ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘প্রধানমন্ত্রী, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি’ -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২৬ মে ২০১৬

‘প্রধানমন্ত্রী, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি’ -স্বদেশ রায়

ভদ্র মহিলা অল্প বয়সে স্বামী হারিয়েছেন। থাকেন খুব ছোট এক ফ্লাটে। স্বামীর ও মায়ের যে সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন তা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে তার সুদেই তিনি জীবনযাপন করেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দেখা হতেই বললেন, প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে একটি লেখা যেন আমি লিখি, কারণ তিনি সংসার চালাতে পারছেন না। শুধু যে এই স্বামীহারা ভদ্র মহিলার বক্তব্য এ তা নয়। একজন সরকারী কর্মকর্তা, এখন অবসরে আছেন, থাকেন উত্তরায়। এ যাবত অন্তত চারদিন আমাকে টেলিফোনে অনুরোধ করেছেন, আমি যেন ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের সুদের হার নিয়ে একটু লিখি। তাঁরও একই বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করেই যেন লিখি। এ অনুরোধ শুধু ঢাকা থেকে আসেনি, অনেক ছোট শহর, জেলা শহর থেকেও এসেছে। প্রথমেই চিন্তায় পড়ে যাই, সবাই কেন প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে এ লেখা লিখতে বলেন। যদিও সার্বিকভাবে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর, তার পরেও তো এ বিষয় নিয়ে অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে লেখা যায়। এই চিন্তা করতে করতে হঠাৎই মনে হলো, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি শেখ হাসিনা। কবি হাসান হাফিজুর রহমান যাকে বলেছিলেন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ’। আসলে বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা তো সমার্থক শব্দ দুই-ই শেখ মুজিবের সৃষ্টি। তাই শেখ হাসিনা যতদিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, ততদিন মানুষ সবকিছু তাঁর কাছেই চাইবে। এ ভার তাঁকে কাঁধে করে হোক আর কোলে-পিঠে করে হোক বহন করতে হবে মাতৃস্নেহ দিয়ে। আর তাই তো দেশের বেশ বড় একটি অংশ বা মধ্যবিত্তের ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের বড় একটি অংশ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেনÑ তাদের অনেকে বলছেন, আমি যেন লিখি, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।’ এখন প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী কী করবেন? কীভাবে তিনি এই সপ্তরথী বেষ্টিত ব্যূহ ভেদ করবেন। কারণ, দৃশ্যত এ এক জটিল অঙ্ক। এ অঙ্কের সমাধান অর্থনীতিবিদদের হাতে খুব বেশি নেই। তাদের হাতে সমাধান থাকলে দেশ এই চক্রব্যূহতে পড়ত না। অর্থনীতিবিদরা হিসাব করে দেখেছেন, আমাদের ব্যাংকগুলোতে শিল্পঋণের, ব্যবসায়িক ঋণের যে সুদের হার ছিলো এই সুদের হার গুনে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করা সম্ভব নয়। শিল্পপতিদের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব নয়। অতএব শিল্পঋণের সুদের হার কমানো দরকার। সরকার সেটা মেনে নিয়েছে। শিল্প ও ব্যবসায়ী ঋণের সুদের হার কমানোর ফলে স্বাভাবিকই আমানতকারীদের সুদের হার কমাতে হয়েছে। কারণ ব্যাংককেও তো বেঁচে থাকতে হবে। লাভ করতে হবে। সেটাও তো একটা বিনিয়োগ। অবশ্য পরিচিত একজন অর্থনীতিবিদ পেয়েছি যিনি মনে করেন, শিল্পঋণের যে হার ছিল তাতে শিল্প করার কোন সমস্যা ছিল না। তিনি একটা হিসাবও মুখে মুখে বলেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, শিল্প গড়ার জন্য শুধু ব্যাংক ঋণ নয়, সরকার তো আরও নানান সুবিধা দেয়। সেগুলোর হিসাবও ধরতে হবে। আর প্রাইভেট খাতকে তো একেবারে সাইফুর রহমানের ভাষায় ‘সরকার চালিত প্রাইভেট খাত হলে হবে না।’ তাদেরও নিজের পায়ে হাঁটতে হবে। যা হোক, আমাদের অর্থনীতিবিদরা সরকারকে যে পলিসি দিয়েছেন, সরকার তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু এর পরেও বাস্তবতা হলো, সুদের হার কমানোর পরেও এমন কোন বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে না যে, আগামী দুই-চার বছরে দেশের শিল্প এমন স্থানে যাবে যে, তাদের কারণে দেশের স্টক মার্কেট ফটকাবাজিতে নয়, প্রকৃত অর্থে বড় হবে। দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত সেখানে বিনিয়োগ করে, কোম্পানির কাগজের লাভের টাকায় শেষ বয়সে চলতে পারবেন। বরং এখনও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ এর অর্থই হচ্ছে নিজের শেষ সম্পদটুকু অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়া। এ কাজ নিশ্চয়ই বিবেচক কেউ করতে যাবে না। তাছাড়া যারা অর্থনীতির একটু খোঁজখবর রাখেন তারা সকলে জানেন, দেশের শিল্প গড়ে ওঠে, বিনিয়োগ বেড়ে