ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রোকেয়া-যুগের শেষ বাতিঘরের বাতি

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৫ মে ২০১৬

রোকেয়া-যুগের শেষ বাতিঘরের বাতি

নূরজাহান বেগম আর নেই। যদিও পরিণত বয়সের মৃত্যু, কিন্তু কোনো কোনো মৃত্যুর শূন্যতা সহজে পূরণ হয় না। নূরজাহান বেগমের মৃত্যুরও শূন্যতা সহজে পূরণ হবে না। বেগম রোকেয়াকে আমি দেখিনি, কিন্তু পরবর্তীকালে বেগম সুফিয়া কামালের মধ্যে তার প্রতিভাস দেখেছি। নূরজাহান বেগম যেন ছিলেন এই দুই মহীয়সী নারীরই একজন শেষ প্রতিনিধি। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রোকেয়া-সুফিয়া কামাল যুগেরই একটি প্রলম্বিত ধারার অবসান হলো বলা চলে। আমার সৌভাগ্য, নূরজাহান বেগমকে শুধু চোখে দেখা নয়, দীর্ঘকাল তার সান্নিধ্যে থাকার এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এক সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা, কয়েক বছর আগে তিনি যখন একুশে পদকে ভূষিত হন সেই পদক গ্রহণের অনুষ্ঠানে। তিনি তখন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। পদক গ্রহণ শেষে মঞ্চ থেকে নেমে এসে যখন হুইল চেয়ারে উঠবেন, তখন আমাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত আনন্দের সঙ্গে বললেন, গাফফার, এদিকে এসো, বহুকাল তোমার সঙ্গে দেখা হয় না। লন্ডন থেকে কবে এসেছো? বলেছি, কয়েকদিন হয়। শিগগিরই আবার চলে যাব। তিনি কাছে ডাকলেন, বললেন, আমার কাছে আসো। আমার মেয়েরা তোমার ছবি তুলবে। আমি তার হুইল চেয়ার ধরে দাঁড়ালাম। বেশ কয়েকটি স্নাপ নেয়া হলো। তিনি আমার হাত ধরে বললেন, সময় পেলে বাসায় এসো। তোমাদের দাদাভাই তো (তার স্বামী-রোকনুজ্জমান খান) নেই’, তোমাদের দেখলে তবু সান্ত¡না পাই। সেই আমাদের শেষ দেখা। তার শরৎগুপ্ত রোডের (দয়াগঞ্জ) বাসায় আমার আর যাওয়া হয়নি। তবে ল-নে বসেও টেলিফোনে আমার কথা হয়েছে। তাকে এবং বেগম পত্রিকা নিয়ে আমি ঢাকায় এক দৈনিকে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেটা পড়ে খুশি হয়ে তিনি আমাকে লন্ডনে টেলিফোন করেছিলেন। তাকে বলেছিলাম, সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকাটিকে একটু আধুনিক চেহারায় উন্নত করার জন্য। তিনি বলেছিলেন, আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। বয়স হয়ে গেছে। এখনকার মেয়েরা সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের মেইন স্ট্রিমে ঢুকে গেছে। এখন আর আলাদা নারী-সাংবাদিকতা বা সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে তারা আগ্রহী নয়। এককালে বেগম ছিল তাদের একমাত্র আশ্রয়। এখন তা নয়। তবু বেগম টিকে আছে। হয়তো আমার মৃত্যুর পরও থাকবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অন্যান্য জাগরণের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান নারী সমাজকে এগিয়ে আনার ব্যাপারে বেগমের একটা ভূমিকা আছে। আমি তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। দেশভাগেরও আগে কলকাতা থেকে বেগম যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, বাঙালি মুসলাম নারী সমাজের যে পশ্চাৎপদ অবস্থান তখন ছিল তা আজ আর নেই। সেই পাশ্চাৎপদ অবস্থা থেকে বাংলাদেশের নারী আজ যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেজন্য বেগমের সংগ্রাম ও অবদানের কথা স্মরণীয়। বেগম রোকেয়ার নারী জাগরণের অসমাস্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল বেগম পত্রিকা। পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বেগম সুফিয়া কামালের ওপর। নূরজাহান বেগম তখন একেবারেই তরুণী। সদ্য কলেজ থেকে বেরিয়েছেন। তারুণ্যের উৎসাহ নিয়ে তিনি বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে পত্রিকাটি সম্পাদনায় সহকারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। বেগম সুফিয়া কামাল অবসর নিলে তিনি সম্পাদনার পুরো দায়িত্ব নিয়েছিলেন। