ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

খালাস পেয়েও ১৩ বছর জেল খাটায় জবেদ আলীকে কেন ক্ষতিপূরণ নয়?

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৫ মে ২০১৬

খালাস পেয়েও ১৩ বছর জেল খাটায় জবেদ আলীকে কেন ক্ষতিপূরণ নয়?

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মেয়েকে বিষপানে হত্যার অভিযোগে পিতা জবেদ আলী বিশ্বাস যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হন। পরবর্তীতে উচ্চ আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়েও তাকে ১৩ বছর জেল খাটতে হয়েছে। অবশেষে জবেদ আলীকে মুক্তি দেয়া হয়। এরই মধ্যে চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের পক্ষে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। সাতক্ষীরার জবেদ আলী বিশ্বাসের ১৩ বছর সাজা খাটার ঘটনায় ‘মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ায়’ তাকে কেন ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে নাÑ এই মর্মে মঙ্গলবার রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, আইজি প্রিজন, সাতক্ষীরার তৎকালীন অতিরিক্ত দায়রা জজ তাপস কুমার, হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার ও জেল সুপারকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। মঙ্গলবার বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোহম্মদ ইকবাল কবিরের দ্বৈত বেঞ্চ এই আদেশ দেয়। পাশাপাশি, জবেদ আলীকে ‘বেআইনিভাবে’ কারাবন্দী রাখায় বিবাদীদের ‘নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলা’ কেন সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৫ ও ৩৬ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে নাÑ তাও জানতে চাওয়া হয়েছে ঐ রুলে। ‘খালাসের রায়ের ১৩ বছর পরও জেল খাটছেন জবেদ আলী’ এই শিরোনামে গত ২ মার্চ একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজ মেয়েকে বিষ খাইয়ে হত্যার অভিযোগে ২০০১ সালের পহেলা মার্চ বিচারিক আদালত জবেদ আলীকে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে। পরবর্তীকালে হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে তাকে বেকসুর খালস দেয়। হাইকোর্টের এই আদেশের অনুলিপি সাতক্ষীরার অতিরিক্ত দায়রা জজ-৩ আদালতের বিচারক তাপস কুমার দের নিকট পৌঁছায়। কিন্তু তিনি খালাস আদেশ জেল কর্তৃপক্ষের কাছে না পাঠিয়ে আদালতের রেকর্ড রুমে সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। তার কারণে ১৩ বছর বিনা বিচারে জেলে থাকতে হয় জবেদ আলীকে। প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরদিন সাতক্ষীরার জেলা দায়রা জজ আদালতে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। এরপর আদালত তার কারামুক্তির নির্দেশ দেন। দীর্ঘ ১৩ বছর বিনা বিচারে কারাভোগের ঘটনায় ১৯ মে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সভাপতি ব্যারিস্টার আবদুল হালিম। খালাসের পরও ১৩ বছর বিনাবিচারে আটক রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ক্ষতিপূরণের জন্য নির্দেশনা চাওয়া হয় ওই রিট আবেদনে, যা মঙ্গলবার শুনানির জন্য ওঠে। রিট আবেদনকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল হালিম নিজেই আদালতে শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। আবদুল হালিম পরে সাংবাদিকদের বলেন, নিম্ন আদালত ২০০১ সালে এক মামলায় জবেদ আলীকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়। জবেদ আলীর করা আপীলে ২০০৩ সালে হাইকোর্ট তাকে খালাস দেয়। কিন্তু সাতক্ষীরার তখনকার অতিরিক্ত দায়রা জজ খালাসের আদেশ কারাগারে না পাঠানোয় জাবেদের মুক্তি আটকে থাকে ১৩ বছর। চলতি বছর ২ মার্চ তিনি মুক্তি পেলে বিষয়টি খবরের শিরোনামে আসে। সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৫ ও ৩৬ অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হয়েছে দাবি করে এই রিট আবেদন করা হয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয় পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। আইনের বাইরে গিয়ে এমন কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না, যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। আইনবহির্ভূতভাবে কাউকে তার জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, বলা হয়েছে ৩২ অনুচ্ছেদে। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে দ- দেয়ার ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ, বিচার পাওয়ার অধিকার, জবানবন্দী গ্রহণ ও নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দ- দেয়ার বিষয়ে বিধিনিষেধ সম্পর্কে বলা হয়েছে। আর ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে নাগরিকদের চলাফেরা, বসবাস ও দেশত্যাগ বা দেশে ফেরার অধিকারের বিষয়ে। মামলার বিবরণ থেকে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কয়লা গ্রামের আমজেল বিশ্বাসের ছেলে জবেদ আলী বিশ্বাসের স্ত্রী ফরিদা খাতুনের মৃত্যুর পর তাদের দুই মেয়ে লিলি (৮) ও রোকসানাকে (৫) তালা উপজেলার মানিকহার গ্রামে তাদের মামা আবুল কাসেমের বাড়িতে থাকত। ১৯৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জবেদ আলী শ্যালকের বাড়িতে বেড়াতে গেলে ওই দিনই লিলির মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় লিলিকে বিষ খাইয়ে হত্যার অভিযোগে তার বাবা জবেদ আলীর বিরুদ্ধে তালা থানায় মামলা করেন কাসেম। পরদিন পুলিশ জবেদকে গ্রেফতার করে এবং তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। সাতক্ষীরা জেলা আদালতের আইনজীবী জিল্লুর রহমানকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সিরাজুল ইসলাম ২০০১ সালের ১ মার্চ জবেদ আলীকে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদ- দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জবেদ আলী হাইকোর্টে আপীল করেন এবং ওই বছরের ১১ মে তাকে সাতক্ষীরা কারাগার থেকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ হাইকোর্ট জবেদ আলীকে নির্দোষ ঘোষণা করে বেকসুর খালাস দেয়। ২৬ মার্চ হাইকোর্ট থেকে খালাসের আদেশ সাতক্ষীরার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে পৌঁছায়। সংবাদমাধ্যমে আসা খবরে বলা হচ্ছে, সাতক্ষীরার তৎকালীন অতিরিক্ত দায়রা জজ হাইকোর্টের ওই আদেশ কারাগারে না পাঠিয়ে আদালতের রের্কডরুমে সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। রায়ের ১৩ বছর পর গত ২ মার্চ কারাগার থেকে মুক্ত হন জবেদ আলী বিশ্বাস (৫৯)।
×