ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া রোয়ানুর আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৫ মে ২০১৬

বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া রোয়ানুর আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত

চট্টগ্রাম অফিস/নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঁশখালী ॥ ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে বৃহত্তর চট্টগ্রামে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া। এই দুই উপজেলায় ভেঙ্গে গেছে বেড়িবাঁধ। ফলে নোনা পানিতে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ক্ষতি হয়েছে ফসলের, ভেসে গেছে অনেক মৎস্য প্রকল্প। বিশেষ করে বর্ষা মওসুমের আগে বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতের জন্যও আতঙ্কগ্রস্ত উপকূলীয় লোকজন। বর্তমানে এই দু’উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ার-ভাটার পানি ঢুকছে ও বেরুচ্ছে। দ্রুত এ বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মিত না হলে আরও ভয়াবহ দুর্ভোগের শঙ্কা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। বাঁশখালীতে এখনও খোলা আকাশের নিচে হাজারো মানুষ। এদের বাড়িঘর ল-ভ- করে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। কক্সবাজার থেকে সংবাদদাতাদের প্রেরিত তথ্যে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় ২০ হাজারেরও বেশি পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। চিংড়ি ঘের, ফসল ও লবণের মাঠ একাকার হয়েছে প্রবল বর্ষণ ও সমুদ্রের জোয়ারে। বিধ্বস্ত হয়েছে অসংখ্য কাঁচাঘর। উপড়ে গেছে বহু গাছপালা। এছাড়া গবাদিপশুর ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। স্থানীয় প্রশাসন শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। কুতুবদিয়ার মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং একইসঙ্গে আতঙ্কগ্রস্ত বেড়িবাঁধ বিলীন হওয়ায়। সাগর বেষ্টিত এই দ্বীপের পশ্চিম-উত্তরাংশের বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছে। সে কারণে স্থলভাগের ওপর দিয়ে জোয়ার-ভাটার পানি ও অবাধে চলাচল করছে। অবস্থা এমন যে, জোয়ার ভাটা আলাদা করার কোন উপায় নেই। এ অবস্থায় আতঙ্কিত কুতুবদিয়াবাসীর পক্ষ থেকে যত দ্রত সম্ভব বাঁধ নির্মাণের দাবি জানানো হয়েছে। চট্টগ্রামস্থ কুতুবদিয়া সমিতির নেতৃবৃন্দ সোমবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আগামী পূর্ণিমার আগেই বেড়িবাঁধ সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। রোয়ানুর প্রভাবে ঝড়ো হাওয়া ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত উত্তর ধুরং, আলী আকবর ডেইল, কৈয়ার বিল ও দক্ষিণ ধুরংয়ের বহু ঘরবাড়ি শনিবার চলে যায় পানির নিচে। সে পানি এখন সরে গেলেও রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। গ্রামগুলোর দিকে তাকালেই অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয় যে, লোকালয়ের উপর দিয়ে বড় ধরনের এক ধকল বয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড়ে বিলীন হয়েছে ওই এলাকার অন্তত অর্ধেক ঘরবাড়ি। উপজেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে মোট ৪১ কিলোমিটার। এরমধ্যে মাত্র ৫/৬ কিলোমিটার বাঁধে ছিল সিসি ব্লক। রোয়ানুর তা-বে ভেসে গেছে সেই ব্লকগুলোও। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত যেটুকু ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে তা যথেষ্ট নয় বলে অভিমত ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবাসীর। তবে তাদের সবচেয়ে জোরালো দাবি বেড়িবাঁধ নির্মাণ। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে চট্টগ্রাম জেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার নাম বাঁশখালী। সমুদ্র উপকূলবর্তী এই উপজেলার হাজার হাজার মানুষ এখনও খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অন্তত ১০ হাজার ঘরবাড়ি হয়েছে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২ সহস্র্রাধিক ঘর। এ উপজেলারও পরিচিতি রয়েছে চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠ ও বিভিন্ন ধরনের দেশী মাছের চাষের জন্য। কিন্তু কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। সবই ভেসে গেছে রোয়ানুর আঘাতে। বাঁশখালীর গ-ামারা, ছনুয়া, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, প্রেমাসিয়া ইউনিয়ন বহন করছে প্রবল এক ধ্বংসচিহ্ন। ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে নগদ অর্থ ও ত্রাণ বিতরণ করেন। কিন্তু অনেকেই এখনও গৃহহীন। দরিদ্র কৃষক পরিবারের মাথায় হাত। বর্ষার আগে এসব ঘর আবার তারা আবার মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু নির্মাণ করতে পারবেন কি? বাঁশখালী থেকে জনকণ্ঠের নিজস্ব সংবাদদাতা জোবাইর চৌধুরী জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তা-বে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকার হাজারো মানুষ এখনও খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকারীভাবে পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের। মঙ্গলবার দুর্গত এলাকায় বিত্তবানদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে নগদ অনুদানের অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে উপজেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা প্রণয়ন করে যথাযথ ত্রাণ পৌঁছানো হচ্ছে বলে দাবি করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের তা-বে ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয় কেন্দ্র ও খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে উপকূলের হাজার হাজার মানুষ। ১০ হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, ১২ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের পরিবারের কান্নায় খানখানাবাদের আকাশ ভারি হয়ে উঠছে। সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, উপজেলার খানখানাবাদ, ছনুয়া, গ-ামারা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা এখনও পানির নিচে রয়েছে। প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটার কারণে স্বাভাবিক হতে পারছে না জনজীবন। খানখানাবাদ ইউনিয়নের প্রেমাশিয়া রোসাংগ্রীপাড়া রায়ছটার অধিকাংশ মানুষ বিধ্বস্ত বাড়িঘর মেরামত করতে না পারায় খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করছেন। দুর্গতদের জীবনে নেমে এসেছে দুর্বিষহ ভয়াবহ বিপর্যয়। তাছাড়া দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সঙ্কট। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সোমবার নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান প্রদান করা হয়েছে। সরজমিনে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগর উপকূল বেষ্টিত বাঁশখালীর উপজেলার খানখানাবাদ ইউনিয়নের রায়ছটা ও প্রেমাশিয়া গ্রাম সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। খানখানাবাদ ইউনিয়নের পাশাপাশি উপজেলার ছনুয়া, গ-ামারা ও সরল ইউনিয়নেরও একই এলাকা। অরক্ষিত বেড়িবাঁধ দিয়ে এখনও জোয়ার-ভাটার পানিতে দুলছে এলাকাবাসী। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে পানীয় জলের সংকট। গবাদিপশু ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে পুরো এলাকায়। গবাদি পশু ও মরা মাছের গন্ধে দুর্গত এলাকায় রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব। এই যখন পুরো উপকূলের অবস্থা প্রশাসন থেকে এখনও পর্যন্ত দুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী না পৌঁছার অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের। অচিরেই দুর্গতদের মাঝে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী না পৌঁছালে এলাকায় নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়। উপকূলের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়েছে। পাশাপাশি স্বজন হারাদের আর্র্তনাদে ক্ষেপে উঠছে উপকূল। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়েও এ এলাকায় বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। তাছাড়া ৩১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অরক্ষিত। বেড়িবাঁধের বিভিন্ন পয়েন্ট লোকালয়ের সাথে মিশে একাকার। ওই বেড়িবাঁধ ভাঙা পয়েন্টগুলো দিয়ে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ফলে ৫-৬ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের পানি এলাকায় প্রবেশ করেছে বলে এলাকাবাসী জানান। তাছাড়া প্রশাসন থেকে ঘূর্ণিঝড়ের আগাম প্রস্তুতিতে অবহেলা এবং ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত না রাখার অভিযোগও করেছেন অনেকে ।
×