ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলঃ মানবতাবোধের জোরালো উচ্চারণ

প্রকাশিত: ০০:২৫, ২৫ মে ২০১৬

নজরুলঃ মানবতাবোধের জোরালো উচ্চারণ

লিটন আব্বাস ॥ ঊনিশ শতকীয় মানবতার ঐতিহ্যে লালিত ও বিশ শতকীয় গণআন্দোলনের চেতনায় পুষ্ট রোমান্টিক কবি মানসে দুই প্রবৃত্তির সহাবস্থান আজ অতি স্বাভাবিক ঘটনা রূপেই গণ্য হলেও মানবমুক্তির মন ও ময়ুখরূপেই তিনি মানবমননে স্থায়ী আসন পেয়েছেন। সমালোচক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় বলেন-“নজরুল মানবতার বাস্তব দৃষ্টান্ত। আকাশচারী বিহঙ্গের মত সত্য সুন্দরের স্বপ্নাভিসারী হয়েও তিনি অবলীলায় মাটির বুকে নেমে এসেছেন, সহস্র শিকড় দিয়ে তরুলতা যেমন মাটিকে আঁকড়ে ধরে থাকে তেমনি করে পৃথিবীর মানুষকে আঁকড়ে ধরেছেন অপার মমতায়। ধূলোবালি মেখেও অতৃপ্তি বোধ করেননি। এতোদসত্ত্বেও তিনি যখন বলেন যে, তাঁর সত্তার পনের আনা রয়েছে স্বপ্নে বিভোর। তখন তাঁকে বিশ্বাস করতে আমাদের আপত্তি হয় না। কারণ ওটাই তাঁর প্রতিভার মূলগত প্রবৃত্তি-যুগধর্মে সে প্রবৃত্তি অনিবার্যভাবে অনেকটাই মানবমুখী হয়ে পড়েছে এই যা ব্যতিক্রম। এই যে যুগধর্মকে স্বীকার করে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা তাই নজরুল প্রতিভাকে ঐতিহাসিক তাৎপর্য দান করেছে।” সত্য সুন্দরের পূজারী মানবতার বাণীবাহক এই কবি সম্পর্কে আর একটি লক্ষণীয় জিনিস হচ্ছে, তিনি সর্বত্র আবেগনির্ভর হলেও আপন শিল্পকর্মের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশ্চর্যরূপে নির্লিপ্ত নিরাবেগ; ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেকে বিড়ম্বিত করতে প্রস্তুত নন একেবারেই। অপরূপ নির্লিপ্ততার সাথে কবি বলেনÑ“বাঙলা সাহিত্যে আমার স্থান সম্বন্ধে আমি কোনদিনই চিন্তা করিনি। এর জন্যে লোভ নেই আমার। সময়ই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সমালোচক। যদি উপযুক্ত হই। একটা ছালা-টালা পাব হয়ত।” নজরুল প্রেমের কবি, যৌবনের কবি-নন্দনের কবি-সৌন্দর্যের ও বিদ্রোহের কবি বলে সেকাল একালের কোন কোন সমালোচক মন্তব্য করেনÑ-‘নজরুল পঁচিশ বছর এক প্রতিভাবান বালকের মতো লিখেছেন, কখনো বাড়েন নি, বয়স্ক হননি। পরপর তাঁর বইগুলিতে কোন পরিণতির ইতিহাস পাওয়া যায় না, কুড়ি বছরের লেখা আর চল্লিশ বছরের লেখা একই রকম। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতিভার প্রদীপে ধী-শক্তির শিখা জ্বলেনি। যৌবনের তরলতা খর্ব হয়নি কখনো, জীবন-দর্শনের গভীরতা তাঁর কাব্যকে রূপান্তরিত করে নি। তাঁর সৃষ্টি-প্রেরণার প্রবলতা বিপথগামী হয়েছে আত্মস্থ স্বাধীন সচেতনতার অভাবে।” নজরুল প্রতিভার স্বরূপ ব্যাখ্যানে বুদ্ধদেব বসুর এ উক্তি আজ লক্ষ্যহীন। নজরুল প্রতিভা সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর রায়ই চূড়ান্ত এর উপর আপীল চলেনা, এমন কথা মেনে নিতে অনেক গবেষকের আপত্তি আছে। নিঃসন্দেহে তারা নজরুলকে উপেক্ষা করেছেন। স্বয়ং নজরুল তাঁর সাহিত্য ভাবনা সম্পর্কে মূল্যবান মতামত দিয়েছেন-এ মতামত তাঁদের দৃষ্টিগোচরে থাকলে কোন কোন সমালোচকের মাথার পোকা দূর হয়ে যাবে বহুলাংশে। কাব্য সৃষ্টির রহস্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নজরুল বলেছেন-“আনন্দ ও সৌন্দর্য তৃষ্ণা মানুষের চিরন্তন। মানুষ অন্নের জন্য ক্ষুধা অনুভব করে; তেমনি করে সৌন্দর্য পিপাসাকে অনুভব। মানুষের এই সৌন্দর্য ক্ষুধা থেকেই কাব্যের সৃষ্টি-কবির জন্ম।” যদিও কবি সাথে এ কথাও আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যেÑ কবি ও সাহিত্যিকের জীবন ও তাঁর সৃষ্টি যেন শতদল। তার এক একটি দল জন্ম নিয়েছে দুঃখ বেদনার আঘাত পেয়ে।” রোমান্টিক হয়েও যে কবি বাস্তব জীবন বোধ বিবর্জিত নন এ উক্তিতে তার প্রমাণ মেলে। বস্তুত সকল রোমান্টিক কবির মত