ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলজয়ন্তী

ভক্ত-অনুরাগীর পদভারে উৎসব আমেজ ত্রিশালে ব্যাপক আয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৫ মে ২০১৬

ভক্ত-অনুরাগীর পদভারে উৎসব আমেজ ত্রিশালে ব্যাপক আয়োজন

বাবুল হোসেন ॥ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শেকড় ময়মনসিংহ ত্রিশালের কাজির শিমলা গ্রামের দারোগা বাড়ি, নামাপাড়া গ্রামের বিচুতিয়া বেপারী বাড়ি, দরিরামপুর একাডেমি আর নামাপাড়ার বটতলায় প্রতিষ্ঠিত কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন নজরুল প্রেমিক ভক্ত অনুরাগী আর গবেষকদের কাছে তীর্থস্থান ও চারণভূমি। এসবের বাইরে ত্রিশাল ও এর আশপাশে কবির নামে গড়ে উঠা নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা সংগঠনেও বছরজুড়ে চলে নজরুল গবেষণা ও চর্চা। কবির নামে গড়ে উঠা নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর বছরজুড়ে নজরুল গবেষণা ও চর্চাই জানান দেয় কবির প্রতি ত্রিশালবাসীর ভালবাসার মাত্রা কতখানি। ফলে শুদ্ধ নজরুল চর্চার অন্যতম গবেষণা কেন্দ্র ও পর্যটনের নগরী হয়ে উঠেছে ত্রিশাল। এ নিয়ে দারুণ খুশি ও গর্বিত স্থানীয়রা। বরাবরই জন্মজয়ন্তীকে ঘিরে নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে বাইরে, ত্রিশালের ঘরে ঘরে এই নজরুল চর্চা ও গবেষণা আরও বেগবান হচ্ছে। বরাবরের মতো এবারও নজরুলের ১১৭তম জন্মজয়ন্তীর ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালাকে ঘিরে ২৫-২৭ মে ত্রিশাল উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে। এ উপলক্ষে গোটা ত্রিশালে বিরাজ করছে এখন উৎসবের আমেজ। দরিরামপুর একাডেমি মাঠ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সাজানো হয়েছে বর্ণাঢ্য সাজে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বুধবার শুরু হওয়া এই জন্মজয়ন্তীর উৎসব চলবে শুক্রবার পর্যন্ত। একই সঙ্গে দরিরামপুর একাডেমি মাঠ ছাড়াও নজরুল ডিগ্রী কলেজ মাঠে বসছে বাহারি সব পণ্য সামগ্রী নিয়ে নজরুল মেলা। এবারের মেলায় নাগরদোলা ও পুতুল নাচ ছাড়াও ৬ শতাধিক স্টল থাকছে। এছাড়া একাডেমি মাঠে বরাবরের মতো বইমেলা তো থাকছেই। বুধবার বিকেল ৩টায় একাডেমি মাঠের নজরুল মঞ্চে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। উদ্বোধনী পর্বে সভাপতিত্ব করবেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী। দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি। এতে সভাপতিত্ব করবেন ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন, তৃতীয় দিবসের সমাপনীতে শুক্রবার সকাল ১০টায় প্রধান অতিথি থাকবেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এমপি। ভারতের আসানসোলের রুটির দোকান থেকে কিশোর নজরুলকে ১৯১৪ সালে দারোগা রফিজ উল্লাহ নিয়ে এসেছিলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাজির শিমলার নিজ বাড়িতে। তিনি নজরুলকে ভর্তি করে দেন ত্রিশাল উপজেলা সদরের দরিরামপুর একাডেমি স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে। এখান থেকে কবি নজরুলের স্কুল যাত্রা শুরু হলেও পরে বর্ষাকালে দারোগা তাঁকে যাতায়াতের সুবিধার জন্য জায়গীর করে দেন নামাপাড়া গ্রামের বিচুতিয়া বেপারী বাড়িতে। ত্রিশাল উপজেলা সদর থেকে তিন কিমি দূরে নামাপাড়া গ্রামের বিচুতিয়া বেপারী বাড়ি থেকে বটতলা হয়ে কিশোর নজরুল দরিরামপুর একাডেমি স্কুলে পড়তে যেতেন। নজরুলের