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। নূরজাহান বেগমের পিতা স্বনামখ্যাত মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন শুধু বাঙালি মুসলমানের প্রথম প্রগতিশীল সাহিত্যপত্র ‘সওগাতের’ প্রতিষ্ঠাতা নন, তিনি সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ-বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তরুণ মুসলাম সাহিত্যিকদের এগিয়ে আসার যে যুগ, সেই সওগাত-যুগেরও প্রবর্তক। ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং মোল্লাবাদের সকল বাধার মুখে নারী শিক্ষা প্রবর্তন এবং নারী জাগরণে সেকালে বেগম রোকেয়ার একক সাহসী ভূমিকার ছিলেন পরবর্তীকালের সমর্থক। রোকেয়ার আদর্শের পতাকা বহনের জন্যই তিনি বেগম পত্রিকাটি প্রকাশ করেন এবং নিজের মেয়ে নূরজাহান বেগমকেও সেই আদর্শে গড়ে তোলেন। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পরই মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ঢাকায় চলে আসেন এবং কলকাতা থেকে ঢাকায় পাটুয়াটুলিতে লয়াল স্ট্রিটে তার সওগাত অফিস ও প্রেস স্থানান্তর করেন। পুরনো ঢাকার নারিন্দা সংলগ্ন দয়াগঞ্জের শরৎ গুপ্ত রোডে বসবাস শুরু করেন এবং প্রথমেই প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক বেগম। আমিও তখন ঢাকায় চলে এসেছি এবং কলেজে ভর্তি হয়েছি। সওগাত অফিসে খ-কালীন কাজ নিয়েছিলাম। এখানেই নূরজাহান বেগমের সঙ্গে পরিচয়। মাসিক সওগাত বের হলে আমরা একই রুমে বসে কাজ করতাম। আমি দেখতাম সওগাতের কাজ। নূরজাহান আপা দেখতেন বেগমের কাজ। এখন ঢাকায় নারী সাংবাদিকের অভাব নেই। মিডিয়ার সব শাখাতেই তাদের অবাধ বিচরণ। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় নারী সংবাদিক বলতে ছিলেন উল্লেখযোগ্য নাম নূরজাহান বেগম। ১৯৫১ সালে দৈনিক সংবাদ বের হলে লায়লা সামাদ এসে পত্রিকাটিতে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। নূরজাহান বেগমের সহকারী হিসেবে লায়লা সামাদ সাপ্তাহিক বেগমেও কিছুকাল কাজ করেছেন। তখনকার আরেকজন নারী সাংবাদিকের কথা জানি। তার নাম সালেহা বেগম। রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে নূরজাহান বেগম কিছুদিন পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তখন নাসিরউদ্দীন সাহেব একদিন আমাকে বললেন, ঢাকায় তোমাদের জানাশোনা কোনো মেয়ে কি নেই, যে সাংবাদিতায় আগ্রহী? আমি খুঁজে পেতে একটি নামও বলতে পারিনি। নাসিরউদ্দীন সাহেবই খুঁজে পেতে এক তরুণীকে আবিষ্কার করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী। নাম সালেহা বেগম। নাসিরউদ্দীন সাহেবেরই আত্মীয়া। তিনি তাকে ধরে এনে বেগমের দায়িত্ব গছিয়ে দিয়েছিলেন। আমার সন্দেহ ছিল সালেহা এই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কিনা? কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সালেহা বেগম সম্পাদনার কাজে পটু হয়ে উঠেছিলেন। সালেহা সম্ভবত এখন সাংবদিকতায় নেই। থাকলে নিশ্চয়ই খোঁজ পেতাম। ঢাকায় তো এখন নারী সাংবাদিকের অভাব নেই। কিন্তু সেই অর্ধশতকেরও বেশি সময় আগে বাংলাদেশে নারী সাংবাদিক তৈরিতে পথ দেখিয়েছিল সাপ্তাহিক বেগম। কেবল কি নারী সাংবাদিক? সাহিত্যে শিল্পে বাঙালি মুসলমান নারীকে ঘোমটামুক্ত হয়ে এগিয়ে আসার সবচাইতে বড় প্রেরণা যুগিয়েছে বেগম। একালের