ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিপিডির অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা

প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসংস্থান বাড়ছে না

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২৬ মে ২০১৬

প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসংস্থান বাড়ছে না

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ নানা প্রতিবন্ধকতার পরও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা স্থিতিশীল বলে মনে করে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি, আমদানি-রফতানি ভারসাম্য, মুদ্রার স্বাভাবিক বিনিময় হার, বিদেশী বিনিয়োগ, জ্বালানিসহ পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে গবেষণা সংস্থাটি। এজন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন অব্যাহত রেখে আসছে বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। সিপিডির পর্যালোচনা বলছে- রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বড় হলেও, নীতিমালায় নেই বড় ধরনের সংস্কার। একই অবস্থা এডিপিতেও। এছাড়া কালো টাকা সাদা করার তদ্বির, সরকারের অন্যান্য নীতিকেও অবিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। তাই তাদের পরামর্শ আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের। নতুন ভ্যাট আইনের পক্ষে মত দিলেও সংস্থাটি বলছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যেন কোন মতানৈক্য তৈরি না হয়। বুধবার রাজধানীর সিরডাপ অডিটরিয়ামে সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৫-১৬ তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয়ে কথা বলেন সংস্থাটির সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনটি হয়। সিপিডির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ বিশ্বের ১৬১টি দেশের মধ্যে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৫তম। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯তম। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দের দিক থেকে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে কম্বোডিয়া। এ অবস্থান থেকে উত্তরণের জন্য আসছে বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা খাতেও ব্যয় বাড়াতে হবে। এছাড়া বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট চায় সংস্থাটি। তাদের মতে, প্রতিবছরই বাজেটের আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ ঘাটতি থাকে। জ্বালানি তেলের আয় থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় করার আহ্বান জানানো হয়। সিপিডি বলছে, নতুন মূসক আইন বাস্তবায়ন কিভাবে হবে, তা সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা উচিত। ভোক্তাপর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির উদাহরণ দিয়ে সিপিডি বলছে, নতুন মূসক আইন বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুত বিলের ওপর ভোক্তাদের ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ মূসক দিতে হবে। আবার লোহা বা রডের ওপর মূসক বাড়লে তা অবকাঠামো তৈরির প্রকল্পে খরচ বাড়াবে। সিপিডি আরও বলছে, নতুন মূসক আইনে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল, অর্থ পরিশোধ, নিবন্ধন নেয়া যাবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সংস্থাটির সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় বাড়াতে হবে। এছাড়া কৃষিতে বড় ধরনের বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি। তিনি দেশের আর্থিক খাত প্রসঙ্গে বলেন, দেশের আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য ভাল না। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। ব্যবস্থাপকদের সুনির্দিষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে। তাই এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে সুশাসনের প্রয়োজন। এজন্য ব্যাংক ও আর্থিক খাতে কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ জানান, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এদিকে বাজেট বাস্তবায়নেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। এর দুর্বল দিক হলো- এডিবি বাস্তবায়ন কম ও উন্নয়ন খাতে সরকারী ব্যয় কম হচ্ছে। সিপিডির অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের হিসাবের গরমিলের বিষয়টি ওঠে এসেছে। সিপিডি মনে করে, বেসরকারী বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের অনুপাতে বাড়ছে না। সংস্থাটির ফেলো ড. দেবপ্রিয়ের মতে, যে প্রবৃদ্ধ কর্মসংস্থান দেয় না সে প্রবৃদ্ধি দেশের কোন কাজে লাগবে না। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শুধু উচ্চহার নয় প্রবৃদ্ধির গুণগতমানও ভাল হতে হবে। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে কিন্তু ৪-৫টি সমস্যা রয়েছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির বছরে দেশে কর আহরণ, কর্মসংস্থান, ব্যক্তিগত ও শিল্প খাতে বিনিয়োগ এবং সম্পদ আহরণ কমেছে। সেই সঙ্গে কমেছে উৎপাদনশীলতা। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে বাজেট নিয়ে যত আলোচনা হয়Ñ সারা বছর নীতি নিয়ে কোন আলোচনা-সমালোচনা করতে দেখা যায় না। কৃষিতে প্রণোদনা নেই। পোশাক শিল্পে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, উন্নয়ন ও প্রশাসনে, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে সংস্কার দরকার। সুদের হার কমে যাওয়ায় ছোট সঞ্চয়কারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়ার দিকে লক্ষ্য রেখেই আগামী বাজেট তৈরি করতে হবে। কৃষিতে বিনিয়োগ কমেছে। এখন ভর্তুকি তুলে নিলে আরও বড় ধরনের সমস্যা হবে। কৃষিতে বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার। তিনি আরও বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমিয়েছে সরকার। কিন্তু এর সুফল কৃষক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী পাচ্ছে না। তাই কেরোসিন ও ডিজেলের দাম আরও কমানোর আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, বিনিয়োগ হচ্ছে না, অথচ দেশ থেকে টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এটা এখন প্রকাশ্য। প্রচুর মানুষের দেশে-বিদেশে বেনামী সম্পদ রয়েছে। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কালো টাকার তদ্বির করা শুভলক্ষণ নয়। আগামী জুলাইয়ে চালু হতে যাওয়া নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুতের দাম বাড়বে বলে জানিয়েছে সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, এখন বিদ্যুতের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। নতুন আইনে বিদ্যুতের আরও ১০ শতাংশ বেশি ভ্যাট যুক্ত হবে। এতে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে। আবার লোহা বা রডের ওপর মূসক বাড়লে তা অবকাঠামো তৈরির প্রকল্পে খরচ বাড়াবে। ফলে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এতে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়বে। সিপিডি আরও বলছে, নতুন মূসক আইনে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল, অর্থ পরিশোধ, নিবন্ধন নেয়া যাবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমরা এই নীতি (মূসক) প্রচলনের পক্ষে। তবে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের যে ঐকমত্য হচ্ছে না; প্রকাশ্যে বিরোধিতা হচ্ছে, সেটা সমাধান না হলে এ আইন বাস্তবায়ন কঠিন হবে। তিনি মনে করেন, এ আইনটি সফলভাবে কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এছাড়াও ভ্যাট আইন সম্পর্কিত ব্যবসায়ীদের যে ৭টি আপত্তি রয়েছে সেসব বিষয়ে সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মনে করছে সিপিডি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনার সমন্বয়কারী তৌফিকুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেনÑ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান, দ্য ওয়ার্ড ব্যাংক গ্রুপের কনসালটেন্ট ফাইয়াজ তালুকদার প্রমুখ। সমষ্টিক অর্থনীতির খাতওয়ারি বিশ্লেষণ, কৃষিপণ্যের দামের গতি-প্রকৃতি, প্রবৃদ্ধি অনুযায়ী দেশে কতটা কর্মসংস্থান হয়েছে ও টাকার মানসহ সার্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিকের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে লিখিত পর্যালোচনা প্রতিবেদনে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, দেশে ধান চাষের জমির পরিমাণ কমেছে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী দুই থেকে তিন বছরে ক্রমান্বয়ে মূসক আইন বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ব্যবসায়ীরা যাতে উপকরণ রেয়াত নিতে পারেন, তা নিশ্চিত করা দরকার। তা না হলে পণ্যের ওপর তা বিক্রয় কর (সেলস ট্যাক্স) হয়ে যাবে।
×