ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলজয়ন্তী

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশ এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৬ মে ২০১৬

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশ এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংখ্যাগরিষ্ঠ্যের ধর্ম রক্ষার নামে মানুষ খুন, পুরনো ফতোয়া, পুরনো সংঘাত যখন নতুন চেহারায় সামনে আসার পাঁয়তারা করছে, বাঙালী তখন বিনা দ্বিধায় নজরুলকেই আশ্রয় করল। জাতীয় কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করল আবারও। সমাজের যেখানে অন্যায় অসাম্য, মুখ বুজে সহ্য না করে নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা নিয়ে রুখে দাঁড়াবার শপথ নিল। জয় গান হলো প্রেমের। কথা কবিতা গানে বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো হলো কাজী নজরুল ইসলামকে। ১১৭তম নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে দেশব্যাপী ছিল বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান আয়োজন। প্রতিবারের মতোই সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কবির সমাধিস্থলে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং ছাত্রী-ছাত্রীরা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান কবি পরিবারের সদস্যরা। জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি, নজরুল একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয় কবিকে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতা-কর্র্মীরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান কবিকে। গোলাম কুদ্দুছের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। সমাধি প্রাঙ্গণে আয়োজিত স্মরণ সভায় আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নজরুলের সাহিত্যকর্ম সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সমাজের সব সাম্প্রায়িক অপশক্তিকে মোকাবিলা করা যাবে। সকলকে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এটা ছিল জাতীয় কবির স্বপ্ন। কবির নাতনি মিষ্টি কাজী বলেন, শুধু একদিন দাদুকে স্মরণ করলে হবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই সারা বছর তাঁকে স্মরণ করতে হবে। এ বছর জাতীয় পর্যায়ে নজরুলজয়ন্তীর মূল অনুষ্ঠান ছিল চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়াম মাঠে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের। জনকণ্ঠ চট্টগ্রাম অফিস জানায়, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে তিনি যেতে পারেননি। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ও কবির নাতনি খিলখিল কাজী। স্মারক বক্তৃতা করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবুল মোমেন। সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। সারা জীবন মানবতার জয়গান গেয়েছেন। অথচ কেউ কেউ কবিকে খ-িতভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। তাঁকে সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে উপস্থাপন করেন। চক্রান্তের অংশ হিসেবে মসজিদের ইমাম, যাজক, মুক্তমনের মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কবি নজরুলের নিবিড় সম্পর্ক ছিল জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে আনা হয়। পরে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। কবি ১৯২৬, ১৯২৯ এবং ১৯৩৭ সালে চট্টগ্রামে এসেছেন উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামে নদ-নদী, পাহাড়-সাগর, প্রাকৃতিক পরিবেশ কবিকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর লেখনিতে এখানকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। এসময় তিনি চট্টগ্রামে ‘নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে ঘোষণা দেন। মন্ত্রী বলেন, নজরুল ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। ইতোমধ্যে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এজন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। জায়গা পেলেই নির্মাণকাজ শুরু হবে বলে জানান সংস্কৃতি মন্ত্রী। বাংলা একাডেমিতে একক বক্তৃতা ॥ জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি বিকেলে নজরুল মঞ্চে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ‘বাংলা গানে নবআধুনিকতার প্রবর্তনায় কাজী নজরুল’ শীর্ষক একক বক্তৃতা করেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান। অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সদ্য প্রকাশিত ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলী’র নজরুল বিষয়ক খ- উপস্থাপন করেন ড. অনু হোসেন। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। বক্তৃতায় মনিরুজ্জামান বলেন, আধুনিক হয়েও নজরুল ভক্তিমূলক গানের বিকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁর ইসলামী গানের পাশাপাশি শ্যামা সংগীতও অপরূপ সৃষ্টির উদাহরণ। তিনি বলেন, নজরুলের উদারতা এবং উদাসীনতার চিহ্নস্বরূপ তাঁর গানের গায়কী স্বাধীনতা বা স্বৈরিতা আধুনিকতার অন্তর্গত এক ব্যতিক্রমী ও শ্রেষ্ঠ ফসল। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম বলেন, নজরুল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হলেও তাঁকে আমরা আধুনিক বাংলা গানের প্রবক্তা বলে চিহ্নিত করতে পারি। সুরবৈচিত্র্যে ও বাণী-বৈভবে তিনি গানকে ঋদ্ধ করেছেন। তিনি বাংলা গানকে আপামর জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিল্পকলা একাডেমিতে কবি বন্দনা ॥ নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাতীয় নাট্যশালায় সন্ধ্যায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে কবির কবিতা থেকে আবৃত্তি, গান ও নৃত্য পরিবেশন করেন জনপ্রিয় শিল্পীরা। নজরুলের কবিতা থেকে একক আবৃত্তি করেন সৈয়দ হাসান ইমাম, আশরাফুল আলম, আহ্কাম উল্লাহ, নায়লা তারান্নুম কাকলী ও ফয়জুল্লাহ সাঈদ। সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে সরকারী সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়, শিল্পকলা একাডেমি রেপার্টরি সঙ্গীত দল। গানে গানে নজরুল বন্দনা করেন খালিদ হোসেন, বুলবুল মহলানবীশ, শবনম মুশতারী, ফাতেমা তুজ জোহরা, খায়রুল আনাম শাকিল, সালাউদ্দিন আহমেদ, ইয়াকুব আলী খান, সঞ্জয় কবিরাজ, প্রিয়াঙ্কা গোপ প্রমুখ। উদীচীর আলোচনা ॥ উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম এবং সঙ্গীতের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। পরিবেশন করা হয় নানা আঙ্গিকের গান। এতে মূল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী। এদিকে, ছায়ানটের দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা শুরু হবে আজ শুক্রবার থেকে। ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে শনিবার পর্যন্ত চলবে এ উৎসব। সান্ধ্যকালীন আয়োজনে থাকছে নজরুলের গান, পাঠ, আবৃত্তি ও নৃত্যানুষ্ঠান। সংগঠনের শিক্ষক শিক্ষার্থী ও খ্যাতনামা শিল্পীরা উৎসবে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন।
×