ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রইবে মানুষ, নাই পরোয়া...

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৫ মে ২০১৬

রইবে মানুষ, নাই পরোয়া...

মোরসালিন মিজান ॥ মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া...। বহুকাল আগের সেই হুক্কাহুয়া ডাক এখনও কানে বাজে। জাত-পাত-ধর্মের নামে খুনোখুনি, হায়, শেষ হলো না! সত্য সুন্দর সাম্যের অভাবে আজও অশান্ত সমাজ। অস্থিতিশীল পৃথিবী। বেদনার এই ক্ষণে প্রেম, দ্রোহ ও সাম্যের সুমহান বাণী নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ান কবি। তুমুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেনÑ যে জাত-ধর্ম ঠুন্কো এত, আজ নয় কা’ল ভাঙবে সে ত,/ যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া...। মানুষের পক্ষে জয়গান করা এই বুলবুল কাজী নজরুল ইসলাম। ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের’ ১১৭তম জন্মবার্ষিকী আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, বুধবার। কবির ভাষায়Ñ ‘আমি যুগে যুগে আসি/ আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু।’ পরাধীন সময়ে ঝড়ের মতো, ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটেছিল নজরুলের। সেই কবেকার কথা! অথচ এই এখনও বিস্ময়কর আলো হয়ে পথ দেখিয়ে চলেছেন বাঙালীকে। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে আজ সারাদেশে উদ্যাপিত হবে নজরুলজয়ন্তী। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসছে নবীনÑ জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন! তাই সে এমন কেশে বেশে/ প্রলয় বয়েও আসছে হেসেÑ মধুর হেসে।/ ভেঙে আবার গ’ড়তে জানে সে চির সুন্দর...। নজরুল এই সুন্দরের নাম। দ্রোহ এবং প্রেমের অভূতপূর্ব সম্মিলন তিনি। সাম্যের মানবের এবং মানবতার কবি হয়ে উঠেছিলেন ‘বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের।’ ‘অপমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ বুকে ধারণ করেছিলেন। সারাজীবন ‘গন্ধবিধুর ধূপ’ হয়ে জ্বলা ‘দুখু মিয়া’ তিনি। তিনি কবি কা-ারি কাজী নজরুল ইসলাম। কিংবদন্তি কবির জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। মহকুমা আসানসোল। গ্রামের নাম চুরুলিয়া। অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান, পড়ালেখা শুরু করেন মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই গোটা পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাকে। জীবিকার প্রয়োজনে রুটির দোকানে কাজ নেন। মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম হিসেবেও কাজ করেছেন। তরুণ বয়সে সেনাসদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতি। সাহিত্যচর্চার শুরু বালক বয়সে। লেটো দলে যোগ দিয়ে শুরু হয় তার সাহিত্যচর্চা। নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। কবি বিশেষ আলোড়ন তুলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে। শোষকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে তিনি বলেনÑ ...আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।/ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,/ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!/আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল...। কাছাকাছি সময়ে রচিত তার আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’। এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা।’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে খুব দ্রুত আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণি’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈচৈ ফেলে দেয় সর্বত্র। কাজী নজরুল ইসলাম গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তার প্রথম গদ্য ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক জীবনে করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকে তার সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। সেনানিবাসেই তিনি লিখেছেনÑ ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান’। একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী’। তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ তার সঙ্গীত। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভা-ার তার। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তার সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়। কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যের কবি সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষকেও কাছে টেনে নিয়েছেন। নারীর প্রতি উপেক্ষা মেনে নেননি। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন কবি। অসাম্প্রদায়িক চেতনার নজরুল তার চার সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরানের আলোকে। তার প্রথম সন্তানের নাম কৃষ্ণ মুহাম্মদ। বাকিদের নামকরণ করা হয়Ñ অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। জেলে বসেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এভাবেই দুর্দম গতিতে এগিয়ে চলেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন আজকের নজরুল। তবে জীবনের বড় অংশজুড়ে ছিল নানান লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতো হয়ে যান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগ-ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, কাজী নজরুল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কালজয়ী কবি। আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’। পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ, বঞ্চনা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তার কণ্ঠ। নজরুলের ক্ষুরধার লেখনীর স্ফুলিঙ্গ যেমন ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়েছে, তেমনি তার বাণী ও সুরের অমীয় ঝর্ণাধারা সিঞ্চিত করেছে বাঙালীর হৃদয়কে। প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ কবির স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালীর কর্ম-চিন্তা ও মননে কাজী নজরুল ইসলামের অবিনশ্বর উপস্থিতি। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবোধের মূর্ত প্রতীক। অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। তার স্বপ্নের সমাজ বিনির্মাণে বর্তমান সরকার কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশব্যাপী নজরুলজয়ন্তীর প্রস্তুতি ॥ এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনে সারাদেশে পালিত হবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী। সকালে কবির মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবেন সর্বস্তরের মানুষ। এরপর দিনভর চলবে আলোচনা স্মৃতিচারণ উৎসব অনুষ্ঠান। জাতীয় পর্যায়ে ১১৭তম নজরুলজয়ন্তী উদ্যাপনের অংশ হিসেবে আজ চট্টগ্রামের এমএ আজিজ আউটার স্টেডিয়ামে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এছাড়াও নজরুল স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লা ও ময়মনসিংহে থাকবে নজরুলজয়ন্তীর বিশেষ আয়োজন। জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি বিকেলে নজরুল মঞ্চে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। ‘বাংলা গানে নবআধুনিকতার প্রবর্তনায় কাজী নজরুল’ শীর্ষক বক্তৃতা করবেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান। অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সদ্য প্রকাশিত ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলি’র নজরুল বিষয়ক খ- উপস্থাপন করবেন ড. অনু হোসেন। সভাপতিত্ব করবেন বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিল্পকলা একাডেমি বুধবার বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। কবির কবিতা থেকে আবৃত্তি, গান ও নৃত্য পরিবেশন করবেন জনপ্রিয় শিল্পীরা। ছায়ানটের দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা শুরু হবে শুক্রবার। ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে শনিবার পর্যন্ত চলবে এ উৎসব। সান্ধ্যাকালীন আয়োজনে থাকছে নজরুলের গান, পাঠ, আবৃত্তি ও নৃত্যানুষ্ঠান। সংগঠনের শিক্ষক শিক্ষার্থী ও খ্যাতনামা শিল্পীরা উৎসবে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম এবং সঙ্গীতের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে। পরিবেশন করা হবে নানা আঙ্গিকের গান। এতে মূল আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী। এর আগে মঙ্গলবার থেকে নানা আয়োজনে জাতীয় কবির ১১৭তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন শুরু করেছে নজরুল একাডেমি।
×