ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৬ মে ২০১৬

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

(গতকালের পর) আগের দিন বিকেলে মনজুর তার সব সিনিয়র অফিসারকে মিটিংয়ে ডাকলেন। জানালেন, অন্যান্য ক্যান্টনমেন্ট এই বিপ্লবে সাড়া দিচ্ছে না। সুতরাং বিকল্প কী? ঢাকা-চট্টগ্রাম সীমান্তে অর্থাৎ শুভপুর ব্রিজের দুই দিকে দু’পক্ষের সৈন্যরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল। মনজুর মেজর জেনারেল শওকতের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন। বিপ্লবের উদ্দীপনা তখন শেষ, বরং আত্মসমর্পণের শর্ত আলাপ হচ্ছিল। বিকেল সন্ধ্যায় গড়াতে না গড়াতে দেখা গেল মনজুরের সিনিয়র সহকর্মীরা একে একে বিভিন্ন অজুহাতে কেটে পড়ছেন। মনজুর এবং যারা জিয়া হত্যায় ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা কিছুই করতে পারছিলেন না। হান্নান শাহ সবার শেষে কী এক অজুহাতে বেরিয়ে যান। মাঝরাতের দিকে মনজুর তার পার্শ্বচরকে জীপের ব্যবস্থা করতে বলে ২০০ গজ দূরে তার বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। সঙ্গে লে. কর্নেল মতি ও আরেকজন অফিসার। মতিই নাকি সার্কিট হাউসে আক্রমণ চালিয়েছিলেন। মনজুর বাসা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে রামগড়ের উদ্দেশে রওনা দিলেন। তার সঙ্গে কেউ ছিল না। পেছনের জীপে সেই দুজন অফিসার ছাড়া। চট্টগ্রামে কতজন মনজুরের সমর্থনে ছিলেন জানা যাবে না। জিয়াউদ্দিন জানিয়েছেন, তিনি যখন মনজুরের সঙ্গে দেখা করতে যান তখন ৫০-৬০ জন অফিসার দেখেছিলেন। কিন্তু তারা সবাই মনজুরের সমর্থক ছিলেন এমন বলা যাবে না। ॥ ছয় ॥ মনজুরের পলায়ন, জিয়াউদ্দিনের ভাষায়, তাদের মনে আশা জাগাল। কেননা, সমস্যার সমাধান না হলে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারত। সারা শহরে নানা ধরনের গুজব। এর একটি ছিল, মনজুরের সমর্থক অনেকে শহরের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। আরও খবর পাওয়া গেল, জিয়ার মরদেহ কবর দেয়া হয়েছে। কোথায় কবর দেয়া হয়েছে তা নিয়ে গুজব ছিল। কিন্তু পরে নির্দিষ্ট জায়গা পাওয়া গেল। শহর থেকে ২৬ মাইল দূরে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়কের পাশে বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানির তামাক সংগ্রহ কেন্দ্র। তার পাশেই জিয়াকে কবর দেয়া হয়েছে। একজন মৌলভী পুলিশকে জানিয়েছেন, ৩০ তারিখ সকালে একদল সৈন্য এখানে কাকে যেন কবর দিয়েছে। এক স্কুল ছাত্রও তা জানিয়ে ছিল। পরে জিয়া হত্যার খবর শুনে তারা ধরে নেয় ওই মৃতদেহ জিয়ার। পুলিশ ইতোমধ্যে কবর খুঁড়ে দেখেছে, মৃতদেহটি জিয়ার। এসপি ডিসিকে জানালেন পুলিশকে তিনি ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছেন মৃতদেহ শহরে নিয়ে আসার। ডিসি তখনই কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালেন, তাদের দুজনেরই মৃতদেহের সঙ্গে থাকা দরকার এবং তা শহরে না এনে ক্যান্টনমেন্টে নেয়াই বাঞ্ছনীয়। ব্রিগেডিয়ার আজিজুর রহমান তখন ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার। তাকে জিয়াউদ্দিন জানালেন, মৃতদেহ তারা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসছেন এবং খুব শীঘ্রই তা যেন ঢাকা পাঠাবার বন্দোবস্ত করা হয়। না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এসপির সঙ্গে রাঙ্গুনিয়া যাওয়ার পথেই জিয়াউদ্দিন দেখতে পেলেন পুলিশ মৃতদেহ নিয়ে আসছে। তারা নির্দেশ দিলেন তাদের পিছে আসতে। ক্যান্টনমেন্টের দিকে রওনা দিলেন তারা। ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার পথে মনে হলো সেখানে কার্ফু জারি করা হয়েছে। সুনসান। ক্যান্টনমেন্টের সদর দরজা খোলা। কোন প্রহরা নেই। ব্যারাকে সিভিলিয়ান পোশাকে কিছু সৈন্য ঘোরাঘুরি করছেন। তারা ব্রিগেডিয়ার আজিজের অফিসে পৌঁছলেন। সেখানের অবস্থা দেখে তাদের রেলস্টেশনের কথা মনে হলো। সিভিলিয়ান ও ইউনিফর্ম পরা অফিসাররা ঘোরাঘুরি করছেন। তাদের চুল উসকো-খুসকো। গালে না কামানো দাড়ি। মনে হচ্ছে কয়েকদিন ধরে তারা ট্রেনের অপেক্ষা করছেন। অফিসে যাদের দেখলেন, জিয়াউদ্দিন দুই দিন আগেও তাদের সেখানে দেখেছেন। আজিজের সঙ্গে আছেন কুমিল্লা গ্যারিসনের প্রধান মেজর জেনারেল সামাদ। আজিজ তাদের বসতে বললেন। জানালেন ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার রওনা হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে তার লোকজন মৃতদেহ পাঠাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লে. কর্নেল তোফায়েল, সেনাবাহিনীর ডাক্তার তাদের তত্ত্বাবধানে কফিন প্রস্তুত হচ্ছে। জিয়াউদ্দিন দেখলেন, পুরো ক্যান্টনমেন্টে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ব্রিগেডিয়ার আজিজকে জিয়াউদ্দিন জানালেন, ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার মুখে কোন প্রহরা নেই। পাহারা না থাকলে লোকজন খবর পেয়ে আসা শুরু করলে ঝামেলা হবে। আজিজ জানতেন না যে ঢোকার মুখে কোন প্রহরা নেই। একজন লে. কর্নেলকে ডেকে বললেন প্রহরার ব্যবস্থা করতে। তিনি নিরাসক্তভাবে জানালেন, এখন বেরিয়ে তিনি জীবন বিপন্ন করতে পারবেন না। আজিজ জিয়াউদ্দিনের দিকে ফিরে বললেন, ‘দেখলেন অবস্থা’। তারপর আরেকজন কর্নেলকে ডেকে একই নির্দেশ দিলেন। কর্নেল জানালেন “স্যার, এই খারাপ সময়ে আমাকে পাঠাচ্ছেন প্রহরার ব্যবস্থা করতে। আমি যাব, তবে আমার কিছু হলে আপনি দায়ী থাকবেন। আর আমি গেলেও পিপস খুলে যাচ্ছি।” বলে তিনি কর্নেলের পদচিহ্ন মর্যাদার ব্যাজ খুলে পকেটে রেখে বেরিয়ে গেলেন। মনে হচ্ছিল, তিনি নিশ্চিত যে আর জীবিত ফিরবেন না। আরেকটি ঘটনার কথা জিয়াউদ্দিন উল্লেখ করেছেন যাতে বোঝা যায় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে তখন কী ধরনের অবিশ্বাস বিরাজ করছিল। জেনারেল সামাদকে জিয়াউদ্দিন বলছিলেন, তারা অর্থাৎ বেসামরিক ব্যক্তিরা এখন নিশ্চিত যে তিনি চলে এসেছেন। সামাদ বলেন, “কী বলেন আপনি? আমি কী পাগল নাকি যে এখানে রাত কাটাব। আমি কুমিল্লা ফিরে যাচ্ছি।” জিয়াউদ্দিন বুঝলেন, অফিসাররা তখনও নিশ্চিত নয় কে কার দিকে। মৃতদেহ প্রস্তুত হলে ব্রিগেডিয়ার আজিজের সঙ্গে তারা হাসপাতালে গেলেন। আবারও সেই বীভৎস দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হলো। মুখের ডান দিক নেই। বাঁ দিক ঝুলে আছে। ঠোঁটের ওপর ট্রেডমার্ক সেই গোঁফের অংশ দেখে জিয়া বলে চেনা যাচ্ছে। হেলিকপ্টার এলো। আজিজ জানালেন, সৈন্যরা চাচ্ছে সেনা স্টেডিয়ামে জানাজা হোক। জিয়াউদ্দিন জানালেন, হেলিপ্যাডে জানাজা হলেই ভাল। তাই হলো। কফিন নিয়ে হেলিকপ্টার ঢাকা রওনা হলো। কমিশনার আর ডিসি অপরাহ্ণে শহরে ফিরলেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিকেলে লালদীঘির ময়দানে এক গায়েবি জানাজার আয়োজন করে। চট্টগ্রাম জামে মসজিদের মাওলানা মাদানী জানাজা পড়ালেন। (চলবে)
×