বহু নারী লেখক তৈরি করেছে বেগম। আমার মনে আছে প্রতি বছর বেগমের একটি বিশাল ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করা হতো। তাতে থাকতো শুধু নারীদের লেখা। নতুন লেখিকাদেরও উৎসাহ দেয়া হতো। এই ঈদ সংখ্যা বেগমের জন্য এতো লেখা আসতো যে, তা সময় মতো বাছাই করা সম্ভব হতো না। আমি সওগাতের কাজ নিয়ে নূরজাহান আপার সঙ্গে একই কক্ষে বসতাম। তিনি ঈদ সংখ্যার কাজে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে বলতেন, গাফ্ফার, তুমি আমাকে এই লেখা বাছাইয়ের কাজে একটু সাহায্য করবে? আমি সানন্দে সাহায্য করতাম। এখনকার দু’একজন বড় লেখিকার তখনকার কাঁচা লেখার সঙ্গে এমনি করেই আমার পরিচয় হয়েছিল। তখন প্রতি ডিসেম্বর মাসে বেগম রোকেয়ার উপর (জন্ম ও মৃত্যু দিবসে) বিশেষ সম্পাদকীয় ও লেখা বেরুতো বেগমে। নূরজাহান আপা সম্পাদকীয়তে নারীকে পুরুষতন্ত্রের পীড়ন, অবরোধের বাঁধন এবং অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে সাহসের সঙ্গে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাতেন। তাতে মাঝে মাঝে পুরুষদের রক্ষণশীল অংশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতো। কেউ কেউ বেগম পত্রিকায় চিঠি পাঠাতেন। “আপনারা মুসলমান মেয়েদের বের্পদা, বেশরম ও বেহায়া হওয়ার জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন।” এই ধরনের কয়েকটি চিঠি নূরজাহান আপা আমাকে একবার দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আরও শক্ত নারী আন্দোলন দরকার। তিনি এই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন বেগম পত্রিকার মাধ্যমে। সেই পঞ্চাশের দশকে সওগাত অফিসকে কেন্দ্র করে তখনকার তরুণ সাহিত্যিক-শিল্পীরা সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা-বিরোধী যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তাকে পৃষ্ঠপোষকতাদানে পিতা নাসিরউদ্দীন আহমদকে তিনি যেমন সাহায্য করেছেন, তেমনি স্বামী রোকনুজ্জামান খানকে দেশব্যাপী কিশোর সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা গড়ে তুলতে সর্বপ্রকার সহযোগিতা জুগিয়েছেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কচি-কাঁচার মেলাই ছিল সবচাইতে সংগঠিত এবং শক্তিশালী কিশোর আন্দোলন। এই আন্দোলনে রোকনুজ্জামান খানের হাত ধরে নূরজাহান বেগমও শরিক ছিলেন। যদিও তিনি ছিলেন নেপথ্যের চালিকাশক্তি। সামনে কখনো এগিয়ে আসেননি। তার সঙ্গে আমার একবারের টেলিফোন আলাপের কথা বলি। তখন তসলিমা নাসরিন এবং তার লেখাজোকা নিয়ে দেশময় বিতর্ক চলছে। তাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমি লন্ডন থেকে ঢাকায় নূরজাহান আপাকে টেলিফোন করেছিলাম, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তসলিমাকে অনেকেই বলছেন, উগ্র আধুনিক, উগ্র নারীবাদী। এ সম্পর্কে বেগম পত্রিকার অবস্থান কি? নূরজাহান আপা তার নিজের ভাষায় কথাটার যেভাবে জবাব দিয়েছিলেন, তার অর্থ দাঁড়ায়, “উগ্র আধুনিকতা সব সময় প্রগতির সহায়ক নয়।” এর বেশি তিনি আর কিছু বলতে চাননি। পিতা নাসিরউদ্দীন ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হকের ভক্ত। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টকে অকুতোভয়ে সমর্থন দিয়েছেন। তার কন্যা নূরজাহান বেগম কখনো দলীয় রাজনীতি করেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্রী। শেখ হাসিনা নিজ হাতেই তার শেষ জীবনে একুশে পদক তুলে দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে রোকেয়া যুগের শেষ বাতিঘরের বাতি নিভে গেল। এই মহীয়সী নারীকে শেষ প্রণতি জানাই। [লন্ডন, ২৪ মে, মঙ্গলবার, ২০১৬]
×