শিকড় নামাপাড়া গ্রামের বিচুতিয়া বেপারী বাড়ির আঙিনায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র ও নজরুল আর্কাইভ। বিচুতিয়া বেপারীর যে ঘরে নজরুল থাকতেন সেই শোবার ঘরটির ভিটি পাকা করে হয়েছে নজরুল আর্কাইভ। ৩ তলার স্মৃতি কেন্দ্রের নিচতলায় রয়েছে ২০০ আসনের অডিটোরিয়াম, ২য় তলায় অফিস ও ৩য় তলায় জাদুঘর কাম পাঠাগার। নজরুল জন্মজয়ন্তীকে সামনে রেখে বরাবরের মতো এবারও সাজানো হয়েছে এই স্মৃতিকেন্দ্রটি। বিচুতিয়া বেপারীর বংশধর আব্দুল বারেক বেপারী জানান, নজরুল কেন্দ্রিক উন্নয়নে তিনি খুশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পরিবারের জমি দানের কথা উল্লেখ করে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচুতিয়া বেপারীর নামে একটি হলের নামকরণের দাবি করেন তিনি। একই সঙ্গে স্মৃতিকেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ রাখার দাবি তার। নজরুলের বাল্য স্মৃতিবিজড়িত কাজির শিমলা গ্রামের দারোগা রফিজ উল্লাহর বাড়িতে করা হয়েছে কবি নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র ও পাঠাগার। দু‘তলার এই ভবনের নিচতলায় রয়েছে সেমিনার কক্ষ। দু’তলায় রয়েছে রিডিংরুম কাম রেস্ট হাউস। নজরুলের দুর্লভ সব ছবি, নজরুল সংগ্রহ, বেশ কিছু বই ও একটি পুরনো খাট। ভবনের সামনের পুকুরটি সংষ্কার করে পাকা করা হয়েছে ঘাট। দারোগা বাড়ির বংশধর কাজী শাহাদত হোসেন কাজির শিমলা গ্রামে সরকারের এই উদ্যোগের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রের পাশে একটি খেলার মাঠ করার দাবি করেছেন। স্মৃতি কেন্দ্রের কেয়ারটেকার আজিজুল হক জানান, স্মৃতিকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারত, শ্রীলঙ্কা, দুবাই ও অষ্ট্রেলিয়াসহ দেশ-বিদেশের নানা স্থান থেকে নজরুল প্রেমিক ভক্ত অনুরাগী ও গবেষকরা আসছেন তার শেকড় সন্ধানে। অথচ স্মৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার এক দশকেও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগসহ এর কোন সংস্কার ও মেরামত কাজ করা হয়নি। নজরুলের বাল্যস্মৃতি ধরে রাখতে নামাপাড়া গ্রামের বটতলায় স্থানীয় জনগণের দান করা জমিসহ মোট ৪২ একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। শেষ হয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য, সঙ্গীত, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল এই চারটি বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করে। পরে পাঁচটি অনুষদের আওতায় ব্যবসায় প্রশাসন, সামাজিক বিজ্ঞানসহ বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকসাহিত্য, লোক সংস্কৃতির উন্নয়ন ও গবেষণারও উদ্যোগ নেয়া হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ বিভাগে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. মোহিত উল আলম জানান, ত্রিশালে নজরুল কেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিবর্তন গোটা এলাকার শিক্ষা ও যোগাযোগ অবকাঠামোসহ ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীসহ নজরুল প্রেমিক ও গবেষকদের কাছে ত্রিশাল এখন নজরুল গবেষণার চারণভূমি ও পর্যটনের নগরী। নজরুল জন্মজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত নজরুল মেলায় হাজারো মানুষের ঢল নজরুলের প্রতি ভালবাসারই জানান দিচ্ছে। নজরুল ইনস্টিটিউট নজরুল চর্চা ও গবেষণায় আরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে দাবি তার।
×