একটি বড় মাপের স্টক মার্কেট গড়ে উঠতে এখনও বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে। আর এই সময়টা দেশের এই নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত যারা সীমিত আয় ও সঞ্চয়ের সুদ মিলিয়ে চলেন তারা কীভাবে চলবেন? অর্থনীতিবিদরা যে এ সমস্যা সমাধান করতে পারবেন এটা বলতে পারি না। কারণ পৃথিবীর অর্থনীতির ইতিহাসে দেখা যায়, অর্থনীতির যে কোন জটিল সমস্যার সমাধান রাজনীতিবিদরাই করেন। তখন অর্থনীতিবিদরা এর ভেতর কোন অংশ পলিটিক্যাল ইকোনমি আর কোন অংশ তাত্ত্বিক ইকোনমি তা নিয়ে বই লেখেন। তাছাড়া অর্থনীতিবিদদের এখানে কোন দোষ দেয়া উচিত নয়। কারণ তাঁরা তো অর্থনীতিবিদ, তাঁরা তো নেতা নন। এমনকি শিল্পপতিদের দোষ দেয়া উচিত নয়। কারণ তাঁরা তো শিল্পপতি, তাঁরাও নেতা নন। নেতা সব সময়ই ভিন্ন। প-িত জওয়াহেরলাল নেহরুর একটি পলিটিক্যাল ইকোনমি সিদ্ধান্তের পর, তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে জামসেদজী টাটা দেখা করেন প-িতজীর সঙ্গে। জামসেদজীর যাবতীয় বক্তব্য খুবই গুরুত্বের সঙ্গে শুনে প-িতজী তাকে জিজ্ঞেস করেন, জামসেদজী আপনার সব কারখানা মিলে মোট কত আয়তন? জামসেদজী উত্তর দেন। তখন প-িতজী বলেন, জামসেদজী আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় ওই আয়তনের ভেতর তাকিয়ে আর আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত তাকিয়ে। শেখ হাসিনাও যদি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া অবধি না তাকাতে পারতেন, তিনি কিন্তু পদ্মা সেতু নিজ অর্থায়নে করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। এখন আমাদের মতো কোন সাংবাদিক বলছেন না ভুল ছিল তাঁর সিদ্ধান্ত, কোন অর্থনীতিবিদ এমনকি বিশ্বব্যাংকও বলছে না। অথচ তখন আমাদেরও সংশয় ছিল। এখানেই রাজনীতিবিদের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য। কোন কোন গুণাবলী তাদের এই পার্থক্য সৃষ্টি করতে সাহায্য করে তা নিয়ে অনেক বড় বই লেখা যায়। তবে একটি কথা বলা যায় স্পষ্ট করে, প্রথমত সাহস এবং শেষ অবধি সাহসÑ এই সাহসই তাদের গুণাবলী। পাকিস্তানের কত অস্ত্র আছে আর আমাদের কয়খানা বাঁশের লাঠি আছে এ হিসাব করলে শেখ মুজিব কোন দিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারতেন না। তিনি একটি অস্ত্রের বলেই স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, সে অস্ত্র হলো তাঁর বুকের সাহস তিনি সাড়ে সাত কোটি বুকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই শেখ হাসিনার এই উন্নয়নের মধ্যে বসেও যারা সংসার চালাতে পারছেন না তাদের বিষয়ে বাস্তবে শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না। তিনিই প্রকৃত সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে আমাদের মতো সাধারণ মাথায় যে পথ খুঁজে পাই, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীতভাবে তা একটু ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করব। কারণ যে কোন দরিদ্র ও জনঘনত্বপূর্ণ দেশে শুধু নয়, আমেরিকার মতো দেশেও কিন্তু অনেক বেল আউট করতে হয়। অর্থাৎ কোন একটা ফর্মে নানা খাতে ভর্তুকি দিতে হয়। সরকার যদি ব্যাংকের মাসিক ছয় পার্সেন্ট ইন্টারেস্টের ওপর আরও ছয় পার্সেন্ট সরকারী ভর্তুকি ধরে নানান নামে কিছু সঞ্চয়পত্র ছাড়ে, তাতে হয়ত সরকারের বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি যাবে কিন্তু শেষ অবধি সেটা ভর্তুকি থাকবে না। কারণ, জনগণ যে টাকা সরকারের কাছে গচ্ছিত রাখবে ওই সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ওই টাকা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হবে। তার লাভ হিসাব করলে তখন কিন্তু এই ভর্তুকির পরিমাণ কমে যাবে। হয়ত শেষ অবধি লাভও হতে পারে। এ ছাড়া নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য সহজে পেতে পারে এমন কিছু সরকারী বন্ড অন্তত দশ পার্সেন্ট ইন্টারেস্টে সরকার ছাড়তে পারে। যেগুলো কোন কোম্পানি কিনতে পারবে না। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারিত থাকবে। এ সবই একটি নির্দিষ্ট সময় অবধি চালু রাখলে চলবে। কারণ এশিয়ার অর্থনীতির পরিবর্তনের মুখে আমরা বসে আছি। এখন সত্যি অর্থে দেশকে জঙ্গী ও খালেদার রাজনীতি মুক্ত করা সম্ভব করতে হবে। এর পাশাপাশি সৃষ্টি করতে হবে কয়েকটি প্রকৃত রাজনৈতিক দলের জন্ম যাতে স্বাভাবিকভাবে ঘটে সে পরিবেশ। ওই দলগুলোকে অবশ্যই স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে। এর সঙ্গে একটি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হলে এ দেশের অর্থনীতি আমূল বদলে যাবে। মানুষকে আর তখন কোন টানাপোড়েনে পড়তে হবে না। আরব দেশগুলোর মতো জঙ্গীদের হাতেও অর্থনীতি ও দেশ চলে যাবার কোন সম্ভাবনা থাকবে না। তখন মানুষের বেঁচে থাকার ও সংসার চালানোর আরও অনেক পথ বের হবে। [email protected]
×