিয়ে দিচ্ছেন। নিজে ডুববেন, পশ্চিমবঙ্গকেও ডোবাবেন। ডোবানোর তোড়জোড কতটা, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার এক ঘণ্টাও পার হয়নি, মমতা গলা চড়িয়ে বলেছেন, বিজেপিকে ইস্যুভিত্তিক সমর্থন করব। এই আশ্বাসই মোদি চেয়েছেন। বঙ্গেশ্বরী দিয়েছেন। সামনে ঘোরতর দুর্দিন, পশ্চিমবঙ্গে। ঠ্যাঙানি না খেলে, ঠেকে না শিখলে বাঙালির আক্কেল হয় না। যৌবনের শহর, প্রাণের শহর কলকাতায় যাব, আত্মীয়রা আসবেন, দেখা হবে, সুখ-দুঃখের হাসিকান্না, কিন্তু আগের কলকাতার মেজাজ, অসাম্প্রদায়িক মুগ্ধতা ফিরে পাব না। কেউই পাবে না। গরল আর বিষে বাতাস ভারি, দূষিত। নিশ্বাসে টান পড়বেই। বার্লিন, জার্মানি [email protected]
×