নজরুল ছিলেন মূলত সুন্দরের পূজারী, আনন্দের ধেয়ানী। সেকারণে নিজেকে বিদ্রোহীরূপে পরিচিত করতে তার বরাবর অনীহা ছিল। তিনি আপন মনোভাব বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেনÑ“আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোন দিনই নেই। তাড়া যারা খেয়েছে, অনেক আগে থেকেই মরণ তাদের তাড়া করে নিয়ে ফিরছে। আমি তাতে এক আধটু সাহায্য করেছি মাত্র।” অকপটেই বলেছেনÑ‘‘একথা স্বীকার করতে আজ আমার লজ্জা নেই যে আমি শক্তি সুন্দর রূপসুন্দরকে ছাড়িয়ে আজো উঠতে পারিনি। সুন্দরের ধেয়ানী দুলাল কীটসের মত আমারও মন্ত্র-ঞৎঁঃয রং নবধঁঃু নবধঁঃু ঃৎঁঃয . সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম।” তাঁর এ সৌন্দর্য-ধ্যান কবি স্বভাবের বিশেষ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত হয়ে গতানুগতিক রোমান্টিক ভাবনা থেকে যে কিছুটা স্বতন্ত্র হয়ে ফুটে উঠেছে, তাও তাঁর উক্তি থেকে পরিস্ফুটÑ“আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তাঁর চোখে চোখভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে, তাঁকে ক্ষুধাদীর্ণ মূর্তিতে, ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি। কারাগারের অন্ধকুপে তাঁকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি। আমার গান সেই সুন্দরকে রূপে অপরূপ করে দেখার স্তবস্তুতি।” রবীন্দ্র প্রভাব থেকে বের হয়ে যে কয়জন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে দীপ্যমান হয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম তাদের মধ্যে অন্যতম। “মোসলেম ভারত” পত্রিকায় তাঁর “বিদ্রোহী (১৯২১)” এবং “কামাল পাশা” কবিতা প্রকাশের পরই তিনি অল্পকালের মধ্যেই খ্যাতির তুঙ্গে আরোহণ করেন এবং বিদ্রোহী কবি রূপে সর্বত্র পরিচিত হন। নজরুলের চেতনায় স্বদেশ আর স্বদেশের পরাধীন মানুষের অন্তর্জ¡ালায় পীড়িত হয়ে হৃদয়ে বৈপ্লবিক চেতনার দারস্থ হয়ে এক হাতে “বাঁকা বাঁশের বাঁশরী” আরেক হাতে “রণতূর্য” নিয়ে কথা ও কাজকে কর্মে পরিণত করেছেন। এ প্রসঙ্গে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র বলেছেন-“ একমাত্র কথা ও কাজের মধ্যে মিল শুধু নজরুলের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা গেছে।” নজরুল শুধু কাব্যে প্রেম ও দ্রোহ ঘোষণা করেন নি রাজপথেও নেমেছিলেন মুক্তিকামী জাতির পরাধীনতার শিকল ভাঙতে- মুক্তির দিশা হয়ে নিরন্ন সাধারণ মানুষের দলে নেমেছিলেন। জেলও খাঁটতে হয়েছে কয়েকবার। স্বাধীনতাকামী মানুষের মিছিলে এরূপ কোন কবিরই প্রত্যক্ষ যোগাযোগ দেখা যায়নি। সাহিত্যে স্বদেশ ভাবনা-স্বদেশের মুক্তির গান অনেক কবির কণ্ঠেই ছিল কিন্তু তাদের একজনকেও কাব্য মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে পরাধীন মানুষের মুক্তির মিছিলে যোগ দিতে দেখা যায়নি। নজরুলের সাহিত্য জীবন ক্ষণজন্মা বলা চলে। ১৯১৭-১৯৪২ সাল পর্যন্ত প্রসারিত। পঁচিশ বছর ধরে তিনি প্রচুর কবিতা, গান, কিছু গল্প, কয়েকটি উপন্যাস ও নাটক রচনা করেছেন। সংগীত রচনাতেই তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ স্ফুরণ দেখা গেছে। প্রচলতি সংস্কার, রীতিনীতির সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং নির্যাতিত নিপীড়িত ও পতিত মানবের প্রতি প্রেম তাঁর কাব্যের মূল সুর। তাঁর রচনায় ভাষা স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত এবং বলিষ্ঠ। তাঁর সাহিত্য ভাবনার পরিচিতি কাব্যপাঠের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নটিও জবাব খুঁজে ফিরছে। সে প্রশ্নের জবাবও তিনি নিজের মত করেই দিয়েছেনÑ‘‘বড় বড় কবির কাব্য পড়া এই জন্য দরকার যে তাতে কল্পনার জট খুলে যায় চিন্তার বদ্ধধারা মুক্তি পায়। মনের মাঝে প্রকাশ করতে না পারার যে উদ্বেগ তা সহজ হয়ে ওঠে।” সাহিত্যিক যদি নিজের কথা, নিজের ব্যথা দিয়ে বিশ্বের কথা দরবারে ছোঁয়া না দিতে পারেন অর্থাৎ তাকে সার্বজনীনত্ব না দান করতে পারেন তবে সে সাহিত্য ব্যর্থ এই ছিল নজরুলের ধারণা। আর সত্যিকার সাহিত্য হলে তা যে কোন গ-ি মেনে চলতে পারে না এবং তা যে সকল জাতিরই সাহিত্য বলে গণ্য হতে বাধ্য এমন একটি প্রশান্ত ধারণাও নজরুলের ছিল। এখনো যারা নজরুল সম্পর্কে ধারণা পোষণ করছেন এই ভেবে-“তিনি আবেগকে আপন করেছিলেন বলে পরিণত শিল্পবোধ তাঁর লেখায় ফুটে ওঠেনি। এইসব সমালোচনা আজ সংশোধন যোগ্য হয়ে পড়েছে নজরুল মূলত রোমান্টিক কবি হলেও যুগ জীবনের প্রচ- দোলাকে কোনদিনই উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাই কাব্যে তিনি বারবার ফিরে আসছেন সংঘাত-সংক্ষুব্ধ সংসারের তীরে। তাঁর চিন্তা পরিধির মধ্যে এসেছে বাংলা সাহিত্যের নানা সমস্যা-যে সব সমস্যার মূল খতিয়ে পাওয়া যাবে সমকালীন বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানের পারস্পারিক জীবন সম্পৃক্ত নানা বিরোধী চিন্তা জটের মধ্যে। হিন্দু মুসলমানের জীবনের কর্ম ও চিন্তার সমঝোতার অভাব কিভাবে তাদের বাস্তবজীবনের চূড়ান্ত বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে তাদের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ভাঙন ধরাচ্ছে, কিভাবে তাদের সুস্থ জীবনদৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে, তা কবি বাস্তববাদীর মন ও দৃষ্টি নিয়েই অনুধাবন করেছিলেন। হিন্দু-মুসলমান জীবনের এ অভিশাপ বাংলা সাহিত্যের স্বভাব সুন্দর বিকাশকে কিভাবে ব্যাহত করেছিল তা কবির চেয়ে ভাল করে কেউ বুঝি ভেবে দেখেননি। আপন সাহিত্য সাধনার মূলগত উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে নজরুল স্পষ্টভাবে তাই বলেছেনÑ“আমি (আমার সাহিত্য কর্মে) হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যা-শেক্ করবার চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।” আধুনিক বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ক্লিন্নতার একটি গভীরতর কারণ নজরুলের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল। বৃহত্তর জাতীয় জীবনের যে বড় এক ট্র্যাজেডিরই ফলশ্রুতি আমাদের সাহিত্যের বর্তমান দুর্গতি তা চিহ্নিত করে নজরুল বলেছেনÑ“আজ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি এই যে, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটিকেই সবচেয়ে কম করে জানি।” এই যে কাছের মানুষটিকে আবিষ্কারের অক্ষমতা এটাই বাঙালী হিন্দু-মুসলমান তথা বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। আমাদের মানসিক সঙ্কীর্ণতা, ভাবনার কুপমু-কতা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাবই এর জন্যে দায়ী। নজরুল তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে প্রায় সর্বত্র ছড়িয়েছেন উদার মানবতাবোধের জোরালো হাওয়া। ভাবনা ও চিন্তার এই নবদিগন্তে নজরুলের সাহিত্য প্রতিভার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ও পঠন-পাঠনে কবি সম্পর্কে এই সপ্রশংস মনোভাবেরই সৃষ্টি হয় তিনি মূলত ভাবুক কবি হলেও বাস্তব বুদ্ধি চিন্তা ও মননের ক্ষেত্রও যথেষ্ট পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। “নজরুল শিল্পী হিসাবে প্রতিভাবান বালকের ন্যায় লিখে গিয়েছেন, কোথাও বয়স্কের ন্যায় ধী শক্তির পরিচয় দিতে পারেন না’’Ñ বুদ্ধদেবের এ অভিযোগ সম্পর্কে সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় বলেন,“ বুদ্ধদেবের এ অভিযোগ এরপর নির্বিচারে মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়। নজরুল প্রতিভা সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য আজ তাই কেবল সংশোধিত রূপেই গ্রহণ করা চলে।
×